রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় সরকার অর্থ সংকটে রয়েছে। এ কারণে উন্নয়ন কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ঠিকাদারদের বকেয়া বিলের পরিমাণ বাড়ছে। আবার সরকারের দৈনন্দিন ব্যয়ের বিলও যথাসময়ে পরিশোধ হচ্ছে না। ব্যাংক খাতে চেকে লেনদেন কমে যাওয়ার পেছনে এ পরিস্থিতিরও ভূমিকা রয়েছে। দেশের আমদানি বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে যাওয়ায় এ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায় বিরাজ করছে স্থবিরতা। ব্যাংক খাতের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সংবাদও লেনদেন কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শেষ মাসে দেশের ব্যাংকগুলোতে ১৮ লাখ ১ হাজার ৩৮৪টি চেক জমা হয়েছে। এসব চেকের মাধ্যমে লেনদেন হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯৭ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। যদিও নভেম্বরে ব্যাংক খাতে ১৯ লাখ ৪৩ হাজার ৮৮৯টি চেক জমা হয়েছিল। ওই মাসে চেকের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল ২ লাখ ২৭ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে ব্যাংকে চেকের মাধ্যমে ৩০ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা লেনদেন কমেছে। লেনদেন কমার হার ১৩ দশমিক ২৬ শতাংশ।
শুধু নভেম্বরের তুলনায়ই নয়, বরং গত ডিসেম্বরে চেকের মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ লেনদেন হয়েছে, সেটি আগের চার বছরের যেকোনো ডিসেম্বরের মধ্যেও সর্বনি¤œ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকে চেক জমা হয়েছিল ১৯ লাখ ৪৭ হাজার ৭৬৯টি। এসব চেকের মাধ্যমে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল। সে হিসাবে আগের বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় গত ডিসেম্বরে ব্যাংকে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৮৫টি চেক কম জমা পড়েছে। চেকের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন কম হয়েছে ৩৬ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকার। এক্ষেত্রে চেকের পরিমাণ ৭ দশমিক ৫১ শতাংশ কমলেও অর্থের লেনদেন ১৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ কমেছে। এর আগে কভিড-১৯ সৃষ্ট বৈশ্বিক দুর্যোগের মধ্যেও ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চেকের মাধ্যমে ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। আর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চেকের মাধ্যমে লেনদেন ছিল ২ লাখ ১ হাজার ৭২২ কোটি টাকা।
দেশের ব্যাংক খাতে শতভাগ আধুনিক এমআইসিআর চেকে লেনদেন হওয়ার কথা থাকলেও এখনো রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের কিছু ব্যাংকে নন-এমআইসিআর চেকে লেনদেন হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে চেকের মাধ্যমে লেনদেন হওয়া ১ লাখ ৯৭ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকার মধ্যে ১ লাখ ৯৭ হাজার ১৩০ কোটি টাকাই লেনদেন হয়েছিল এমআইসিআর চেকের মাধ্যমে। নন-এমআইসিআর চেকের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল বাকি ২৬৮ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে ইএফটির মাধ্যমে লেনদেন ছিল ৪৯ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। যদিও নভেম্বরে ইএফটির মাধ্যমে ৫০ হাজার ৩২২ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছিল। এছাড়া ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডসহ বিভিন্ন ধরনের কার্ডের মাধ্যমে ডিসেম্বরে লেনদেন হয় ৩৯ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। একই মাসে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ২৭ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা লেনদেন হয়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের (এমএফএস) মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ৯৬ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। আবার এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সে মাসে লেনদেন হয়েছে ৬২ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় সরকার অর্থ সংকটে রয়েছে। এ কারণে উন্নয়ন কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ঠিকাদারদের বকেয়া বিলের পরিমাণ বাড়ছে। আবার সরকারের দৈনন্দিন ব্যয়ের বিলও যথাসময়ে পরিশোধ হচ্ছে না। ব্যাংক খাতে চেকে লেনদেন কমে যাওয়ার পেছনে এ পরিস্থিতিরও ভূমিকা রয়েছে। দেশের আমদানি বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে যাওয়ায় এ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায় বিরাজ করছে স্থবিরতা। ব্যাংক খাতের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সংবাদও লেনদেন কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
