লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার রামগতি বাজার খালের দু’পাড় দখল করে বহুতল মার্কেট, দোকানঘর ও আবাসিক ভবন নির্মাণ করেছেন প্রায় ৬ শতাধিক প্রভাবশালীরা। একসময় এ খাল দিয়ে মহাজনি নৌকা চলাচল করলেও খালটির রামগতি বাজার এলাকার এক কিলামিটার অংশ ওইসব দখলদারদের কারণে এখন অস্তিত্ব বিলীনের পথে। এতে করে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি সহ স্থানীয়রা দুর্ভোগ পোহানোর পাশাপাশি কৃষকরা অনেক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি অফিস কয়েকবার দখলদারদের তালিকা করে উপজেলা ভূমি অফিসে প্রেরণ করলেও কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়নি সংশ্লিষ্ট অফিসটি।ইতোমধ্যে সরজমিন পরিদর্শন কর ৬ শতাধিক দখলদারের তালিকা তৈরি করেছেন স্থানীয় ভূমি অফিস। স্থানীয়রা খালটি দখলমুক্ত করে জলাবদ্ধতা নিরসনের দাবি জানিয়ে আসলেও কার্যকর কোন প্রদক্ষেপ নেননি তারা। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সত্তর দশকে উপজেলার রামগতি বাজারের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এ খালটি চরগাজী ও বড়খেরী ইউনিয়নের কৃষকদের সুবিধার্থে এবং জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষে খালটি খনন করা হয়। ৪০ ফুট প্রশস্থ এ খালটি মেঘনা নদীতে গিয়ে মিলিত হয়। দু’টি ইউনিয়নের কয়েক হাজার কৃষকদের ইরি ধান চাষাবাদের জন্য প্রয়াজনীয় পানি ধরে রাখা ও ছাড় দেওয়ার সুবিধার্থে খালের শেষ মাথা মেঘনা নদীর সাথে মিলানো হয়। নব্বই দশকের শেষের দিকে খালটি ধীরে ধীরে প্রভাবশালীদের থাবায় দখল-দূষণ অস্তিত্ব হারাতে শুরু করে। বর্তমানে খালটির রামগতি বাজারের উপরের অংশ পুরাপুরি দখল হয়ে গেছে। প্রভাবশালীরা খালের দু’পাড় দখল করে বহুতল মার্কট, দাকানঘর ও আবাসিক ভবনের পাশাপাশি নির্মাণ করেছেন ব্যক্তিগত কয়েকটি বক্সকালভার্টও। বর্তমানে খালের নাম নিশানাটুকুও রাখা হয়নি। শুধু তাই নয় বেশ-কয়েকটি স্পটে রামগতি বাজারের প্রতিদিনের বর্জ্য নিয়মিত খালে পেলে ভরাট করা হয়। ভরাট করে তা দখল করার পায়তারা চালাচ্ছেন আরেকটি চক্র। সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, রামগতি বাজার খালের উপর জননী টেলিকম, বিসমিল্লাহ হোটেল, সৌদিয়া বস্ত্র বিতান, সুমাইয়া হোটেল, সোহেল ইলেকট্রনিক্স, মা ক্রোকারিজ ,রফরফ স্টোর, অপরুপ হোন্ডা সার্ভিসিং সেন্টার ও মেঘনা স্টুডিও সহ প্রায় ৬ শতাধিক দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। এসব দোকান ও মার্কেটগুলো ভাড়ায় চলে আসছে। প্রতি মাসে এসব দোকান থেকে কয়েক লাখ টাকা ভাড়া আদায় করছেন দখলদাররা। আর এ ভাড়ার একটা অংশ যাচ্ছে জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে। এমনটাই জানিয়েছেন কয়েকটি সুত্র। স্থানীয়রা জানান, খালটি দখলের কবলে পড়ে পানি নিস্কাশনের পথ আটকে যাওয়ার কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এ অঞ্চলের কয়েক হাজার কৃষকের ফসল উৎপাদন চরম হুমকিতে রয়েছে। স্থানীয় কৃষক মোস্তাফা,আবুল কালাম, হাজী গোলার রহমান জানান, এক সময় এ অঞ্চলের কয়েক হাজার কৃষকের জমির পানি খালটি দিয়ে মেঘনা নদীতে যেতো। তাঁদের কৃষি জমির পানি নিস্কাশনের একমাত্র ভরসা ছিল এ খাল। অথচ, খালটির এক কিলোমিটার এলাকা দখলদাররা ভরাট করে ফেলায় বর্ষা এলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।