কুমিল্লা থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছেন করিম। বর্তমানে তিনি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসাধীন। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিছানায় বিমর্ষ অবস্থায় শুয়ে আছেন তিনি। তার পেটে প্রচ- ব্যথা। আশপাশে তাকিয়ে তেমন কোনও চিকিৎসককে দেখা যায়নি তার চিকিৎসার বিষয়ে কথা বলার জন্য।
জানতে চাইলে কর্তব্যরত নার্স জানান, চিকিৎসক এলে বলতে পারবেন। চিকিৎসক কখন আসবেন, প্রশ্ন করলে নার্স বলেন, ‘আসবে, অপেক্ষা করেন।’ সেই অপেক্ষা অন্তত দুই ঘণ্টা হলো কিন্তু চিকিৎসকের দেখা মিললো না।
ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রাইভেট ট্রেইনি চিকিৎসকরা। আর তার প্রভাব পড়েছে চিকিৎসাসেবায়। বিশেষ করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এর প্রভাব বেশি, কারণ হাসপাতালের অধিকাংশ চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকরা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। এতে প্রচ- চাপের মধ্যে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন সিনিয়র চিকিৎসকরা। সংখ্যায় কম হওয়ায় হিমশিম খাচ্ছেন তারা। তাই রোগীরাও পাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চারটি মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তির অর্ধেকই ডেঙ্গু রোগী। হাসপাতালের নতুন ভবনের প ম থেকে অষ্টম তলা পর্যন্ত প্রতিটি তলায় ডেঙ্গু রোগীতে সয়লাব। ওয়ার্ড ছাড়িয়ে রোগীদের জায়গা হয়েছে খোলা জায়গার মেঝেতে, সিঁড়ির খোলা অংশে, বাথরুমের পাশে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দুই শতাধিক ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন আছে। ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ৪৬০ জন ট্রেইনি চিকিৎসক প্রতিদিন দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মোট ট্রেইনি চিকিৎসক রয়েছেন দেড় হাজারের মতো। এসব চিকিৎসকের অর্ধেকের বেশি এসব রোগীর চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। এই বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক ছাড়া হাসপাতালে একধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত গাইডলাইন অনুযায়ী দুই ঘণ্টা পরপর তাদের ফলোআপ করতে হয়, কিন্তু যে পরিমাণ চিকিৎসক ও নার্স রয়েছেন, তাদের পক্ষে এটা সম্ভব হচ্ছে না। সিঁড়িতে, কিংবা ফ্লোরে যে রোগী আছেন, তিনি এমনিতেই হাইপো হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, ইন্টার্ন চিকিৎসকরা বর্তমানে ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট করছেন। অথচ একটি হাসপাতালের মূল চালিকাশক্তিই তারা, হাসপাতালের ৮০ শতাংশ চিকিৎসা চলে তাদের মাধ্যমে। আর এ অবস্থায় রোগীদের সঠিক চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে এক দুরূহ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঢামেক হাসপাতালে লালবাগের বাসিন্দা মাকসুদা বেগম বলেন, ১০ বছরের ছোট ছেলে ডেঙ্গু আক্রান্ত। শনিবার সকালে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। সারা দিন অপেক্ষা করে চিকিৎসকের দেখা পাইনি। একজন নার্স রিপোর্ট দেখে নিশ্চিত হন ডেঙ্গু হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি হলেও শনিবার দুপুর পর্যন্ত তার কোনও চিকিৎসা দেওয়া হয়নি।
এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে এখন পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে ২ হাজার ৭৭৪ জন আর বর্তমানে ভর্তি রয়েছে ৪১৪ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রোগী ভর্তি হয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এ হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৫১ জন আর বর্তমানে ভর্তি রয়েছে ২২১ জন।
আন্দোলনরত চিকিৎসকরা জানান, আমাদের এই আন্দোলন দুই বছর আগে শুরু হয়, যদিও পুরোটা সময় সক্রিয়ভাবে না হলেও ছয় মাস ধরে আমরা সক্রিয়ভাবে জানিয়ে আসছি। যখন দেখছি কেউ আমলে নিচ্ছে না, আমাদের কাছে মনে হয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া এখন আর সম্ভব না। এ জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কর্মবিরতিতে যাচ্ছি।
চিকিৎসকরা জানান, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি নিতে সময় লাগে পাঁচ বছর। এখানে বেসরকারি প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকদের ভাতা দেওয়া হয় মাত্র ২০ হাজার টাকা। এর বাইরে বোনাসসহ অন্য কোনও সুবিধা নেই। নেই কোনও ইনক্রিমেন্ট। অথচ মেডিক্যালের বেশির ভাগ সেবাই আমাদের দিতে হচ্ছে।
হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত করে আন্দোলনে যাওয়া যৌক্তিক কি না এমন প্রশ্নের জবাবে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রাইভেট ট্রেইনি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডা মো. নুরুন্নবী বলেন, কোনও চিকিৎসকই রোগীদের চিকিৎসাসেবা থেকে বি ত করতে চান না। কিন্তু চিকিৎসকরা যদি অর্থের অভাবে থাকেন, তাহলে সেবা দেবেন কীভাবে। আমরা তো দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি ভাতা বৃদ্ধি করার কথা। প্রতিটি জায়গায় আমরা বলেছি, কিন্তু আমাদের কথা কেউ কর্ণপাত করেনি। এর আগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল ইসলাম বলেন, চিকিৎসকরা কর্মবিরতিতে গেলে আমাদের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হবে। আমাদের জনবল অর্ধেক হয়ে যাবে হাসপাতালে। এখন যেভাবে চিকিৎসা দিচ্ছি, তখন সেভাবে সেবা দেওয়া ব্যাহত হবে। কর্মবিরতিতে চিকিৎসা দিতে সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানিয়েছি।