॥পরিবর্তন ॥
মূল : জন ক্রেমার
অনুবাদ: হারুন ইবনে শাহাদাত
লোকটির বয়স ষাটের কাছাকাছি। সুন্দর করে ছাঁটা মাথা ভরা সাদা চুল, উন্নত নাক, তীক্ষ দৃষ্টি ভরা কালো চোখ। দামি ধূসর রঙের স্যুটে তাকে বেশ মানিয়েছে। আমার সাথে তার ব্যবধান অনেক। আমার বয়স তার চেয়ে অর্ধেকেরও কম। এলোমেলো ধূসর চুল। নাকের বিশেষ কোনো বিশেষত্ব নেই। তবে আমার চোখে হাসির ঝিলিক আছে। পোশাক অতি সাধারণ। বোতাম খোলা সাদা শার্ট আর নীল রঙের জিন্স। আভিজাত্যের চিহ্ন না থাকলেও এই পোশাক আমার কাছে খুব আরামদায়ক। তাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে, আমরা দু’জন দু’জনের জানের দুশমন। একজন আরেক জনকে যুগ যুগ ধরে খুঁজছি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য।
আমাদেরকে ঘিরে আছে লোকটির সাতজন বডিগার্ড। সুঠাম দেহের অধিকারী বিশ্রী কালো পোশাকের বডিগার্ডদের দু’জন তার দু’জন আমার আর তিনজন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। জানালার পাশের তিনজনের মাঝ থেকে দু’জন দু’জন করে ঘরের এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে সতর্ক পদক্ষেপে। তবে জানালাটা ফাঁকা থাকছে না। একজন সবসময় সেখানে থাকছেই। সবার হাতে গুলিভরা বন্দুক। আমার পাশের একজনের বন্দুক আমার বুকের দিকে তাক করা। সে সব সময় ট্রিগারে এমনভাবে আঙুল নাড়ছে, মনে হচ্ছে এখনই আমার বুক ঝাঁজরা করে দেবে।
আমি একটি চেয়ারে বসা। তবে হাত-পা চেয়ারের সাথে বাঁধা। আমার কাছে কোনো অস্ত্র নেই। ফোন করে কারো সাহায্য চাবো সে সুযোগও নেই। ইতোমধ্যে তারা আমার দু’জন সহকর্মীকে হত্যা করেছে। আমার বিশ্বাস আমিই বিজয়ী হতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার দু’জন সহকর্মী বাঁচার জন্য আত্মসমর্পণ করেছিলো। তারা অস্ত্র ফেলে দু’হাত উপরে তুলতেই ওরা অন্যায়ভাবে তাদের হত্যা করেছে। কাপুরুষরা এমনই হয়। দুর্বলের ওপর অত্যাচার করে ওরা আনন্দ পায়।
আমি এখন খুব কঠিন সময়ের মুখোমুখি। বৃদ্ধ লোকটির গর্জন শোনার জন্য অপেক্ষা করছি। না। আমাকে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। ইতোমধ্যেই তার গর্জন আমার কানে ব্রজপাত করলো : ‘খবরদার। কোন চালাকি করার চেষ্টা করবে না। তুমি যদি স্বেচ্ছায় সোজা পথে না আসো, কিভাবে আনতে হয় আমাদের জানা আছে। কোন প্যাঁচ খেললে পরিণতি হবে খুব খারাপ। আমি আমার লোকদের আদেশ করবো গুলি করে তোমার মাথার খুলি উড়িয়ে দিতে।’ বৃদ্ধ লোকটির কথা শেষ হওয়ার আগেই বন্দুকধারীদের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। তারা সব কয়টা বন্দুক আমার মাথার দিকে তাক করলো।
