দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাজেহাল অবস্থায় আছে রাজধানীর নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো। করোনার আগে মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করলেও, এখন দুর্বিষহ জীবন কাটছে তাদের। অনেকে হারিয়েছে কাজ। আবার আস্তে আস্তে কাজ পেলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। রোগশোকেও মিলছে না পর্যাপ্ত চিকিৎসা।
এমন একজন হাজেরা বেগম। অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের কেজী গুপ্ত লেনে ছোট একটা রুমে ভাড়া থাকেন। বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কাজ করে সংসার চলে তার। দুদিন ধরে ঘরে চাল, তেল, নুন কিছুই নেই। হাতে কোনও টাকাপয়সাও নেই। আপাতত আশপাশের বাসা থেকে ধার করেই কাটছে দিন। করোনার পর থেকেই এমন টানাপোড়েন হাজেরার।
হাজেরা বলেন, ‘করোনার আগেও জিনিসপত্রের দাম একটু কম ছিল। কিছুটা হিমশিম খেয়েও সংসার চালানো যেতো। এখন আর পারি না। চাল-ডাল থেকে শুরু করে তেল-নুন— এমন কোনও জিনিস নেই যে দাম বাড়েনি। সবকিছুর দামই বাড়ছে, শুধু আমার বেতন বাড়েনি। মাছের বাজার, তরকারির বাজার সব বাজারে আগুন। আর সেই আগুনে আমরা পুড়ে ছাই হয়ে গেছি।’ দুপুরে খেয়েছেন কি না, এমন প্রশ্ন করতেই কাপড়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আক্ষেপ করে বলেন, ‘করোনায় মরে গেলে ভালো হতো। তাহলে এখন আর ভাতের কষ্ট করা লাগতো না।’ হাজেরা বেগম বলেন, ‘আমি দুই বাড়িতে রান্না ও ধোয়ামোছার কাজ করে ছয় হাজার টাকা বেতন পাই। এর মধ্যে বাসা ভাড়া দিই সাড়ে তিন হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে কোনোরকমে সংসার পুরো মাস টানি। অসুস্থতার কারণে উনি (স্বামী) কোনও কাজ করতে পারেন না। গত পাঁচ বছরে একটা নতুন কাপড় কিনতে পারি নাই। তারেও একটা নতুন লুঙ্গি কিনে দিতে পারি নাই। প্রতিবেশীদের দেওয়া পুরান কাপড়চোপড় পরেই জীবন কাটছে। আগে তরকারি না থাকলে একটা ডিম ভেজে ভাত খেতাম। এখন ডিমের এতো দাম! তাই সেটাও কেনা যায় না। মাঝেমধ্যে কম দামে ভাঙা ডিম কিনি।’ ‘শাকসবজি, মাছ-মাংস সবকিছুর দাম আমাদের সাধ্যের বাইরে। আগে মাসের মধ্যে একবার-দুবার হলেও মুরগি কিনতাম। দাম বাড়ার পর এখন গিলা-কলিজাও কিনতে পারি না। গরুর গোশতের কথা আর কী বলবো, সেটা আমাদের কাছে স্বপ্ন। বছরে একবার কপালে জোটে তাও কোরবানির ঈদে; প্রতিবেশী কেউ দিলে। অসুস্থ থাকলে মানুষের বাড়িতে কাজ করতে পারি না। বুক-পিঠ-কোমরের ব্যথায় দাঁড়াতে পারি না। অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে কাজ করতে হয়। মাঝেমধ্যে ‘আত্মহত্যা’ করতে মন চায়। পরে আবার ভাবি, আমি আছি দেখে তো অন্তত তারে নিয়ে ভালো-মন্দ খেতে পারছি। আমি না থাকলে তার কী হবে?’ বলেন হাজেরা।
হাজেরার এক মেয়ে তাসলিমা বেগম। তাকে গ্রামে বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু চাহিদামতো যৌতুক দিতে না পারায় টিকতে পারেননি শ্বশুরবাড়ি। কিছুদিন আগে ঢাকায় মায়ের কাছে চলে আসেন বাচ্চাকে নিয়ে। এখন মায়ের কাছেই থাকেন।
হাজেরা বলেন, ‘মেয়ে আমাদের পাশের রুমে থাকে। সেও মানুষের বাসা-বাড়িতে কাজ করে নিজেও চলে আমাদেরও সামান্য কিছু দেয়। সেটা দিয়ে তার বাবার ওষুধ কেনা লাগে। মহল্লায় এমন এক অবস্থায় আছি লজ্জায় মানুষের কাছে হাত পাতি না আবার ঠিকমতো সংসারও চালাতে পারি না।’
কথা হয় তাসলিমার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বিয়েতে যৌতুক দিতে না পারায় শ্বশুরবাড়িতে অনেক নির্যাতনের শিকার হই। তাই ঢাকায় চলে এসেছি। ছোট রুমে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকা সম্ভব না দেখে আলাদা একটা ছোট রুম নিছি। মেয়েকে নিয়ে সেখানে থাকছি। বাসা-বাড়িতে কাজ করে নিজে চলছি এবং যতটুকু সম্ভব মা-বাবাকে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
হাজেরা বেগমের স্বামী আবদুস সাত্তার। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের উচাখিলায়। তিনি ঢাকায় আসেন ৯০-এর দশকে।
আবসুদ সাত্তারের বয়স বর্তমানে ৭০ হলেও জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্মতারিখ দেওয়া আছে ১৯৬০ সাল। এ জন্য তিনি বঞ্চিত হলেন বয়স্ক ভাতা থেকে।
সাত্তার বলেন, ‘আমাকে কোনও ধরনের বয়স্ক ভাতা বা অন্য কোনও ভাতা দেওয়া হয় না। এলাকার চেয়ারম্যান বলেছে, আমার নাকি এখনও বয়স্ক ভাতা পাওয়ার বয়স হয়নি। আমি অসুস্থতার কারণে কোনও কাজ-কাম করতে পারি না। ১৫ বছর ধরে পঙ্গু (প্যারালাইজডে আক্রান্ত) হয়ে ঘরে পড়ে আছি। বউ আর মেয়ে মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালায়।’
আক্ষেপ করে সাত্তার বলেন, ‘একজন বাবা হয়ে সন্তানের প্রতি যে দায?িত্ব পালন করা উচিত, অসুস্থতার কারণে তা করতে পারি না। স্বামী হয়ে স্ত্রীর ঠিকমতো ভরণ-পোষণ দিতে পারি না। তাদের কখনও ভালো খাবার কিনে খাওয়াতে পারি না। ভালো কোনও পোশাক কিনে দিতে পারি না। কীভাবে চলবে জীবন, জানি না।’