রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২৬ পূর্বাহ্ন

ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা জানে না রাজউক

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৭ মার্চ, ২০২৩

বহুতল ভবনে আগুন-বিস্ফোরণ, ভূমিকম্পে ভবনে ফাটল, ভবনধস বা হেলে পড়া– ঢাকা শহরের নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এতে হতাহত হচ্ছেন অসংখ্যক মানুষ। কিন্তু বাসযোগ্য নগর গড়তে তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। নগরে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যাও জানে না সংস্থাটি। সম্প্রতি পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে একটি বহুতল ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ২৫ জন। বহু মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনার পর রাজউক এখনো ওই ভবনের মূল নকশাসহ অন্য নথিপত্র খুঁজে পায়নি। ফলে রাজউকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
নাগরিকদের অভিযোগ, নগরে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে রাজউক কিছুটা নড়েচড়ে বসে। কিছুদিন পর সংস্থাটি আবার আগের গতিতে চলে। নগরে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণ, নিয়ম মেনে ভবন তৈরি, আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক ব্যবহার বন্ধসহ অন্য তদারকি করে না সংস্থাটি। ফলে পুরো শহরে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে শহরের দুই-তৃতীংশ ভবন ধসে পড়বে বলে মনে করেন নগর বিশেষজ্ঞরা। জানতে চাইলে নগর গবেষণা ও নীতি বিশ্লেষণী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান জাগো নিউজকে বলেন, নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ রাজউকের মূল দায়িত্ব। এই দুই ক্ষেত্রেই সংস্থাটি ব্যর্থ। রাজউকের আওতাধীন এলাকায় নিয়মের ব্যত্যয় করে বহু ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আবার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনও দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। কিন্তু কেউ তদারকি করছে না।
তবে রাজউকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, নগর অবকাঠামো মজবুত রাখতে তারা সদা সচেষ্ট। নগরের অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করেছেন। রাজউকের অনুমোদন ছাড়া কাউকে ভবন নির্মাণ করতে দিচ্ছেন না। এছাড়া যেসব ভবন রাজউকের অনুমোদন ছাড়া তৈরি করা হয়েছে বা নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
অতিঝুঁকিপূর্ণ ৪২ ভবন ভাঙা নিয়ে জটিলতা: গত ৭ মার্চ সিদ্দিকবাজারে একটি সাততলা ভবনে (আবাসিক ও বাণিজ্যিক) ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে গত শনিবার (৯ মার্চ) রাজউকের নগর উন্নয়ন কমিটি জরুরি বৈঠক করে। বৈঠকে ঢাকা শহরের অতিঝুঁকিপূর্ণ ৪২টি ভবন অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি। তারই অংশ হিসেবে গত রোববার (১২ মার্চ) এক সপ্তাহের মধ্যে ভবন খালি করতে সংশ্লিষ্ট মালিক এবং কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ভবন মালিকদের নিজ উদ্যোগে ভেঙে ফেলতে সময় দেওয়া হয়েছে দুই মাস। অন্যথায় রাজউক অপসারণ করে মালিকপক্ষের কাছ থেকে খরচ আদায় করবে। রাজউক সূত্র জানায়, দেশে দুর্যোগঝুঁকি কমাতে ২০১৯ সালে জাতীয় পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকায় সব ভবনের কাঠামোর ঝুঁকি নিরূপণে জরিপ পরিচালনা ও তালিকা তৈরির দায়িত্ব রাজউকের। তারা আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায় নগরের তিন হাজার ২৫২টি ভবন ‘র‌্যাপিড ভিজ্যুয়াল অ্যাসেসমেন্ট’ করে। এর মধ্যে ৫৭৯টির ‘প্রিলিমিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট (পিইএ)’ করা হয়। এতে দেখা যায়, ৪২টি ভবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ওই ৪২ ভবন ভেঙে ফেলার সুপারিশ করেছে রাজউক।
অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও মাদরাসা বোর্ডের ভবন রয়েছে। এছাড়া সমীক্ষায় ১৮৭টি ভবনের ‘ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট’ করে সেগুলো মজবুত (রেক্টিফাই) করতে বলা হয়েছে।
চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন পাটোয়ারী জাগো নিউজকে বলেন, রাজউক কোন চারটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলেছে তা আমাদের চিহ্নিত করে দেয়নি। রাজউক থেকে চিঠি পেলে আমরা ব্যবস্থা নেবো। তবে একসঙ্গে যে চারটি ভবনই ভাঙা হোক, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে। রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে সভা করে তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। সরকারি ভবন জরিপ শেষ হলে বেসরকারি ভবনের জরিপ শুরু হবে।
ভূমিকম্প ঝুঁকিতে ঢাকা: রাজধানীতে যে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে হলে আগে রাজউক থেকে ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র নিতে হয়। তারপর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছ থেকে নিতে হয় নির্মাণ অনুমোদন। নির্মাণ শেষে বসবাস করার জন্য বসবাস সনদ বা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নিতে হয়। এসব ছাড়া ভবন নির্মাণ হচ্ছে কি না, তা দেখাও রাজউকের দায়িত্ব। কিন্তু ঢাকায় ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা যথাযথ মানা হচ্ছে না। ভবন নির্মাণ অনুমোদন দিয়েই দায়িত্ব শেষ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। ভবনটি ভূমিকম্পসহনীয় করে নির্মিত হলো কি না, সে বিষয়ে কোনো তদারকি নেই তাদের। যে নকশার মাধ্যমে ভবনের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়, সেটি জমা নেয় না তারা। ফলে নতুন ভবনও নিরাপদ কি না, সেটা বলা যাচ্ছে না।