এতে কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। যার কারণে, তাঁরা অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করে খালটি পুনঃরুদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন। স্থানীয় ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, রামগতি বাজার খাল দখল করে নিয়েছেন, এমন ৬০০ জন দখলদারদের চিহ্নিত করে ইতোমধ্যে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন জনপ্রতিনিধি জানান, রামগতি বাজার খালের দু’পাড়ের এক কিলামিটারের মধ্যে গড়ে ওঠা প্রায় ৬ শতাধিক দোকানঘর থেকে মাসিক চাঁদা তোলা হয়। চাঁদার একটা অংশ স্থানীয় রাজনৈতিক দলের বিশেষ নেতা, জনপ্রতিনিধি, ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও উপজেলা ভূমি অফিসকে দেওয়া হয়। যার কারণে শুধু দখলদারদের তালিকা করেই কাজ শেষ করেন তারা। অদৃশ্য শক্তির কারণে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছেনা তারা। এখানের একেকটি দোকান ভিটির মূল্য কোটি টাকারও বেশী। যে কারণে কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করার কথা বললেও রহস্যজন কারণে তা বারবার আটকে যায়। ক্ষোভ প্রকাশ করে রামগতি বাজারের মোঃ দেলোয়ার মিয়া, ফিরোজ আলম ও রাসেদুল ইসলাম বলেন, শুনেছি ভূমি অফিস শুধু তালিকাই করেন। উচ্ছেদ করার কোন আলামত দেখা যাচ্ছেনা। অদৃশ্য নানা কারণে সবকিছু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আব্দুল বাসেত চৌধুরী নামের এক দখলদার জানান,তাদের জায়গার উপর দিয়ে খাল খনন করা হয়েছে। তাই তারা খাল দখল করে এখানে দোকান নির্মাণ করেছেন। ডাঃ নাছির ও হাজী মাঈন উদ্দীন নামের আরো দুই জন দখলদার বলেন, তাদের দোকানের কিছু অংশ খালের উপর পড়েছে। সরকার চাইলে তারা খালের জায়গা ছেড়ে দিবেন। তবে এখন পর্যন্ত সরকার বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন ধরনের নোটিশ বা নির্দেশনা পাননি বলে জানান তারা। বড়খেরী ইউনিয়ন ভূূমি অফিসের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা সানাউল্লাহ জানান, বড়খেরী ও চরগাজী ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ রামগতি বাজার খালের দু’পাড় দখল হয়ে যাওয়ায় খালটি উদ্ধারে কয়েকবার তালিকা তৈরী করে সংশ্লিষ্টদের নিকট পাঠানো হয়েছে। উর্ধতন কর্মকর্তারা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করলে আমরা সার্বিক সহযোগীতা করতে প্রস্তুুত রয়েছি। রামগতি উপজলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আমজাদ হোসেন জানান, রামগতি বাজার খালের দু’পাড়র দখলদারদের চিহ্নিত করে তাঁদের উচ্ছেদ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। খালটি উদ্ধারে খুব শিগগিরই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হব। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম শান্তনু চৌধুরী বলেন, যতবড় শক্তিশালী হউক না কেন, কোন দখলবাজদের ছাড় দেওয়া হবেনা। সরকারি খাল দখলমুক্ত করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। এব্যাপারে তিনি সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।