তুর্কি নির্বাচনের প্রচার প্রচারণা নাটকীয় মোড় নিয়েছে। ক্ষমতাসীন পিপলস জোটের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী রজব তৈয়ব এরদোগানের প্রতিপক্ষ কামাল কিরিচদারুগলু কুর্দি দল এইচডিপির সাথে তাদের নিজস্ব প্রার্থী না দেয়ার ব্যাপারে সমঝোতায় এসে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কৌশল নিয়েছেন। এই কৌশলের প্রতিবাদ এসেছে তার জোটের জাতীয়তাবাদীদের পক্ষ থেকে। বিরোধী নেশন জোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক দল গুড পার্টির গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেতা বিরোধী জোট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারেন বলে ধারণা করছেন অনেক বিশ্লেষক। এর প্রভাব আর সে সাথে শাসক দলের প্রার্থীকে হারাতে ইউরোপ আমেরিকান প্রভাবশালী জোটের সাথে বিরোধী প্রার্থীর একাত্ম হওয়াটাকে তুর্কি জনগণ কিভাবে নেন তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে বেশ খানিকটা পিছিয়ে রয়েছেন বলে মনে করা এরদোগানের জনপ্রিয়তার পাল্লা আবার ভারী হতে শুরু করেছে। প্রশ্ন হলো, শেষ পর্যন্ত তুর্কি প্রজাতন্ত্রের শত বর্ষ উত্তর নতুন পর্বে কি নেতৃত্ব দিতে পারবেন এরদোগান?
ঘরে-বাইরে এরদোগান বিরোধীদের জোট: গত ২০০ বছর ধরে বৈশ্বিক জোটের পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো একটি দেশের রাজনীতিকে রূপ দেয়ার লক্ষ্য নিলে প্রায়ই তাদের কার্যক্রম সফল হতে দেখা যায়। গোয়েন্দা সংস্থা, মিডিয়া আউটলেট, আন্তর্জাতিক প্রেশার গ্রুপ এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক উপায়ের মতো তাদের টুলসের সাহায্যে পশ্চিমারা রাষ্ট্রগুলোকে ধ্বংস করেছে অথবা তারা যখন ইচ্ছা দেশগুলোর রাজনীতির পরিবর্তন এবং ডিজাইন করেছে। এমনটি দেখা গেছে সাম্প্রতিক বছরগুলো পর্যন্ত।
তবে একবারে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী গেম সেটিংয়ে বড় রাষ্ট্রগুলোর আগের অবস্থা আর নেই; আর যেসব দেশকে বড় দেশগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এখন তারাও আর এত ছোট বা শক্তিহীন নেই। আজকের তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান, মিসর, মেক্সিকো ও ব্রাজিল আর এমন দেশ নয় যে, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো চাইলেই তাদের নীতি বা শাসন রাতারাতি পরিবর্তন করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান রাজনীতিক তুরস্কে এরদোগানবিরোধী জোটকে সমর্থন করছে। মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে, এক দিকে, গ্রিস এরদোগানের রাষ্ট্রপতিত্ব নিয়ে অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে। অন্য দিকে, ইরান, ইসরাইল, মিসর, আর্মেনিয়া, বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশির ভাগ রাষ্ট্র মনে করে, তুর্কি রাষ্ট্রপতির উপস্থিতি দেশটিতে তাদের স্বার্থকে বিপন্ন করছে। আর আজ, প্রায় সব ঔপনিবেশিক দেশই তুর্কিয়েকে একটি স্যাটেলাইট রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। দেশের অভ্যন্তরে এরদোগানের বিরোধিতাকারী সব দল, ২০ বছর ধরে তুরস্কে তাদের মরিয়া কৌশল নিয়ে একত্র হয়েছে এবং একটি একক দলের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সংগ্রামে নেমেছে। তুরস্কের এরদোগানবিরোধী অভ্যন্তরীণ শক্তি বহিরাগতদের বিশ্বাস করে এবং বহিরাগতরা অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিদের ওপর নির্ভর করে। তবে প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে একা পরাজিত করার ক্ষমতা কোনো পক্ষেরই নেই।
