আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে স্বতন্ত্র হিসেবে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হওয়ায় জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়েছে। রবিবার (১৪ মে) আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির সম্পাদকম-লীর বৈঠকে দ্বিতীয়বারের মতো দলীয় সিদ্ধান্ত আমান্য করায় এমন সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক সূত্রমতে, গাজীপুরসহ আসন্ন পাঁচ সিটি নির্বাচন নিয়ে বৈঠকে বিস্তর আলোচনা হয়। বিশেষ করে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে আবারও দলীয় নির্দেশ ভঙ্গের বিষয়টি গুরুত্ব পায় আলোচনায়। নেতারা বলেন, জাহাঙ্গীর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে কটূক্তি করে আগে দল থেকে স্থায়ী বহিষ্কার হয়েছিলেন। পরে ক্ষমা চাওয়ায় তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু আবারও দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন, মাকেও প্রার্থী করেছেন। নিজের মনোনয়ন বাতিল হওয়ায় যে ভাষায় কথা বলেছেন, তাতে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করে নিজের মায়ের পক্ষে প্রচারণা করছেন জাহাঙ্গীর এবং দলের বিপক্ষে বিএনপির সুরে কথা বলছেন। এসব কারণে তাকে দল থেকে চিরতরে বহিষ্কার করা উচিত।
জানা গেছে, বৈঠকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম জাহাঙ্গীর আলমের বিষটি উত্থাপন করে বারবার দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য তাকে দল থেকে স্থায়ী বহিষ্কারের সুপারিশ করেন। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন সম্পাদকম-লীর অন্য সদস্যরা। বৈঠকের সিদ্ধান্ত লিখিত আকারে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানাবেন বলে চূড়ান্ত করা হয়। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, নীতি নির্ধারণী যেকোনও সিদ্ধান্ত দলের কার্যনির্বাহী বৈঠকে নেওয়া হয়। এখন সেই বৈঠক না হওয়ায় জাহাঙ্গীর আলমের বিষয়ে সম্পাদকম-লীর সুপারিশ দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক নেতা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম বলেন, ‘বৈঠকে আলোচনার পর জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়েছে। বিষয়টি দলীয় সভাপতির কাছে পাঠানো হবে। নেত্রীই তার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।’
এদিকে বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতাদের সিটি করপোরেশনের দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ প্রচারের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর আগে গত ২ মে আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমন্বয় টিমের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে টিমের প্রধান ও আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, ‘আওয়ামী লীগ জাহাঙ্গীর আলমের বিষয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না।’ বৈঠক সূত্র জানায়, জাহাঙ্গীর আলমকে দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খানের পক্ষে কাজ করতে বলা হয়েছিল। এটি না করে তিনি বিদ্রোহী হয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করছেন এবং বিএনপির সুরে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এজন্য জাহাঙ্গীরকে দল থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার নিয়ে আলোচনায় উঠে আসলেও বিষয়টি আওয়ামী লীগ সভাপতির সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। গত ১ মে গাজীপুরে মে দিবসের এক সভায় আওয়ামী লীগের সমন্বয়ক টিমের সদস্য দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন বলেছিলেন, জাহাঙ্গীর আলম যদি নৌকার পক্ষে কাজ না করে, তৃণমূলের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী শেখ হাসিনা তাকে আজীবন বহিষ্কার করতে পারেন। তিনি নৌকাকে সমর্থন না করলে জামায়াত-বিএনপির ষড়যন্ত্রকারীদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে বলে আমি মনে করি।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও নিজ জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে নিয়ে গাজীপুর সিটির তৎকালীন মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বিতর্কিত বক্তব্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এর জেরে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। পরে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। ২০১৮ সালে নৌকার টিকিটে নির্বাচিত জাহাঙ্গীর আলম মেয়র পদ থেকেও সাময়িক বরখাস্ত হন। সেই আদেশ এখনও প্রত্যাহার হয়নি।
এবার গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে নৌকার টিকিট পেয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান। তিনি গাজীপুর সিটি করপোরেশন গঠিত হওয়ার পর প্রথম নির্বাচনে (২০১৩ সাল) আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আলোচনায় আসেন জাহাঙ্গীর আলম। তখন নির্বাচনে জয়লাভ করেন বিএনপির (প্রয়াত) নেতা এম এ মান্নান। এবারের নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। তবে তার মা জায়েদা খাতুনের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। গাজীপুরে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খানের নির্বাচনি কাজ করতে ২৮ সদস্যদের টিম গঠন করা হয়েছে। এই টিমের প্রধান করা হয়েছে দলের সভাপতিম-লীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে। টিমের সমন্বয়ক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম ও উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন— গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হক। টিমের বাকি সদস্যরাও দলের সভাপতিম-লী ও সম্পাদকম-লীর সদস্য এবং নির্বাহী সদস্য। তারা আজকের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।