লোকটি মুচকি হেসে বলল, ‘এই বাচ্চা ছেলে। ভয় পেয়ো না। এখনই তোমাকে হত্যা করার প্রয়োজন আমাদের নেই। তোমাকে ছেড়ে দেবো। তবে তোমাকে অবশ্যই গোপন বিষয়গুলো বলতে হবে। আমরা তোমাদের ঐ গোপন বিষয়টা জানি। আমার গোয়েন্দারা আমাকে জানিয়েছে, তোমরা সুযোগ পেলেই রূপ পরিবর্তন করে ফেলো। তোমরা কিভাবে এটা করো আমাকে বলতে হবে। তোমাকে অবশ্যই আমার সামনে নিজের রূপ পরিবর্তন করে পালাতে হবে। এই যে তোমার পেছনে খোলা মাঠ দেখছো, এ দিক দিয়ে তুমি চলে যাবে। আমাকে বল, তুমি ঘোড়া, ব্যাঙ না কি খরগোশ কোন রূপ ধরে যাবে।’
আমি বুঝতে পারলাম কোথাও ভুল হচ্ছে। তার গোয়েন্দারা তাকে ভুল সংবাদ দিয়েছে। গোয়েন্দারা ইচ্ছে করেও এমন ভুল সংবাদ তাদের বসকে দিতে পারে, আবার এমনও হতে পারে মতিভ্রমের কারণে তারা নিজেরাই ভুল দেখেছে। আমাদের চলার শব্দে ভয়ে বন থেকে সাপ অথবা অন্য প্রাণী করে হয়ে খস-খস শব্দ করে পালানোর সময় দেখে ওরা মনে করেছে আমরাই হয় তো রূপ বদল করে পালাচ্ছি।
‘সৌভাগ্যবশত আমরা এবার সফল হয়েছি। আমাদের ফাঁদে তোমরা ধরা পড়েছো। আমরা জেনেছি কিভাবে তোমরা ফাঁদে পা ফেলেছো। তবে আমরা মনে করি না, এই শিকার আমাদের জন্য যথেষ্ট।’ লোকটি হাসতে হাসতে বলল। একটু বিরতি দিয়ে আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। এই হাসির অর্থ সে তার লোকদের কাজে সন্তুষ্ট।
সত্যি বলতে কি আমি পা ফসকে ফাঁদে আটকা পড়ার সময় কোন ব্যথা অনুভব করেনি। আমি পাথুরে পথে দ্রুত চলতে গিয়ে পা ফসকে ফাঁদে পড়েছি। অবশ্য আমার বিশ্বাস ছিল এখান থেকে উদ্ধারের জন্য কেউ না কেউ আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। অবশ্য এর মাধ্যমে আমার অনেক দিনের একটি আশা পূরণ হয়েছে। লোকটির সাথে সাক্ষাতের এ ছাড়া অন্য কোন পথ ছিল না। অবশেষে তার সাথে আমার সাক্ষাৎ হলো। আমার জন্য পাতা ফাঁদ তার জন্যও ফাঁদে পরিণত হয়েছে। সে এখন আমাদের লক্ষ্যবস্তু।
সে আবার গর্জে উঠলো।
‘অনেক হয়েছে। আমাদের জন্য এটাই যথেষ্ট। কিভাবে তুমি তোমার রূপ পরিবর্তন কর? কী সেই চালাকি?’
অবশ্যই এটা একটা চালাকি, তারা এর মধ্যে চালাকি ও কৌশলই খোঁজবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ তার কেউ তা পারে না।
‘এই আংটিটি কি আমি পরতে পারি. ’
কিন্তু আমি তারপর আর পারিনি। তার পোষ্যগুন্ডারা আমাকে আঘাত করে, জোর করে তা ছিনিয়ে নেয়। তারা ঐ লোকটির মতই রুক্ষ আচরণ করে। তারা আংটিটি আমার আঙুল থেকে খুলে তাদের বসের হাতে দেয়। সে খুব তীক্ষèভাবে তা পরীক্ষা করে দেখে, প্লাটিলামের ওপর একটি বড় রুবি বসানো। খুবই আকর্ষণীয়, রহস্যময়। কিন্তু আসলে তা কোন কাজের না।
‘এই বাচ্চা ছেলে বল, এটা কিভাবে কাজ করে? কিভাবে এটা ব্যবহার করতে হয়?’