ছয়টি দলের সমন্বয়ে গঠিত বিরোধী ব্লক নেশন অ্যালায়েন্স এরদোগানকে পরাজিত করার জন্য দুই বছর ধরে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, অবশেষে পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এইচডিপি) সমর্থন গ্রহণ করেছে।
এইচডিপির সাথে কিরিচদারুগলুর জোট! ওয়াইপিজি নামে পিকেকের সহযোগী সংগঠন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে সিরিয়ায় হিটম্যান হিসেবে একটি স্যাটেলাইট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। যখন এটি স্পষ্ট যে, নেশন অ্যালায়েন্স এরদোগানকে পরাজিত করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী নয়, তখন এইচডিপি বিরোধী ব্লকের নবাগত হিসেবে ‘ছয়ের টেবিলে’ যোগ দেয়।
এইচডিপি যখন জোটে অংশ নেয়, তখন নেশন অ্যালায়েন্সের একটি বড় অংশ বিদ্রোহ করে। শুধু গুড পার্টি (আইপি) চেয়ার মেরাল আকসেনার এইচডিপির উপস্থিতি দেখে বিরক্ত হয়েছেন এমন নয়, একই সাথে আইপির জাতীয়তাবাদী অংশের প্রতিনিধিত্বকারী ইয়াভুজ আগিরালিওলু এই বোঝাপড়ার সমালোচনা করে একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতাও দিয়েছেন এক সপ্তাহের আগে।
আগিরালিওলু বলেছেন, তারা সন্ত্রাসবাদের ছায়ায় থাকবেন না। তুরস্কের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের মতো, আইপি রাজনীতিবিদ ভেবেছিলেন যে এইচডিপিকে সন্ত্রাসবাদ থেকে আলাদা করা সম্ভব হয় কি না। কিন্তু এইচডিপি সরাসরি সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করার আহ্বানে এখন পর্যন্ত সাড়া দেয়নি। অধিকন্তু এইচডিপি কখনো সন্ত্রাসী সংগঠন পিকেকের নিন্দা করেনি বা তাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেনি; বরং মনে হচ্ছে তাদের ব্যাপারে প্রকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হলেন উত্তর ইরাকের সেই পর্বত যেখানে পিকেকের সদর দফতর কান্দিলের অবস্থান। এইচডিপি শুধু কান্দিলের নীতিই বাস্তবায়ন করছে।
অনেক দেশ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মানবিক মর্যাদার পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে, মানবাধিকারকে সমর্থন করে এবং অনেক দল এতে তুরস্কের এইচডিপির কাজ উপেক্ষা করে। যদিও এটি অনেকের কাছে স্পষ্ট যে, এইচডিপি এবং পিকেকে মূলত একই কেন্দ্রের নেতৃত্বে চালিত অভিন্ন সংগঠন। পিকেকের চাপিয়ে দেয়া চাপ এবং স্বয়ংক্রিয়-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এইচডিপি থেকে একটি নতুন স্বাধীন নীতির উদ্ভব হতে দেয়নি। যখন কেউ এই প্রেক্ষাপটে বিরোধীদের বিশ্লেষণ করে, তখন এটি স্পষ্ট হয় যে, অনেক দেশ একটি দুর্বল ও ভেঙে পড়া তুর্কিয়ের স্বপ্ন দেখে যাদের সাথে আছে গুলেনবাদী গ্রুপ এবং পিকেকে। এদের সবাই মনেপ্রাণে এরদোগানকে বিদায় করতে চায়।
