দিনাজপুরের হিলিতে ফেরদৌস আলী খান মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করে একাধিক অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীর অভিভাবক, স্থানীয় লোকজন ও গণমাধ্যম কর্মীরা। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, সম্পূর্ন বেতন পরিশোধ করা না হলে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হয় না, ক্লাস ছুটির পর অতিরিক্ত ক্লাশে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা, অভিভাবকরা অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে সাক্ষাত না করা, অভিভাবককে স্কুলে ঢুকতে বাধা প্রদান করা এবং অসম্মানজনক আচরণ করা, পড়া-লেখার মান নি¤œমুখী সহ ইত্যাদি। স্থানীয়দের মতে, স্থানীয় দানবীর ফেরদৌস আলী খানের হাকিমপুরের বোয়ালদাড় গ্রাম জন্মস্থান হওয়ায় তিনি উন্নয়ন বঞ্চিত এলাকার কথা ভেবে এবং জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে তার নামে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলে। যা এলাকার আশে-পাশেও ছড়িয়ে পড়ে। এরফলে প্রথম শ্রেণী থেকে একাদশ শ্রেণীতে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি শুরু হয় এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে বই বিতরনের মাধ্যমে পাঠদান শুরু হয়। কয়েক মাস সাফল্যের সাথে এগিয়ে চলে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু ২০১৯ সালের মার্চ মাসে সারাবিশ্বে প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় সরকার ১৭ মার্চ সারাদেশে লকডাউন দিলে দেশের সব সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষনা করে। এই অবস্থায় ফেরদৌস আলী খান মডেল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ ২ বছর পর করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সরকার পর্যায়ক্রমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ সকল কার্যক্রম চালু করলে করোনার ধকল কাটিয়ে আবার নতুন উদ্যোমে শিক্ষা মূখর হয়ে উঠে ফেরদৌস আলী খান মডেল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু করোনার মধ্যে অনেক শিক্ষক বেতন না পেয়ে বেকার হয়ে জীবন যাপন করে।
আবার অনেক শিক্ষককে বাদ দেওয়া হয়। তেমনি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকও কর্মহীন হয়ে পড়ে এবং অতিকষ্ঠে জীবন যাপন করে। স্থানীয়রা জানান, করোনার ধকল কাটিয়ে উঠতে অনেক অভিভাবকদের সময় লাগবে। তাই এখনই শিক্ষার্থীদের বেতনের জন্য মানুষিক ভাবে চাপ সৃষ্টি করা ঠিক না। সব মিলে সহনীয় ভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হলে প্রশ্ন উঠার কথা নয়। কিন্তু সেসব বিবেচনায় না নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সরকারের নিয়ম-নীতি না মেনে খেয়াল খুশিমতো পরিচালনা করা হচ্ছে। যা ছোট একটি শহরের গ্রাম-গঞ্জের এলাকায় নীলচাষে বাধ্য করার মতো। এটা মোটেই কাম্য নয়। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষের আচার-আচরণে ক্ষিপ্ত অভিভাবক ও স্থানীয় লোকজনেরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন অভিভাবক জানান, আমরা স্কুলের অব্যবস্থাপনা নিয়ে অধ্যক্ষের সাথে কথা বলতে গেলে তিনি সাক্ষাৎ করেন না। তার মনোভাব দেখলে মনে হয় তিনি মাটি দিয়ে হাটেন না। অসৌজন্যমুলক ও খারাপ আচরণ করেন। অনেক শিক্ষকেরও এমন আচরণ লক্ষ্য করা গেছে। স্কুলে অভিভাবকদের বসা নিয়েও কটুক্তি করেন। আমাদের ছেলে-মেয়ে এখানে লেখাপড়া করে আমরা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলব এটাই স্বাভাবিক। মনে হচ্ছে আমরা তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি। তাকে কোন কথা বলা বা জানতে চাওয়া যাবে না। স্থানীয়রা আরও জানান, এখানে তো এলাকার বাইরে কেউ পড়া-লেখা করে না। তারা স্থানীয় মানুষদের সাথে কোন সম্পর্ক বা সামাজিকতা স্থাপন করেন না। আবার তাদের প্রয়োজনে এলাকার বাড়ী বাড়ী গিয়ে ছাত্র-ছাত্রী খোঁজেন। যাদের মধ্যে সামাজিকতা নাই তারা কেন গ্রামে গ্রামে শিক্ষার্থী খুঁজবে? ভালো মানের প্রতিষ্ঠানে এমনিতেই ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি হবে। কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মী জানান, তাদের কয়েকটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়ে সেখানে যায়। সেখানে গিয়ে মনে হয়েছে ব্যবস্থাপনা বলতে কিছু নাই। আমন্ত্রণ করে অসম্মান করা হয়। বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেও যেখানে অব্যবস্থাপনায় ভরা। সেখানে কোন শৃঙ্খলা আছে বলে মনে হয় না। অভিভাবক রাজিউর রহমান মার্শাল জানান, ছেলের বেতনের সামান্য টাকা বাকি থাকায় আমি কয়েকদিন পর পরিশোধ করে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অধ্যক্ষ টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত আমার ছেলেকে পরীক্ষা দিতে দিবে না এবং স্কুলে প্রবেশ করতে দিবে না এই কথা বললে আমি মনে কষ্ট পাই। পরে টাকা পরিশোধ করলে ছেলেকে পরীক্ষায় অংশ নিতে দেয়। এবিষয়ে আমি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পৌর মেয়রকে জানিয়েছি। অনেক অভিভাবক জানান, এখানে লেখা-পড়ার মান ভালো না। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেতনও বেশি। তারপরেও আমরা এলাকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে সন্তানদের লেখাপড়া করাতে চায়। কিন্তু অধ্যক্ষের দুর্ব্যবহারে ছেলে মেয়েদের স্কুল থেকে বের করে আনতে বাধ্য হচ্ছি। একজন অভিভাবক জানান, আর্থিক অসুবিধার জন্য অধ্যক্ষকে বলি ছেলের বেতন পরিশোধ করতে একটু দেরি হবে। অধ্যক্ষ কোন কথা শুনেনি। এরপর আমার ছেলেকে স্কুল থেকে বের করে দেয়। এটা একজন অভিভাবকের জন্য কতটা কষ্টের বিষয়। এতে আমি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি। এই কষ্ট আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। পরে ছেলেকে অন্য স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছি। এই ভাবে প্রতিষ্টান চলতে পারে না। আরেক অভিভাবক ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, আমার বড় ছেলে সপ্তম শ্রেণী ও ছোট ছেলে কেজিতে পড়ে। কিছু টাকা বকেয়া ছিল। কিছুদিন পর টাকা পরিশোধ করব বলে জানিয়েছিলাম। কিন্তু এরমধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হলে আমার ছেলেরা পরীক্ষা দিতে স্কুলে যায়। তখন স্কুলের অধ্যক্ষ আমার ছেলেদের পরীক্ষায় অংশ নিতে না দিয়ে বের করে দেয়। এরপর আমার ছেলেরা কান্না করতে করতে বাড়ীতে আসলে আমি বলি কি হয়েছে। তখন ছেলেরা বলে আমাদের পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি। এই কথা শোনার পর আমার দুই ছেলেকে স্কুলে আর যেতে দেয়নি। পরে স্কুল কর্তৃপক্ষ আবার আমার ছেলেকে তাদের স্কুলে ফিরে নিতে বাধ্য করে। এবিষয়ে পৌর মেয়র জামিল হোসেন চলন্ত জানান, প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিভাবকেরা প্রায় সময় আমার কাছে অভিযোগ করেন। আমি মনে করি সরকারী নিয়ম মেনে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার।