সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২৩ পূর্বাহ্ন

নতুন প্রজন্মের পাঠিকা

সমরেশ মজুমদার
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১২ মে, ২০২৩

(বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার গত ৮ মে, সোমবার সন্ধ্যায় কলকাতার একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সমরেশ মজুমদারের জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ মার্চ পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুঁড়িতে। তার ট্রিলজি উত্তরাধিকার, কালবেলা ও কালপুরুষ বাংলা সাহিত্য জগতে তাকে বিশেষ খ্যাতি এনে দিয়েছে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো সাতকাহন, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগ। ১৯৮২ সালে ভারতের আনন্দ পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে ভারতের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন সমরেশ মজুমদার। ইত্তেফাকে বিভিন্ন সময় তিনি বেশ কিছু কলাম লিখেছেন। ২০১৫ সালের ইত্তেফাক ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। দৈনিক ইত্তেফাকের সৌজন্যে দৈনিক খবরপত্রের পাঠকদের জন্য সমরেশ মজুমদারের লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।-বি.স)
সেদিন একটি কুড়ি-একুশের মেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো। বাড়ির কাজের লোকটিকে বহুবার বলেছি উটকো লোককে আপ্যায়ন করে বসার ঘরে বসাবে না। নাম জিজ্ঞাসা করবে, কেন এসেছে জেনে আমাকে জানাবে এবং আমি দেখা করতে সম্মত হলে দরজা খুলে বসতে বলবে। আমি থাকি তিনতলায়, বসার ঘর একতলায়। লেখার সময় কেউ এলে নিচে নেমে দেখেছি, যিনি এসেছেন তার আসার পেছনে জরুরি কোনো কারণ নেই। আধঘণ্টা বকবক করে যখন চলে গেলেন তখন আমার মাথা থেকে লেখা উধাও হয়ে গিয়েছে। তাই কাজের লোককে বাধ্য হয়েছি ঐ নির্দেশ দিতে।
কিন্তু এই লোকটির শরীর তৈরির সময় সব দেওয়া হয়েছিল শুধু বুদ্ধি দেওয়া হয়নি। অথচ সে নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবত। সেই বুদ্ধি খরচ করে আমাকে সন্তুষ্ট রাখতে চাইত, যা আমাকে বিপদে ফেলে দিত। বেলের শব্দ আমি তিনতলায় ঘরে বসে শুনেছি। কাজের লোক একটু পরে ওপরে উঠে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, ‘উনি এসেছেন।’
‘কে এসেছেন?’
‘খুব সুন্দর চেহারা, সোনার রঙের পা!’ সে বলল।
আমি হতভম্ব। আজ অবধি কারো পায়ের এই বর্ণনা শুনিনি। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘যে এসেছে সে ছেলে না মেয়ে?’
‘আজ্ঞে মেয়ে। তবে ছেলেদের মতো পোশাক পরা। মেয়েদের পোশাক পরে এলে দরজা খুলতাম না। ঐ পোশাকে কোনো মেয়েকে কখনো আমি দেখিনি, তাই বসার ঘরে বসতে দিয়েছে।’ কাজের লোক বলল।
অতএব উঠতেই হলো। কেউ নিচের ঘরের সোফায় বসে থাকলে তার সঙ্গে দেখা না করে থাকা যায় না। নিচে নেমে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে দেখলাম মেয়েটিকে। ওর পরনে জিনসের শর্টস, ওপরে উঁচু কলারের গেঞ্জি। আমাকে দেখামাত্র যেভাবে সে লাফিয়ে উঠল তাতে ওর গলা থেকে কোমর পর্যন্ত সামুদ্রিক ঢেউ দুলে উঠল।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী ব্যাপার?’
আমি দিশা, কাল মাঝরাত পর্যন্ত তোমার বই পড়েছি। সকালে মনে হলো কথা বলতেই হবে। তাই চলে এলাম। তুমি যদি বিরক্ত হও তাহলেও আমার কিছু করার নেই, সমরেশ।’ মেয়েটি তার ডান হাত বাড়িয়ে দিল।
ততক্ষণ আমার বুকের মধ্যে বাতাস ছটফট করছে। আমাদের কলেজ জীবনে কোনো মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর আপনি থেকে তুমিতে নামা খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল না। হয়তো গোটা জীবন চলে যেত কিন্তু ‘তুমি’তে নামা যেত না। এখন তো কলেজে তুমি নয়, একেবারে তুই তোকারি দিয়ে শুরু হয়। কিছুদিন ধরে শুনছি, বয়সে অনেক ছোট হওয়া সত্ত্বেও বড়দের কেউ কেউ ‘তুমি’ বলছে। তবে সে ক্ষেত্রে ‘মামু তুমিÍ’, ‘চাচা তুই’ ইত্যাদি শুনতে মন্দ লাগে না। কিন্তু একটি কুড়ি-একুশ বছরের তরুণী আমাকে শুধু তুমি নয়, সমরেশ সম্বোধন করছে, এমন অভিজ্ঞতা এর আগে হয়নি। যথাসম্ভব শান্ত থেকে বললাম, ‘বসো।’
মেয়েটি, যার নাম দিশা, সোফায় বসল। পেছনে হেলান দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বলল, ‘বইতে তোমার ডেট অব বার্থ লেখা আছে সেটা পড়ে মনে হয়েছিল তুমি একজন বৃদ্ধ মানুষ। অথচ তোমাকে না দেখলে কী ভুলই না করতাম।’
‘এখনো বৃদ্ধ দেখাচ্ছে না’ শুনলে ঈশ্বরও খুশি হতেন, আমি কোন ছার! উলটো দিকের সোফায় বসেই বুঝলাম, আমার কাজের লোক একজন সত্যি কথা বলেছে। দিশার গোড়ালি থেকে হাঁটুর অন্তত ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত দুটি পা একেবারেই নিরাবরণ। সেই পা দুটিতে সোনালি রং মাখামাখি হয়ে আছে। কাজের লোক বলেছিল, সোনার রঙের পা। ভুল বলেনি। এই প্রথম লোকটিকে একেবারে নির্বোধ মনে হলো না। নিজের অজান্তে হেসে ফেললাম।
দিশা চোখ ছোট করল, ‘হাসলে যে?’
‘না না, ও কিছু নয়। তুমি কি পড়াশুনা করছ?’
‘ইয়েস স্যার। আমি এবার থার্ড ইয়ারে। শোনো, তোমার গর্ভধারিণীর জয়িতা ফাটাফাটি, ঐ তিন বন্ধুকে কাটিয়ে যাকে ভালো করে চেনে না তার সাহায্যে মা হয়ে গেল। আমার কিন্তু একটা আপত্তি আছে।’ দিশা বলল।
‘কী রকম?’
‘আজকাল অনেক ছেলে অপারেশন করে মেয়ে হয়ে যাচ্ছে। তাহলে বিজ্ঞান কেন এখন আবিষ্কার করছে না, যাতে মা হওয়ার জন্য মেয়েদের ছেলেদের কাছে সাহায্য চাইতে না হয়! ছেলেদের বাদ দিয়েই মেয়েরা একই সঙ্গে শিশুর মা এবং বাবা হতে পারবে, সেই দিন বেশি দূরে নেই।’ দিশা হাসল।
‘সাংঘাতিক ব্যাপার!’ বললাম আমি।
‘আচ্ছা সমরেশ,’ দিশা পা পালটাল, ‘তুমি একটু ভেবে দ্যাখো, একটি পুরুষ স্রেফ আনন্দিত হওয়ার জন্য একটি নারীর সঙ্গে মিলিত হলো। তারপর সেই নারীর শরীরে সন্তান আসার পরে পুরুষটিকে কেন ঝামেলা পোয়াতে হলো না? সন্তান শরীরে আসার পর থেকে যত শারীরিক সমস্যা তা নারীকেই বহন করতে হয়। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার সময় যে যন্ত্রণা তা নারীকেই সহ্য করতে হয়। বাচ্চার জন্য মাসের পর মাস রাত জাগতে হয় নারীকেই, পুরুষকে নয়। ঐ একবার শারীরিক আনন্দ পেয়ে সারা জীবন পুরুষ নিজেকে বাবা বলে গর্ব করবে আর নারীকে সব মুখ বুজে সহ্য করতে হবেÍএটা বেশিদিন চলতে পারে না। যাকগে, শোনো সমরেশ, তোমার লেখা আমার ভালো লাগে। যদ্দিন ভালো লাগবে তদ্দিন তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে চাই। তোমার আপত্তি নেই তো?’ দিশা সোজা হলো।
‘যখন লেখা ভালো লাগবে না, তখনÍ!’ আমি কথা শেষ করলাম না।
‘তখন তোমাকে অপছন্দ করব, বন্ধুত্ব রাখব কেন? তাই অনুরোধ, আমার বন্ধু হিসেবে পাওয়ার জন্য তুমি ভালো ভালো লেখা লেখো।’ কথা শেষ করে দিশা চলে গেল।
আমি স্তম্ভিত। এই অল্পবয়সি মেয়েটি তার মতো করে একটি সত্যি কথা বলে গেল। সত্যি তো। লেখা যখন গভীরতা হারায় তখন লেখকের অস্তিত্ব কী থাকে! লেখা নষ্ট হলে লেখক তো সবই হারিয়ে ফেলেন।
লেখক : পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com