দেশের বাইরে ও ভেতরে এরদোগানের বিরোধিতায় রয়েছে, বড় দলগুলোর সমর্থক যারা ২০ বছর ধরে ছোট প্রান্তিক গোষ্ঠী এবং নতুন প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর কাছে হেরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। লক্ষণীয় যে, বিরোধী দলগুলো গণতান্ত্রিকভাবে এরদোগানের মোকাবেলা করতে পারছে না এবং বিশ্বব্যাপী গেমসেটাররা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুর্কিয়ের কূটনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষমতা এবং কঠোর শক্তির মোকাবেলা করতে পারছে না। এখন সব পক্ষ সম্মিলিতভাবে এরদোগানের পতন ঘটাতে চাইছে। এটি কোনো গোপন বিষয় নয় যে, পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এইচডিপি) নিজস্ব রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী না দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তে কিরিচদারুগলুকে স্পষ্টভাবে সমর্থন রয়েছে। যেহেতু ঊর্ধ্বতন এইচডিপি সদস্যরা বারবার এরদোগানকে সমর্থন করাকে ‘কুর্দিদের প্রতি শত্রুতা’ সমতুল্য বলে মনে করেছেন, তাই তাদের আসলে বাইরে এসে জনগণকে ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষকে ভোট দিতে বলার দরকার নেই। তারা বলে যে, ‘কে গণতান্ত্রিক প্রার্থী আমাদের জনগণ তা জানে,’ তারা কিরিচদারুগলুর হাতে খেলার চেষ্টাই করে এবং নেশন অ্যালায়েন্সের মধ্যে জাতীয়তাবাদীদের অস্থির করা থেকে বিরত থাকার জন্য প্রকাশ্যে কথা বলে না। পিকেকে ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের সিনিয়র অপারেটিভদের ইতিবাচক বিবৃতিও সেই সত্যের প্রমাণ দেয়। দিনের শেষে, এইচডিপির ১১-দফা অবস্থানপত্র এবং নেশন অ্যালায়েন্সের নীতি প্রস্তাবগুলো একটি নির্দিষ্ট সাধারণ ভিত্তি পূরণ করে। নিরপেক্ষ ট্রাস্টিদের নিয়োগ বন্ধ করা, স্থানীয় সরকারগুলোতে আরো ক্ষমতা বরাদ্দ করা এবং ডিক্রি দ্বারা সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত ব্যক্তিদের মুক্তির বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। বর্তমান পরিস্থিতিতে, পিকেকে এবং গুলেনিস্ট গ্রুপ পিপলস অ্যালায়েন্সের শপথ নেয়া শত্রু। তারা কিরিচদারুগলুকে জয়ী করতে সাহায্য করার জন্য তাদের ক্ষমতায় কুলায় এমন সব কিছু করবে বলে উপসংহারে পৌঁছানোর বিষয়টা বোঝার জন্য রাজনীতিতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। আইপি চেয়ার মেরাল আকসেনার বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত বিরোধী জোটে ফিরে আসার আগে জোট ত্যাগ করার সময় অনুরূপ কথা বলেছিলেন। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তিনি নীরব ছিলেন, যা কৌতূহলের জন্ম দেয়। আগিরালিওলুর মন্তব্য এইচডিপির সাথে বিরোধী ব্লকের গোপন লেনদেনের প্রতি আপত্তি তুলে ধরে। তিনি এর মাধ্যমে দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলেছিলেন। সবচেয়ে আপসহীন বিবৃতিগুলোর মধ্যে একটি এইচডিপি সদস্য আহমেত তুর্কের কাছ থেকে এসেছে। তিনি বলেন, ‘যে কেউ এই সরকারকে সমর্থন করে তারা কুর্দি জনগণের প্রতি শত্রুতা করছে। কোনো কুর্দির এই সরকারকে ভোট দেয়ার বা সমর্থন করার অধিকার নেই।’ তিনি যুক্তি দেন যে এরদোগানকে ভোট দেয়া অগ্রহণযোগ্য অথচ তিনি প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে কুর্দি পরিচয়ের সবচেয়ে প্রগতিশীল সংস্কার করেছিলেন। তুর্কের এই বিবৃতি পিকেকে-এইচডিপির সর্বগ্রাসী জাতীয়তাবাদের একটি মূর্ত প্রতীক।