রাজউক সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও নতুন স্থাপনা নির্মাণে গুণগত মানোন্নয়নে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্প চালু হয়। চলতি বছরের অক্টোবরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। এ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা মহানগর এলাকার মাটি পরীক্ষা করে রাজউক। পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী ঢাকা ও আশপাশের ৬৫ শতাংশ এলাকার ভবন ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। মূলত বালু দিয়ে ভরাট করে যেখানে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে। ফলে ঢাকায় তুরস্কের মতো ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা। নাম প্রকাশ না করা শর্তে রাজউকের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত পরিচালিত রাজউকের এক জরিপের তথ্যমতে, রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও পল্লবীর ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভবন, রামপুরা, মতিঝিল ও খিলগাঁওয়ের প্রায় ৯৭ শতাংশ ভবন, ধানমন্ডির প্রায় ৮৯ শতাংশ ভবন রাজউকের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু কাঠামোগত নকশা না মানায় কারও বিরুদ্ধে কখনো মামলা হয়েছে, এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। আবার এসব ভবনের অধিকাংশই ঝুঁকিপূর্ণ।
আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের পরিচালক ও রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ হেলালী জাগো নিউজকে জানান, রাজউকের আওতাধীন এলাকার এক হাজার ৮২৫টি স্থান থেকে মাটি নিয়ে পাঁচ ধরনের পরীক্ষা করা হয়েছে। এছাড়া পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়েছে আরও ১০ রকমের। এতে নিশ্চিত হওয়া গেছে, বালু দিয়ে ভরাট এলাকা ভূমিকম্পের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা জাগো নিউজকে বলেন, ভূমিকম্পসহ সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে আগামী মাস থেকে রাজউকের অঞ্চল-৩ (মিরপুর) ও ৪ (মহাখালী) ভবনের নির্মাণ অনুমোদন দেওয়ার সময় স্থাপত্য নকশা, কাঠামোগত নকশার পাশাপাশি মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক ও অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত নকশা জমা নেওয়া হবে। আগামী মে মাস থেকে পদ্ধতিটি পুরো রাজউক এলাকায় চালু করা হবে। তখন নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কেউ ভবন নির্মাণ করতে পারবে না।
১৩ বছরে ১৪ ভবনধস: রাজধানীতে গত এক যুগে অন্তত ১৪টি ভবনধস ও হেলে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় অন্তত ৪০ জনের প্রাণহানি ঘটে, আহত হন শতাধিক ব্যক্তি।
রাজউকের সংশ্লিষ্টরা জানান, অধিকাংশ ভবনধস ও হেলে পড়ার ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভবনের অনুমতি ছিল না অথবা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ এ ধরনের ঘটনা নিয়মিত হলেও নিয়ম মানাতে রাজউকের কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এছাড়া রাজউকের আওতাধীন এলাকায় কত ভবন অনুমোদনহীন, তাও সংস্থাটি জানে না। ঢাকায় ভবনের ঝুঁকি নিরূপণে জরিপ পরিচালনা ও তালিকা তৈরির দায়িত্বও সংস্থাটির। কিন্তু ঠিক কত সংখ্যক ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, সেই তালিকাও তারা করেনি। রাজউকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, পরিকল্পিত নগর গড়তে বড় শহরের একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকে। রাজউক তেমনই একটি সংস্থা। ১৯৫৬ সালে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার উন্নয়ন এবং পরিবর্ধনের বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে প্রথম ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীসময়ে এ সংস্থাই ১৯৮৭ সালে রাজউকে পরিণত হয়। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে সংস্থাটি গঠন করা হয়েছিল, নাগিকরা তার সুফল পাননি।
দেশে ভবন হেলে পড়া কিংবা ধসের ঘটনার হিসাব সরকারি কোনো সংস্থার কাছে নেই। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ঢাকায় অন্তত ১৪টি ভবন হেলে পড়া ও ধসের ঘটনার তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে ২০১৫ সালের ১৫ মে রামপুরা হাজীপাড়ার আদর্শ গলিতে ঝিলের পাড়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা একটি দোতলা বাড়ি ধসে পড়ে। এতে অন্তত ১২ জনের মৃত্যু ঘটে।
২০১৫ সালে পুরান ঢাকার বংশালে ছয়তলা ভবন, একই বছর যাত্রাবাড়ীতে সাততলা ভবন, ২০১৬ সালে মোহাম্মদপুরে তাজমহল রোডে চারতলা ভবন, ২০১৮ সালে পুরান ঢাকার লালবাগে পাঁচতলা ভবন ও ২০১৯ সালে কামরাঙ্গীরচরে একটি পাঁচতলা ভবন হেলে পড়ার ঘটনায় কারও মৃত্যু হয়নি। তবে ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই সদরঘাটের পাটুয়াটুলীতে একটি তিনতলা ভবনের একাংশ ধসে পড়ে। এতে বাবা ও ছেলের মৃত্যু হয়। ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি কামরাঙ্গীরচরের দক্ষিণ রসুলপুর এলাকায় পাঁচতলা একটি ভবন হেলে পড়ে। ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কেরানীগঞ্জের মধ্য চরাইল এলাকায় তিনতলা একটি ভবন ডোবার মধ্যে উল্টে পড়ে। পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে ছয়তলা একটি ভবন ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট হেলে পড়ে। পুরান ঢাকার নাজিরাবাজারে পাঁচতলা একটি ভবনের আংশিক হেলে পড়ে ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর। রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) জরিপ অনুযায়ী, সংস্থাটির আওতাধীন এলাকায় (ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, সভার উপজেলা, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের আংশিক) প্রায় ২১ লাখ ৪৫ হাজার স্থাপনা আছে। এর মধ্যে কতটি ঝুঁকিপূর্ণ, সেই তালিকা নেই সংস্থাটির কাছে।-জাগোনিউজ২৪.কম




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com