নতুন কারিকুলামে শিখন পাঠ ও ষান্মমাসিক মূল্যায়ন নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। অভিভাবকদের অভিযোগ ক্লাসের গ্রুপভিত্তিক শিখন কৌশলে পিছিয়ে পড়ছে দুর্বল শিক্ষার্থীরা। একইসাথে নির্দিষ্ট প্রশ্ন কাঠামো না থাকায় মুল্যায়ন প্রস্তুতিতেও স্কুলে কিংবা বাসাবাড়িতে কোথাও লেখাপড়ায় মনোযোগী হচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। ফলে অপেক্ষাকৃত বেশি মেধাবীরা পড়াশোনায় মন বসালেও মেধায় দুর্বল শিক্ষার্থীরা পড়াশোনায় আরো পিছিয়ে পড়ছে।
অন্যদিকে ঈদের আগেই শেষ হচ্ছে নতুন কারিকুলামের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ষান্মাসিক মূল্যায়ন। গত ৭ জুন থেকে শুরু হয়েছে এই মূল্যায়ন। মূল্যায়নে পরীক্ষার হলে গ্রুপভিত্তিক কাজের ফলাফলের আলোকে শিক্ষার্থীদের মেধার যাচাই করা হচ্ছে। আগের পরীক্ষার পদ্ধতির আলোকে এবার মূল্যায়ন হচ্ছে না। গতানুগতিক ১০০ নম্বরের পরীক্ষাও এটা নয়। মুল্যায়নে শিক্ষার্থীদের কাজের বা পারফমেন্সের ওপর ভিত্তি করে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হচ্ছে। খুবই ভাল যারা করতে পারছে তাদেরকে ত্রিভুজ চিহ্ন দিয়ে মূল্যায়ন, মোটামুটি ভাল তাদেরকে বৃত্ত আর অতিরিক্ত যতœ নিয়ে আরো ভাল যাদের করতে হবে তাদেরকে চতুর্ভুজ দিয়ে চিহ্নিত করা হচ্ছে। অনেক অভিভাবক বাচ্চাদের এই মূল্যায়নের পদ্ধতিতে সন্তুষ্ট নন। নতুন এই মূল্যায়ন পদ্ধতিতে তারা ত্রিভুজ আর বৃত্তের গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে গেছেন।
এদিকে নতুন কারিকুলাম আর মূল্যায়ন পদ্ধতি যথাযথভাবে বাস্তবায়নে বছরের শুরু থেকেই তাগিদ দিচ্ছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর মাউশি। একই সাথে নতুন পদ্ধতির এ মূল্যায়নের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষকদের জন্য বিষয়ভিত্তিক গাইডলাইনও প্রকাশ করেছে।
অন্যদিকে অনলাইনে ওরিয়েন্টেশন কোর্স সম্পন্ন করার জন্য তাগিদ দিয়েছে মাউশি। তবে বাস্তবে অধিকাংশ শিক্ষকই এসব কোর্স বা গাইডলাইন আয়ত্ত করতে পারেননি বলে জানা গেছে। যে কারণে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকদের ইচ্ছামতোই মূল্যায়ন কার্যক্রম চলছে। এ নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে শিক্ষকরা পুরোপুরি দক্ষ না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা এর সুফল পাবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
মাউশি ও এনসিটিবির নির্দেশনা বিষয়ে বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সরকারি একটি স্কুলের শিক্ষক জানান, অনলাইন কোর্স করার কথা বলা হলেও অনেকেই এই কোর্স করেননি। যারা করেছেন তারাও ঠিকমতো না বুঝেই বা অন্যকে দিয়ে কোর্স সম্পন্ন করে সার্টিফিকেট নিয়েছেন। তাছাড়া মূল্যায়নের যে গাইডলাইন দেয়া হয়েছে তাও অনেক শিক্ষক ডাউনলোড দেননি বা আয়ত্ত করতে পারেননি। তাই শিক্ষকদের অনেকে দায়সারাভাবেই এই মূল্যায়ন করছেন।
তিনি আরো জানান, নতুন কারিকুলামের প্রশিক্ষণের সময় এর মূল্যায়নের জন্য একটি অ্যাপস দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা দেয়া হয়নি। এখন মূল্যায়ন তথ্য সংরক্ষণ করা নিয়ে শিক্ষকদের বিপাকে পড়তে হবে। তাছাড়া অনেকে ধারাবাহিক মূল্যায়নই করেননি। তাই সার্বিকভাবে নতুন কারিকুলামের সুফল পাওয়া অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