চেকে লেনদেনের পাশাপাশি দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধিও কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুলাই-ডিসেম্বর এ ছয় মাসে ব্যাংকগুলোতে ৫৮ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকার আমানত বেড়েছিল। ২০২২ সালের একই সময়ে ব্যাংক খাতে মাত্র ১৮ হাজার ১১৩ কোটি টাকার আমানত বেড়েছে। ব্যাংক খাত থেকে নগদ টাকা তুলে নেয়ার ঘটনাও এ সময়ে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬৮ হাজার ১৮১ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে দেশের আমদানি বাণিজ্যও ২৮ শতাংশের বেশি কমেছে।
অর্থনৈতিক কর্মকা-ের স্থবিরতার প্রভাবই ব্যাংক খাতের লেনদেনে ফুটে উঠেছে বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় ব্যাংকে লেনদেনও বাড়ার কথা। বাজারে সবকিছুর দাম বাড়ল অথচ ব্যাংকে লেনদেন কমে গেল, এটি হতে পারে না। এর মানে হলো, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নেই। ডলার সংকটের প্রভাব অর্থনীতির সব শাখা-প্রশাখায় দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। আমদানি কমার প্রভাবে সংশ্লিষ্ট সব খাতের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফ্লোরপ্রাইস বেঁধে দেয়ার পর থেকে দেশের শেয়ারবাজার পুরোপুরি স্থবির। ব্যাংকে লেনদেন কমার ক্ষেত্রে এ স্থবিরতারও ভূমিকা রয়েছে।’
দেশের মোট ব্যাংক লেনদেনের প্রায় অর্ধেক এখনো চেকনির্ভর। গত নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে ব্যাংকে চেকের মাধ্যমে লেনদেন কমেছে ১৩ শতাংশেরও বেশি। লেনদেন হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এটি গত চার বছরের মধ্যে ডিসেম্বরে সর্বনিম্ন লেনদেন। অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবেই চেকের মাধ্যমে লেনদেন কমে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। উন্নয়ন কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ঠিকাদার থেকে শুরু করে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের বেশির ভাগ বিল পরিশোধ হয় জুন ও ডিসেম্বরে। আবার বছরের শেষ মাস হওয়ায় ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের লেনদেনও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে। ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্যও ব্যাংকগুলোতে জমা হয় গ্রাহকদের চেক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এর আগে ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে চেকের মাধ্যমে অর্থের লেনদেন প্রবৃদ্ধির ধারায় থেকেছে। কিন্তু গত ডিসেম্বর একেবারেই ব্যতিক্রম। ২০২২ সালের শেষ ছয় মাসের মধ্যে ডিসেম্বরে চেকের মাধ্যমে অর্থের লেনদেন সবচেয়ে কম। চলতি বছরের জানুয়ারির ব্যাংক লেনদেনের তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জানুয়ারিতেও চেকের মাধ্যমে ব্যাংকে অর্থ লেনদেন বাড়েনি।
এমন পরিস্থিতিতে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) মাধ্যমে লেনদেন বাড়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য সেটি বলছে না। গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে ইএফটির মাধ্যমেও লেনদেন কমেছে। লেনদেন কমেছে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এজেন্ট ব্যাংকিংয়েও। তবে ব্যাংকের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিং এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থের লেনদেন সামান্য বেড়েছে।
চেকের মাধ্যমে ব্যাংকে অর্থের লেনদেন কমে যাওয়া দেশের অর্থনৈতিক সংকটের ইঙ্গিত বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ডিসেম্বরে সব সময়ই বাজারে অর্থের প্রবাহ বাড়ে। এ কারণে ব্যাংকে লেনদেনও বেশি থাকে। এখন সে মাসেই যদি লেনদেন কমে যায়, তাহলে বুঝতে হবে দেশের অর্থনৈতিক সংকট দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।’ সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাবে দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি অনেক কমে গেছে। সরকারের স য়পত্র বিক্রির চেয়ে পরিশোধ হচ্ছে বেশি। আবার দেশের শেয়ারবাজারও অনেক দিন ধরে স্থবির। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকে লেনদেন কমে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।