আতঙ্ক বাড়াচ্ছে বিদেশী প্রভাব:তুরস্কের নির্বাচন ঘিরে বিদেশী প্রভাব দেশটির অভ্যন্তরে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামিস্ট ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজমুদ্দিন এরবাকানের ছেলে ফাতিহ এরবাকানের দল নিউ ওয়েলফেয়ার পার্টির পিপলস জোটে যোগদান তারই একটি ইঙ্গিত বলে মনে হয়।
তুর্কি দৈনিক ইয়েনি সাফাকের সাবেক প্রধান সম্পাদক ইব্রাহিম কারাগুল টুইট বার্তায় লিখেছেন, এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্ক জেঙ্গেজুর করিডোরের মাধ্যমে আনাতোলিয়া এবং মধ্য এশিয়াকে সংযুক্ত করছে। ইরাকের সম্মতিতে এটি তুরস্ককে পারস্য উপসাগরের সাথে সংযুক্ত করছে। কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতও এই প্রকল্পে অংশ নেবে। যখন বিরোধিরা তুরস্ককে বিচ্ছিন্ন করার ‘মানচিত্র’ এর পরিকল্পনা তৈরি করছে, তখন সরকার তুরস্কের নতুন সিল্ক রোড খুলেছে। কারাগুল মনে করেন, কিরিচদারুগলু নির্বাচিত হলে; সিরিয়া ও ইরাক তুরস্কের ওপর আক্রমণ শুরু করবে। ইরান ও আর্মেনিয়া আজারবাইজান আক্রমণ করবে। লিবিয়া ও সিরিয়া থেকে তুর্কি সেনাদের প্রত্যাহার করা হবে। তুরস্ক রাশিয়ার সাথে প্রকাশ্য যুদ্ধে ধাবিত হবে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরো পরিকল্পনা। এরই এখন প্রস্তুতি চলছে।
কারাগুলের এই পর্যবেক্ষণ কিছুটা প্রান্তিক মনে হতে পারে তবে পররাষ্ট্র কৌশল এবং তুরস্কের আঞ্চলিক ভূমিকা দেশটির অনেক ভোটারকে প্রভাবিত করে। যারা এরদোগানের রক্ষণশীলতা অপছন্দ করে তাদের অনেকে মনে করেন তুরস্কের অখ-তা এবং স্বকীয়তা বজায় রাখতে এরদোগানের বিকল্প এখনো দেখা যাচ্ছে না। এ কারণে এরদোগানের পক্ষে জনমত আবার বাড়তে শুরু করেছে। তুর্কি বিশ্লেষক ইহসান আকতাস এর মতে, সর্বশেষ পরিস্থিতি হলো ২১ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান বর্তমানে নির্বাচনে কিছুটা এগিয়ে রয়েছেন। এরদোগান আগের নির্বাচনে ৫১.৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হোমল্যান্ড পার্টির (এমপি) চেয়ারপারসন মুহাররেম ইনসকে ২২ পয়েন্টের লিড দিয়ে পরাজিত করেছিলেন। এ কারণে প্রধান বিরোধী রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) চেয়ারপারসন কামাল কিরিচদারুগলুর নেতৃত্বে গঠিত ‘ছয়ের টেবিল’ এ এরদোগানবিরোধী সব উপাদানকে একত্রিত করার চেষ্টা করছে।
প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, শরণার্থী-বিরোধী ফ্যাসিস্ট, মধ্যপন্থী মুসলিম, উগ্র-বামপন্থী এবং ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদীদের মতো বিভিন্ন রাজনৈতিক দল একই ‘টেবিলে’ একত্রিত হয়েছে। সর্বশেষ, ‘টেবিল’-এ বিচ্ছিন্নতাবাদী পিকেকে সন্ত্রাসী সংগঠনের সহযোগী হিসেবে পরিচিত পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এইচডিপি) অন্তর্ভুক্ত হয়। তদুপরি, কিরিচদারুগলু ‘টেবিল’ আমন্ত্রিত