রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩১ অপরাহ্ন

জীবনমুখী কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ

ফারুক হোসেন শিহাব
  • আপডেট সময় শনিবার, ২০ মে, ২০২৩

আধুনিক বাংলা সাহিত্য জগতের একটি উল্লেখযোগ্য নাম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। তিনি রাজনীতিসম্পৃক্ত মানুষ ছিলেন না, কিন্তু সমাজ ও রাজনীতিসচেতন ছিলেন। তার উপন্যাস ও গল্পগুলোতে বরাবরই উঠে এসেছে প্রান্তিক মানুষদের ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং বেঁচে থাকার অপূর্ব স্পৃহা। বাংলা সাহিত্যের বিদগ্ধ এই সাহিত্যিক তার সাহিত্যকর্মে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, ধর্মের নামে প্রতারণা, মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয়, মানসিক ও চারিত্রিক স্খলন, বাংলার লোকায়ত ধ্রুপদী জীবনধারা প্রভৃতি বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। উপন্যাস এবং গল্পে সমান বিচরণের কারণে আজো তিনি সর্বস্তরে প্রশংসিত। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ কথাশিল্পী। সাহিত্য ক্ষেত্রে তার অতুলনীয় অবদান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে যেমনি অনুপ্রাণিত করেছে তেমনি বাংলা সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ।
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ আমাদের সাহিত্যের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তি। অল্প কিছু রচনা দিয়েই তিনি বাংলা সাহিত্যে তার স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছেন। তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প ও নাটকের জন্য সমাদৃত। এর বাহিরেও রয়েছে কবি, সাহিত্য সমালোচক ও সাংবাদিক সত্তা। ইউরোপীয় আধুনিকতার পরিশ্রুত রূপ দেখা যায় তার লেখায়। সাহিত্যজীবনে বিষয় কাঠামো ও ভাষা-ভঙ্গিতে নতুন এক ঘরানার জন্ম দেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। তার ক্ষুরধার লেখায় অত্যন্ত নিবিড়ভাবে তৎকালীন গ্রামীণ সমাজ জীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে। ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে ওয়ালীউল্লাহ মৃত্যু বরণ করেন। ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ ভারতের চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহরে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। তার মা নাসিম আরা খাতুন ছিলেন চট্টগ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী বংশের সন্তান, আর পিতা সৈয়দ আহমদউল্লাহ ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। ওয়ালীউল্লাহর পিতা ছিলেন নোয়াখালির অধিবাসী। তবে বাবার বদলির চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল দেখার সুযোগ পান। বিশেষ করে ওয়ালীউল্লাহর শৈশব ও শিক্ষাজীবন কেটেছে ময়মনসিংহ, ফেনী, ঢাকা, হুগলী, চূঁচুরা, কৃষ্ণনগর, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ প্রভৃতি জায়গায়।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর পরিবার ছিল উচ্চ শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনস্ক। পিতার দিক থেকে তিনি একধরনের সুফিবাদী, অসাম্প্রদায়িক ও উদার মানবতাবাদী শিক্ষা পেয়েছিলেন। তার পরিবারে ইসলামী মূল্যবোধ ও মুসলিম শিষ্টাচারের সঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়ধর্মী খাঁটি বাঙালিয়ানার কোনো বিরোধ ছিল না। খুব অল্প বয়সে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মাকে হারান। তার মায়ের মৃত্যুর পর ওয়ালীউল্লাহর পিতা পুনরায় টাঙাইলের করোটিয়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে করেন। বিমাতা ও বৈমাত্রেয় ভাই-বোনদের সাথে ওয়ালীউল্লাহর যথেষ্ট মধুর সম্পর্ক ছিল।