সে এটা নিয়ে খেলতে শুরু করলো আর আমি তার সাথে খেলা শুরু করলাম।
‘খুব ভালো, তুমি যখন রুবিটা ঘষতে থাক, তখন বিড় বিড় করে কী বল।’
‘এই, তুমি নিজেকে খুব চালাক ভাব, তাই না? আমি আর তোমার সাথে খেলতে রাজি নই।’
তার সাথে অনেক সময় খেলার পর অবশেষে সে বুঝতে পারলো। ততক্ষণে সে অনেক দেরি করে ফেলেছে।
ততক্ষণে আমি নিজেকে একটা মাছি ভাবতে শুরু করেছি। আমার বন্ধন আগলা করে ফেলেছি। আমি তখন একটা মাছি তাই আমার পক্ষে একজন মানুষের আশপাশের ৩০ ফুটের মধ্যে রাজত্ব করা অসম্ভব নয়। তখন আমার ওপর আমার আর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এমন অবস্থায় যেকোন মানুষের পক্ষেই তার রূপ পরিবর্তন করা সম্ভব। তারা আমাকে পেছন থেকে ধাওয়া করলো। কিন্তু আমার খুব কাছাকাছি আসার আগেই লোকটি মারা গেলো। তার লোকেরা আশ্চর্য হলো, তাদের বন্দুকগুলো থেকে গুলি বের হলো। কিন্তু তা কোনো কাজে লাগলো না। মাছি মারতে কামান দাগানোর মতো একটা ব্যাপার হলো।
কিভাবে এবং কত দ্রুত ঘটনাগুলো ঘটলো। আমার হাত পায়ের বাঁধন আগলা হওয়ার পর আমি আর মানুষ থাকলাম না। বেবুন হয়ে গেলাম। এক লাফে লোকটির পায়ে দাঁত বসিয়ে দিলাম। তার গুন্ডারা কিছু করার আগেই তাদের বসকে খতম করে ফেললাম।
লোকটি যখন রুবি নিয়ে খেলছিলো, আর আমি তখন খেলছিলাম তাকে নিয়ে। সেই সময়েই নিজের রূপ বদলে মাছি হয়ে বাঁধন খুলে ফেলেছি। তারপরই হয়েছি বিশাল একটা বেবুন। পাশের রুম দিয়ে আমার বন্ধুরাও বেবুনের মতো ঢুকে পড়েছে। তারা একটুও দেরি করেনি। ঘরে ঢুকেই কাজ শুরু করেছে।
ততক্ষণে বারবার আমার রূপ বদল হচ্ছে। আমি নেকড়ে হয়ে শত্রুদের গলায় থাবা বসিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছি। কিন্তু দরজার দিকে তাকিয়ে আমাকে আবার রূপ বদল করতে হলো। কিছু অগ্নিচক্ষু আমার দিকে ছুটে আসছিলো। আমি বিশাল হাতি হয়ে গেলাম। জানালা ভেঙে রাস্তায় লাফিয়ে পড়লাম। আমার পায়ের নিচে পড়ে দশ না বারো কতজন মারা গেলো আমি বলতে পারবো না। চারদিক থেকে চাপ বাড়াতে থাকলো। না আমার পক্ষে আর রাস্তায় থাকা সম্ভব নয়। আমি কাক হয়ে আকাশে উড়লাম। একটা ভন্ড কাক আমাকে তেড়ে আসলো। তার সাথে যোগ দিলো এক ঝাঁক কাক। আমি আবার মাটিতে নামলাম। একবারে আতঙ্কগ্রস্ত বিড়াল হয়ে নামলাম। তারপরও আমাকে কেউ সাদর সম্ভাষণ জানায়নি। বাড়ি ছাদে শহরের গলিপথে সর্বত্র আমাকে আপদ ভাবা হয়েছে। নিজেকে কুকুর করে গলিপথে চলে গিয়েও স্বস্তি মিলেনি। জঞ্জাল সরানোতে সংশ্লিষ্ট সংস্থার সাহায্যের জন্য ফোন করে ফাঁসিতে ঝুলে যতো বোকামি করেছি। তাই নিজেকে বাঁচাতে আমাকে বারবার রূপ বদলাতে হয়। পরিবর্তনের এই ধারায় এখন আমি আগুন চোখের এক পাখি। একা একা উড়ে বেড়াই। ঘৃণার আগুনভরা চোখে ওদের এবং অন্যায় নিবারণকারী সংস্থাগুলোর অন্যায় দেখি। (সংক্ষিপ্ত) ( একটি কিশোর পত্রিকার ২০১৫ সালের জুলাই সংখ্যায় অনুবাদকের ছদ্মনাম আবু হামীম নামে প্রকাশিত অনুবাদ গল্পটি এবার স্বনামে দৈনিক খবরপত্রের পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করা হলো।- বি,স)