প্রত্যেক অভিনেতাকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই ডেপুটিদের (ইতোমধ্যে সাতটিতে পৌঁছেছে-ভবিষ্যতে আরো প্রত্যাশিত) জিজ্ঞাসা না করে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি পা রাখতে পারবেন না। নিউ ওয়েলফেয়ার পার্টির নেতা ফাতিহ এরবাকান এ কারণে বলেছেন, ‘পৃথিবীতে এমন কোনো উদাহরণ নেই যেখানে সাতজন ভাইস প্রেসিডেন্ট আছেন। আপনি রাষ্ট্রপতির সাথে আট-মাথার ব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন। এটি একটি সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলা, একটি হযবরল ব্যবস্থা।’
শুধু সংখ্যার খেলা নয়: এই সব ছাড়ের কারণ হলো সরল পাটিগণিতের ওপর ভিত্তি করে: যখন অভিনেতাদের আনুমানিক ভোট একত্রিত করা হয় তখন তারা হিসাব করে যে তাদের যৌথ প্রার্থী কিরিচদারুগলু এরদোগানকে পরাজিত করবেন। কাগজ-কলমে জোটের সাফল্যের সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবে তা টিকবে কি না সেটিই এখন দেখার বিষয়। গণতন্ত্র ‘শুধু একটি সংখ্যার খেলা’ নয় এবং জোটে কিছু অভিনেতাদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিক্রিয়াও ইতোমধ্যেই জানানো হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘টেবিলে’ তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের প্রতিনিধিত্বকারী মেরাল আকসেনার তার দল, গুড পার্টি (আইপি) ও তার সমর্থকদের বিতর্কিত এইচডিপির সাথে জোট গঠনে রাজি করাতে চড়াই-উৎরাইয়ের মুখোমুখি হন। তার সাফল্যের সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহের কারণে জোট ত্যাগ করা সত্ত্বেও, আকসেনার অবশেষে পুনরায় যোগ দিতে রাজি হন। তবে, তার দল এবং সমর্থকরা সন্তুষ্ট হননি, অনেকেই ছাড় পেয়ে অপমানিত বোধ করছেন। এর ফলে, জাতীয়তাবাদীরা ইন্সের প্রতি তাদের সমর্থন স্থানান্তরিত করেছে, যিনি বিরোধী জোট থেকে আলাদাভাবে রাষ্ট্রপতি পদে তার প্রার্থিতা ঘোষণা করেছিলেন। বর্তমানে, ভোটে ইন্সের সমর্থন প্রায় ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে, বিরোধী ব্লক রাষ্ট্রপতি এরদোগানকে পুনরায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা দেয়ার জন্য আইনি উপায়ও খুঁজছে। তারা এরদোগানের প্রার্থিতার আবেদন প্রত্যাখ্যান করার জন্য সুপ্রিম ইলেকশন কাউন্সিলকে (ওয়াইএসকে) চাপ দিচ্ছে, কিন্তু সংবিধান স্পষ্ট করে যে তার প্রার্থিতার ক্ষেত্রে কোনো আইনি বাধা নেই। এরদোগানের প্রার্থিতা রোধ করার এই মরিয়া প্রচেষ্টা ‘ছয়ের টেবিল’-এর ব্যর্থতা প্রকাশ করে যা তাকে ব্যালট বাক্সে পরাজিত করার ক্ষেত্রে আস্থাশীল নয় বলে প্রমাণ করে। এই অসহায়ত্ববোধ এবং যুথসই কৌশলের অভাবে বিরোধী ভোটারদের হতাশা বাড়ারও সম্ভাবনা রয়েছে উল্লেখ করেছেন তুর্কি বিশ্লেষক বুরহানুদ্দিন দুরান। তিনি মনে করেন, ভোটাররা একটি অস্থির অঞ্চলে তুর্কিয়ের ক্ষমতা, অখ-তা এবং গণতন্ত্র রক্ষার গুরুত্ব বোঝেন, তারা বুঝতে পারবে যে সঙ্কটের সময়ে, দেশটি কোনো অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি নেয়া বা বেপরোয়া দুঃসাহসিক কাজে জড়িত হতে পারে না। ফলে আগামী নির্বাচনে তাদের পছন্দের কোনো পরিবর্তন হবে না। mrkmmb@gmail.com