শিক্ষাজীবন কেটেছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ১৯৩৯ সালে কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৪৩ সালে আনন্দমোহন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাস করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হলেও শেষ করেননি।
ফেনী হাইস্কুলে ছাত্র থাকাকালেই ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত। এ সময় তিনি হাতে লেখা ‘ভোরের আলো’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র আরেকটি বিশেষ গুণ ছিলো তিনি ভালো ছবি আঁকতেন। শৈশব থেকে তিনি সাহিত্যের প্রতি যেমনি ছিলেন আগ্রহী, তেমনি চিত্রশিল্পেও আগ্রহী ছিলেন। স্কুলের হাতে লেখা ম্যাগাজিন ‘ভোরের আলো’র সমস্ত অলংকরণ ও অঙ্গসজ্জা তিনি নিজের হাতে করেছেন। তার লেখা প্রথম গল্প ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’ ঢাকা কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। ইংরেজি-বাংলা উভয় ভাষায় তার দক্ষতা ছিল। কনটেম্পোরারি নামে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন। সওগাত, মোহাম্মদী, বুলবুল, পরিচয়, অরণি, পূর্বাশা প্রভৃতি পত্রিকায়ও তার লেখা প্রকাশিত হতো।
কর্মজীবন শুরুর তিন মাস আগে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘নয়নচারা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৪৫-৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতার দৈনিক স্টেটস্ম্যান পত্রিকার সাব-এডিটর ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ওয়ালীউল্লাহ ঢাকায় এসে প্রথমে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদক ও পরে করাচি কেন্দ্রের বার্তা-সম্পাদক (১৯৫০-৫১) হন। ১৯৫১-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে নয়াদিল্লি, সিডনি, জাকার্তা ও লন্ডনে বিভিন্ন উচ্চ পদে দায?িত্ব পালন করেন। ১৯৬০-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্যারিসে পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ছিলেন।
১৯৬৭ সালে দূতাবাসের চাকরি ছেড়ে ওয়ালীউল্লাহ চুক্তিভিত্তিক প্রোগ্রাম স্পেশালিষ্ট পদে যোগ দেন প্যারিসের ইউনেস্কো সদর দফতরে। ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইউনেস্কোতে তার চাকরির মেয়াদ শেষ হয়েছিল। অবসর গ্রহণের নিয়ম হিসেবে পাকিস্তান সরকার তাকে ইসলামাবাদে বদলি করে। কিন্তু তিনি প্যারিসেই থেকে যান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার চালান এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে ফরাসি একাডেমির সদস্য পিয়ের এমানুয়েল, আদ্রে মারলো প্রমুখ বুদ্ধিজীবীর সহযোগিতায় বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে সাধ্যমত অনুদান পাঠিয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালে তিনি ‘লালসালু’ নামের উপন্যাস লেখায় হাত দেন এবং পরের বছর ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসে ঢাকা থেকে কমরেড পাবলিশার্স উপন্যাসটি প্রকাশ করে। উপন্যাসটি ১৯৬০ সালে কলিমুল্লাহ কর্তৃক উর্দু ভাষায় অনুবাদিত হয়ে ‘খধষ ঝযধষঁ’ নামে করাচি থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৬১ সালে ফরাসি ভাষায় ও ১৯৬৭ সালে ইংরেজি ভাষায় এবং পরবর্তীতে জার্মান, চেক সহ বিভিন্ন ভাষায় উপন্যাসটি অনুবাদিত হয়।
উপন্যাসটি তৎকালীন গ্রামীণ মুসলমান সমাজের মানসিকতার এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’ তে তৎকালীন সমাজের ধর্মীয় গোঁড়ামির মর্মমূলে কঠোরভাবে আঘাত করেছেন। তার এই উপন্যাসের পটভূমি গ্রামীণ সমাজ; বিষয় সামাজিক রীতি-নীতি ও প্রচলিত ধারণা বিশ্বাস; চরিত্রসমূহ একদিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মভীরু, শোষিত, দরিদ্র, গ্রামবাসী অন্যদিকে শঠ, প্রতারক, ধর্মব্যবসায়ী ও শোষক-ভূস্বামী। তিনি একদিকে যেমন সমাজের মানুষের ভ-ামির চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তেমনি অন্যদিকে গ্রাম বাংলার সহজ সরল মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির চিত্রও ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহর অনবদ্য আরেক উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’। নিজের ভেতর লালন করা ন্যায়বোধের সাথে নিজের যে লড়াই হয়, সে লড়াইয়ে সামাজিক প্রতিপ্রত্তি কতোটা প্রভাব বিস্তার করে তার অসাধারণ এক আখ্যান ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসটি। যেখানে গভীর অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণে আপাদ বিশ্বাসকে যুক্তির আঘাতে ভেঙ্গে দিয়ে প্রকৃত সত্যকে আবিষ্কার করেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ।
যার মধ্য দিয়ে সমাজের বাস্তব রূপটিই ফুটে ওঠে। একইভাবে ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তার ‘কাঁদো নদী কাঁদো’উপন্যাসে সামাজিক বাস্তবতায় ব্যক্তির অস্তিত্ব সংকট কিভাবে প্রকট হয়ে ওঠে- সেটিকে তিনি যেমনিভাবে দেখিয়েছেন, তেমনি সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে আত্মমুক্তির পথও খুঁজেছেন শিল্পের অনবদ্য রসায়নে।
তাা উপন্যাসের বিষয়বস্তু, উপস্থাপন ও ভাষশৈলী আধুনিক বাংলা সাহিত্যে একটি স্বাতন্ত্রিক ধারা তৈরি করেছে। বাঙালি মুসলমানকে তিনি একটি অবহেলিত জনগোষ্ঠী হিসেবে দেখতেন, কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে নয়। তাদের মানবিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আদায়ে তিনি ছিলেন সচেষ্ট। তবে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ও সাম্প্রদায়িকতাকে তিনি ঘৃণার চোখে দেখতেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ছিলেন সমাজ ও রাজনীতি সচেতন লেখক। তার লেখালেখিতে সেই ছাপই পাওয়া যায়। ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। এই নতুন যুগ ওয়ালীউল্লাহকে ভীষণভাবে আশান্বিত করেছিল। মার্কিনী ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ভূমিকার তিনি প্রশংসা করতেন। কিন্তু চীন ও রাশিয়ার মধ্যকার মতপার্থক্য তাকে হতাশ করেছিল। তিনি ৩২টি কাহিনি রচনা করেছেন যা কোনও বইয়ে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি নাটকগুলিতেও যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে- উপন্যাস- লালসালু (১৯৪৯), চাঁদের অমাবস্যা (১৯৬৪) ও কাঁদো নদী কাঁদো (১৯৬৮)। ছোটগল্প- নয়নচারা (১৯৪৫) এবং দুই তীর ও অন্যান্য গল্প (১৯৬৫)। নাটক- বহিপীর (১৯৬০), তরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৫) ও সুড়ঙ্গ (১৯৬৪)। রচনাবলী- গল্প-সমগ্র (১৯৭২, কলকাতা) এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-রচনাবলী- ১, ২ (সম্পা. সৈয়দ আকরাম হোসেন, ১৯৮৬ ও ১৯৮৭)।
তিনি জীবদ্দশায় ও মরণোত্তর অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- একুশে পদক (মরণোত্তর, ১৯৮৪), ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প’র জন্য আদমজী পুরস্কার (১৯৬৫), উপন্যাসে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬১) এবং ‘বহিপীর’ নাটকের জন্য পিইএন পুরস্কার (১৯৫৫)। ১৯৫৫ সালে তিনি ফরাসী নারী আন্-মারি লুই রোজিতা মার্সেল তিবো বা আজিজা মোসাম্মত নাসরিনকে বিয়ে করেন। তিনি আন মারী নামেই বেশি পরিচিত। তাদের দুই সন্তান- মেয়ে সিমিন ওয়ালীউল্লাহ ও ছেলে ইরাজ ওয়ালীউল্লাহ। ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে গভীর রাতে অধ্যয়নরত অবস্থায় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে অকালে প্রয়াত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মৃত্যু হয়।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com