এদিকে রাজধানীর একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে জানা গেছে, তিন ঘণ্টা সময় ধরে ক্লাসে বসিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে দু’পাতা কাগজ দিয়ে যা ইচ্ছা লিখতে বলা হয়। এছাড়া আরো কিছু কাজ দেয়া হয়। এসব কাজ করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা অনেকটাই হৈ হুল্লোড় করে সময় পার করে। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে পরীক্ষাভীতি কেটে গেলেও শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। তাছাড়া পরীক্ষার সময়েও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গ্রুপ ওয়ার্ক চলছে। আর এসব গ্রুপ ওয়ার্ক কোথায় করা হবে তা নিয়ে বিপাকে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। অনেকে বাসায় গিয়ে গ্রুপ ওয়ার্ক করছে বলে জানা গেছে।
মূল্যায়ন বিষয়ে একজন অভিভাবক জানান, পরীক্ষা শেষে বাচ্চারা সবাই হাসিমুখে হল থেকে বের হচ্ছিল। সবাই বলছিল পরীক্ষা খুবই ভালো হয়েছে কিছুই লিখতে হয়নি। ওদের অবস্থা দেখে এত কষ্ট হচ্ছিল যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। ওরা তো আসলে জানে না ওদের কত বড় ক্ষতি হচ্ছে। এইভাবে বাচ্চাদের মেধাকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে কি না সেই প্রশ্নও রাখেন এই অভিভাবক।
নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা সত্যিকার অর্থেই পিছিয়ে পড়ছে না সেই প্রশ্নও মাথায় রাখা হয়েছে। তাই পরিস্থিতি বিবেচনায় পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে ক্লাস রুটিনে লার্নিং লস বা রেমিডিয়াল (সংশোধনমূলক শিখন) ক্লাস করানোর কথা ভাবা হচ্ছে। এক্ষেত্রে যারা পিছিয়ে পড়ছে তাদের চিহ্নিত করে আলাদাভাবে ক্লাস করানোর দায়িত্ব শ্রেণি শিক্ষকদের। সেটি করলে কেউ পিছিয়ে পড়বে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীর একটি স্কুলের ক্লাসের কার্যক্রম মনিটরিং করে দেখা গেছে, প্রতি ক্লাসের নতুন কারিকুলামের পাঠ দানে গ্রুপ করে দেয়া হয়েছে। গ্রুপে আটজন করে থাকলেও প্রোজেক্ট তৈরির কাজ সবাই করতে চায় না। কেউ কেউ বুঝতে পারে না, কেউ আবার ফাঁকি দেয়। দলে আটজন থাকলেও চার-পাঁচজন অ্যাসাইন্টমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, পোস্টার তৈরি, নাটক, উপস্থাপনাসহ নানা ধরনের কাজ দেন শিক্ষকরা।
এসব কাজ গ্রুপ লিডারের নেতৃত্বে সবাই মিলে করার কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। দলের কেউ কেউ বুঝতে না পেরে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকে। কেউ কেউ আবার ইচ্ছা করে টিমওয়ার্ক করতে চায় না। ক্লাস শিক্ষকদের কাছে অভিযোগ করলেও তারা এসব বিষয় নিয়ে তেমনভাবে কাউকে কিছু বলেন না।
জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান শিক্ষার্থীরদের নতুন এই পাঠ পদ্ধতি বিষয়ে বলেন, দুটি কারণে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়তে পারে। শিক্ষকরা ঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে না পারলে ও সঠিকভাবে বুঝতে না পারলে কোনো কোনো শিক্ষার্থী পিছিয়ে পড়তে পারে। গ্রুপওয়ার্কে সবাই একই রোল প্লে করবে, বিষয়টি আসলে তা নয়। শিক্ষকরা মৌখিকভাবে রোল ডিফাইন করে না দিলে বোঝাপড়ার গ্যাপ তৈরি হয়। সবাই একসাথে প্রেজেন্টেশন দেবে না। প্রেজেন্টেশন তৈরিতে কে কী করবে সেটি আগে থেকে নির্দেশনা দেবেন শিক্ষক।
তিনি আরো বলেন, এসব বিষয় যেহেতু চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে এটি একটি ভালো দিক। পরবর্তীসময়ে এসব বিষয়ে নতুন নির্দেশনা দেয়া যাবে। এতে শিক্ষার্থীরা আর কেউ ইনঅ্যাকটিভ থাকবে না।
এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, শিক্ষার্থীদের যেভাবে গ্রুপ করে ভাগ করার কথা সেভাবে করলে কেউ পিছিয়ে পড়ার কথা নয়। শিক্ষকরা যদি ভালো শিক্ষার্থীদের দিয়ে সব করাতে চান তবে অন্যরা পিছিয়ে পড়বে। ক্লাসে যখন শিক্ষার্থীরা কাজ করবে তখন শিক্ষকরা ঘুরে ঘুরে দেখবে সবাই তাতে অংশ নিচ্ছে কি না। কে কোথায় পার্টিসিপেট করছে বা করছে না সেটি দেখার দায়িত্ব শিক্ষকদের। এমনটা হলে শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে সেটি বুঝিয়ে কাজের সমবণ্টন করে দিতে হবে।