গত ১০ বছরে আমাদের দেশে চিকিৎসাসরঞ্জামের বাজার বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু সে অনুপাতে দেশীয় উদ্যোক্তা বাড়েনি। দেশে বছরে সাত থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার মেডিক্যাল ডিভাইসের চাহিদা রয়েছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে। তবে আমদানি হচ্ছে পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকার পণ্য। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের বেশির ভাগ ব্যবহারযোগ্য/নিষ্পত্তিযোগ্য। রয়েছে অর্থোপেডিক পণ্য, অস্ত্রোপচারের জীবাণুনাশক, হাসপাতালের আসবাবপত্র, হোম কেয়ার ডিভাইস, ইলেকট্রো-কার্ডিওগ্রাম ও অন্য ছোট যন্ত্রপাতি। তবে প্রয়োজনের তুলনায় খুব স্বল্প পরিসরে এসব উৎপাদিত হয়। দেশের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে বহুল ব্যবহৃত আমদানি করা উচ্চপ্রযুক্তির ডিভাইসের মধ্যে রয়েছে কার্ডিয়াক স্টেন্ট, কার্ডিয়াক পেসমেকার, কৃত্রিম ভাল্ব, ডিজিটাল রক্তচাপ মনিটর, শ্রবণযন্ত্র, রক্তের ব্যাগ, প্রস্রাবের ব্যাগ, ডায়ালাইজার টিউব, মেডিক্যাল ভেন্টিলেটর, ডিজিটাল থার্মোমিটার ও এক্স-রে এবং আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন।
চিকিৎসাব্যবস্থার অত্যাবশ্যকীয় এসব পণ্যের সরবরাহে এখন চলছে হাহাকার। যেসব আমদানিকারকের কাছে এসব জিনিসের আগের মজুদ ছিল সরবরাহ ঘাটতির সুযোগ নিয়ে চার থেকে পাঁচগুণ বেশি দামে বিক্রি করছেন। এসব পণ্যসঙ্কটের একমাত্র কারণ গত চার মাস ধরে আমদানি করতে ব্যাংক থেকে এলসি বা ঋণপত্র খোলা বন্ধ রয়েছে। ডলার সঙ্কটের কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ডলার সঙ্কটের জটিলতায় এলসি খোলা সম্ভব হচ্ছে না। বিষয়টি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরকে এক-দেড় মাস আগে জানিয়েছেন এসব পণ্যের আমদানিকারকরা। আগের আমদানি করা চিকিৎসাসরঞ্জাম ক্রমেই শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে স্বাস্থ্য বিভাগও জানিয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, মেডিক্যাল ডিভাইস আমদানিতে ব্যাংক থেকে এলসি বা ঋণপত্র খোলার সমস্যা চলমান থাকলে, দেশে অতি শিগগির মেডিক্যাল ডিভাইসের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেবে। সামনের দিনগুলোতে হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। ওই চিঠিতে উল্লেøখ করা হয়, চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ মেডিক্যাল ডিভাইস দেশে উৎপাদিত হয় এবং অবশিষ্টাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। একই বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অবহিত করা হয়েছে কয়েক দফা চিঠি দিয়ে। মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় হতাশ মেডিক্যাল ডিভাইসের আমদানিকারকরা। অথচ এসব পণ্যের বেশির ভাগ আনা হয় চীন থেকে। সামান্য কিছুটা আসে কোরিয়া থেকে। ঋণপত্রের মাধ্যমে এসব পণ্য আমদানি করতে হয়। কিন্তু ডলার সঙ্কটে কোনো এলসি খোলা যাচ্ছে না। যৌক্তিক কারণ দেখালেও একটি এলসি খুলতে দিলেও দ্বিতীয়টি আটকে যাচ্ছে; যা প্রয়োজনের তুলনায় খুব সামান্য। এতে করে এ খাতের ব্যবসাও চরম খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। কর্মচারীদের বেতন, অফিস ভাড়া দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে এসব পণ্যের ব্যবসায়ীদের।
দেশে আমদানিনির্ভর চিকিৎসাসরঞ্জামের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ইউএসএইডের প্রকাশিত সাম্প্রতিক তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে চিকিৎসাসরঞ্জামের বাজার বছরে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের। যার ৮৫ শতাংশ আমদানিনির্ভর। বাংলাদেশে এ পণ্যের বিশাল বাজার থাকলেও মাত্র ১৫ শতাংশের জোগান আসে দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকে। আমাদের দেশে শুধু ইনজেকশন-সরঞ্জাম ও কিছু নিরাপত্তামূলক যন্ত্রপাতি উৎপাদন হয়। বাকি সব ধরনের সাধারণ ও উচ্চপ্রযুক্তির (হাই-টেক) মেডিক্যাল সরঞ্জাম আমদানি করতে হয়। আমরা মনে করি, অতিপ্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রী আমদানিতে সরকারকে প্রয়োজনীয় এলসি খোলার ব্যবস্থা করতে হবে। কোনোভাবেই যেন চিকিৎসার জন্য দরকারি এসব পণ্যের সঙ্কট না হয় সে দিকে এখনই খেয়াল দিতে হবে। আমরা আশা করি, সরকারের চিকিৎসাসামগ্রীর অভাবে কেউ যেন চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হবেন, এ ব্যাপারে সরকারের সদয় দৃষ্টি আছে এবং থাকবে।