রস্কের সুলতান বায়েজিদের দরবার। সেখানে নাসির উদ্দীন হোজ্জা নামে এক মজার লোক ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী ও প-িত। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধির কথা সবাই জানে।
একবার নাসির উদ্দীন হোজ্জার কিছু অর্থের প্রয়োজন হলো। নিজের কাছে অত টাকা নেই। বন্ধুদের কাছ থেকেও ধার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। নিরুপায় হোজ্জা আল্লাহ্র ওপর ভরসা করলেন।
ফজর নামায পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করলেন। তারপর জায়নামাযে বসে আল্লাহ্র দরবারে দু’হাত তুললেন। কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘হে আল্লাহ্! রহমান রহিম। তুমি এ জগতের মালিক। তোমার দরবারে ধন সম্পদের কোন অভাব নেই। আমি আজ অভাবে পড়ে তোমার দরবারে হাত তুলেছি। তুমি আমাকে নয় হাজার নয় শত নিরানব্বই টাকা দান কর। আমি এর চেয়ে এক টাকা কম বা বেশি নেব না। ঠিক নয় হাজার নয় শত নিরানব্বই টাকাই চাই।
নাসির উদ্দীন হোজ্জার প্রতিবেশী ছিল এক ধনী ইহুদি। হাড়কিপটে কৃপণ। সুদের ওপর টাকা খাটিয়ে ধনী হয়েছে। বেচারা হোজ্জা বহুবার বিপদে পড়ে তার কাছে হাত পেতেছে, কিন্তু কখনো একটি টাকা ধার পায়নি।
কাকডাকা ভোরে ইহুদি লোকটি হোজ্জার কান্নাকাটি শুনতে পেল। ইহুদি লোকটি মনে মনে ভাবল, হোজ্জাকে পরীক্ষা করার এই তো সময়। দেরি না করে নিজ ঘর থেকে দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি একটি থলে নিয়ে এলো। চুপিচুপি জানালার ফাঁক দিয়ে তা হোজ্জার সামনে ছুঁড়ে মারল।
হোজ্জা খুশিতে আটখানা হয়ে সব মুদ্রাগুলো জড়ো করলেন। গুনে দেখেন পুরোপুরি দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা।
আল্লাহ্র দরবারে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, ‘হে অফুরন্ত ধন ভা-ারের মালিক, তোমার করুণা অসীম। আমি চেয়েছিলাম মাত্র নয় হাজার নয়শত নিরানব্বই টাকা, আমাকে দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছ। আমি সানন্দে তোমার দান গ্রহণ করলাম। তুমি কত মহান, কত বড় দয়ালু!’
জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা ইহুদি নাসির উদ্দীন হোজ্জার মুনাজাত শুনে চমকে উঠল। ভাবল, হোজ্জার মতলব তো দেখছি ভালো নয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, স্বর্ণমুদ্রাগুলো নিয়ে নিতে পারলেই প্রাণে বাঁচি।
ইহুদি লোকটি নাসির উদ্দীন হোজ্জার ঘরে গেল। বলল, আমার মস্ত বড় ভুল হয়েছে হোজ্জা সাহেব। স্বর্ণমুদ্রাগুলো তাড়াতাড়ি দিয়ে দিন। আপনাকে পরীক্ষা করার জন্যই আমি জানালা দিয়ে এগুলো ছুড়ে ফেলেছি। দিয়ে দিন তাড়াতাড়ি।
নাসির উদ্দীন হোজ্জা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, কোন মুদ্রা? কিসের মুদ্রা?
ইহুদি আবার বলল, কেন? কেন, এই মাত্র আমি জানালা দিয়ে আপনার সামনে দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা ছুড়ে ফেলেছি।
হোজ্জা রাগত স্বরে বললেন, বাজে বকোনা এখানে। কানা-খোঁড়াকেও ভুলে কোনদিন একটি পয়সা দাওনি, আর আমাকে না চাইতেই দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দেবে? যাও যাও, আপন পথ ধর।
ইহুদির মাথায় যেন বজ্রাঘাত পড়ল। সে নিরুপায় হয়ে কাজীর দরবারে নাসির উদ্দীন হোজ্জার বিরুদ্ধে নালিশ করতে চাইল। নিয়ম ছিল কাজীর দরবারে যার বিরুদ্ধে নালিশ করবে তাকেও সাথে যেতে হয়। ইহুদি হোজ্জাকে কাজীর দরবারে যেতে বলল। তিনি বললেন, ‘আমি ময়লা পোশাক পরে কাজীর দরবারে যেতে পারব না। এতে আমার মর্যাদার হানি হবে।’ অগত্যা ইহুদি বাড়ি গিয়ে নিজের জমকালো জরির পোশাকটি নিয়ে এল।
হোজ্জা এবার নতুন বায়না ধরলেন। বললেন, ‘কাল থেকে আমার পা দু’টি ব্যথায় টনটন করছে। অতদূরে আমি হেঁটে যেতে পারব না। ঘোড়া-টোড়া থাকলে না হয় যাওয়া যেত।’
ইহুদি তখন নিজের ঘোড়াটি সাজিয়ে নিয়ে এল। বিনয়ের সাথে হোজ্জাকে বলল, ‘আপনার আর কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। দয়া করে এবার চলুন।’
নাসির উদ্দীন হোজ্জা জমকালো জরির পোশাকটি পরলেন। মাথায় পাগড়ি বাঁধলেন। এরপর ইহুদির দামি ঘোড়ায় চড়ে কাজীর দরবারে হাজির হলেন।
ইহুদি কাজীর দরবারে হোজ্জার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মামলা দায়ের করল। কাজী সাহেব হোজ্জার বক্তব্য শুনতে চাইলেন।
হোজ্জা বললেন, ‘লোকটি আমার প্রতিবেশী বদ্ধ পাগল। সে কখন, কাকে, কি বলে তার কোন ঠিক নেই। শুধু শুধু কেউ কখনো কাউকে দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে দেয়? আপনি দেখবেন, সে হয়ত এক্ষুনি বলে বসবে, আমার পরনের এই দামি জরির পোশাকটিও তার।’
ইহুদি চমকে উঠে বলল, কী বললেন? এই পোশাকটি কি আমার নয়? কাজীর দরবারে আসার জন্য কি এটি চেয়ে নেননি?
নাসির উদ্দীন হোজ্জা হা হা করে হেসে উঠলেন। আবার বললেন, দেখলেন হুজুর! পাগল আর কাকে বলে? ঐ যে মাঠে আমার ঘোড়াটি ঘাস খাচ্ছে, হয়ত সে বলে বসবে ওটিও তার।’
ইহুদি বিস্মিত হয়ে বলল, ‘আপনি একি বলছেন, এই ঘোড়াটি কি আমার নয়? কাজীর দরবারে আসার জন্য আমি কি আপনাকে এটি ধার দেইনি?’
কাজী সাহেব ইহুদিকে পাগল বলে রায় দিলেন। প্রহরীকে নির্দেশ দিলেন, তাকে পাগলা গারদে বন্দী করে রাখতে।
এমন সময় নাসির উদ্দীন হোজ্জা উদারতা দেখিয়ে বললেন, থাক হুজুর থাক, ওকে পাগলা গারদে পাঠিয়ে লাভ নেই। আমিই তাকে নিয়ে যাই। আহা বেচারা, পাগলা গারদে বন্দী হলে যে তার ছেলে মেয়ে খুব কান্নাকাটি করবে। ওদেরকে তো আমাকেই দেখতে হয়।’
এই বলে ইহুদিকে সাথে নিয়ে হোজ্জা বাড়ির পথে পা বাড়ালেন।