চা, কফি ও ট্যাবলেট খেয়েই স্লিম হতে চেয়ে ধরা খাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। যারা এসব বিক্রি করছেন, তাদের দাবি— তাদের প্রোডাক্ট এক্সট্রা ফ্যাট বার্ন করে ওজন কমাতে সহায়ক এবং কোনও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া নেই। যদিও গত নভেম্বর মাস থেকে এই প্রোডাক্টগুলো ব্যবহার করেছেন— এমন একাধিক ব্যক্তি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাওয়া, এক কেজিও ওজন না কমার মতো অভিজ্ঞতাগুলোর কথা বলেছেন। আর চিকিৎসকরা বলছেন, অনলাইনে ‘ইমোশোনাল ফুল’ খুঁজে ব্যবসা করছে একশ্রেণীর প্রতারক। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
কেন ‘ইমোশোনাল ফুল’: বিজ্ঞাপনের ভাষার কারণেই ফেসবুক ঘাটতে গিয়ে এসব প্রতারকের ফাঁদে পড়ছেন নারীরা। সদ্য মা হওয়া নারীদের মধ্যে সাধারণত এক ধরনের হীনম্মন্যতা তৈরি হয়, শরীরের বাড়তি মেদ নিয়ে। ‘বাবু হওয়ার পর অনেকের শরীরে হঠাৎ করে ওজনটা বেড়ে যায়। ওজন কমাতে পারে না বিভিন্ন রকম চেষ্টা করার পরেও। এখন কোনও রকম ডায়েট, কিংবা চার্ট ফলো না করে খুব সহজে ন্যাচারালভাবে ওজন কমানো আমাদের ওয়েট লস ট্যাবলেটের সহায়তায়’— দ্রুত ওজন কমানোর জন্য এ ধরনের চটকদার বিজ্ঞাপনে তারা সম্মহিত হয়ে যান। অনেকে ব্যায়াম করা, খাবার কমানোর মতো কাজগুলো করতে চান না। টাকা খরচ করে পুষ্টিবিদের ডায়েট চার্ট নিতে চান না। তারা চোখের সামনে যখন অনলাইনে দেখেন— ‘কিছু না করেই ১০ কেজি ওজন কমানোর’ বিজ্ঞাপন, তখন দ্রুত সেটা কিনে নেন। কেন এ ধরনের ক্ষতিকর বিজ্ঞাপন দিয়ে পণ্য বিক্রি করছেন প্রশ্নে বিক্রেতারা বলছেন, জোর করে কিনতে বাধ্য করা হয় না। দেখা যাচ্ছে, কোন কথাগুলো বললে ‘ইমোশোনাল ফুল’রা প্রোডাক্ট কিনতে আগ্রহী হবেন, সেটা মাথায় রেখে বিজ্ঞাপনে ভাষা ব্যবহার করা হয়।
এক ওষুধে ২১ রোগমুক্তি!: কেবল মাশরুমের পাউডার দিয়ে ২১ ধরনের রোগ থেকে মুক্তি ঘটবে উল্লেখ করে দেওয়া বিজ্ঞাপনে ডায়াবেটিস কমানো, হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ, ক্যানসার ও টিউমার প্রতিরোধ, হেপাটাইটিস বি ও জন্ডিস প্রতিরোধ, এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা থেকে রেহাই পাওয়া, আমাশয় নিরাময় থেকে কিডনি রোগ প্রতিরোধ সবই হয়ে থাকে। এ রকম প্রচারণা যারা চালান তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি উল্লেখ করে ডা. এম এ হাসান বলেন, ‘একটি ওষুধ অনেক ধরনের রোগ প্রতিরোধ করে বা ওজন কমায়, এ সব জিনিস প্রচারে প্রলুব্ধ হলে উপকারের চেয়ে অপকার হতে পারে। যারা এই ব্যবসা করে তারা অনৈতিক কাজ করছেন। অনেকে হয়তো ক্যানসারের ওষুধ খাওয়া বাদ দিয়ে প্রলুব্ধ হয়ে এই ওষুধ খেতে শুরু করবেন এবং সেটা অবশ্যই ক্রিমিন্যাল অফেন্স। নির্দোষ প্রচারণার আড়ালে তারা হত্যাকারীদের কাতারে দাঁড়াচ্ছেন।’
ফেসবুকে এ ধরনের পাউডার, ট্যাবলেট, কফি ও চা বিক্রি করে— এমন একটি পেজে ক্লিক করার আধাঘণ্টার মধ্যে ২৩টি একই ধরনের পেজের খোঁজ মেলে। এদের প্রত্যেকে যে বিজ্ঞাপন দেয়, সেখানে প্রথম প্যাকেজে ১০ কেজি, দ্বিতীয় প্যাকেজে ২০ কেজি ও তারপরে ২৫ কেজি ওজন কমানোর কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রশ্ন ওঠে কী এমন চা, যা খেলে কোনোরকম ব্যায়াম বা খাবার পরিমাণ না কমিয়ে ১০ কেজি ওজন কমে যাবে? এই ওষুধগুলো কোথা থেকে আসে প্রশ্নে করলে ‘হোমগ্রিন’ নামে এক পেজের কর্নধার বলেন, এসব ভারতের ওষুধ। আরেকটি পেজ ‘পারফেক্ট ওয়েট’র সঙ্গে ইনবক্সে যোগাযোগ করে ওষুধের উৎপাদক দেশের নাম জানতে চাইলে তিনিও ভারতের কথা বলেন। তারা এই গুঁড়ো ভারত থেকে এনে দেশে প্যাকেজিং করে বলেও জানান। কেন এখানে প্যাকেট করা হয় প্রশ্নে তিনি বলেন, ভারতে যে দামে কেনা হয়, তার চেয়ে কম দামে দেওয়ার জন্যই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অথচ, এক মাসের প্যাকেজ তারা ৮৯০ থেকে ৩২০০ টাকায় বিক্রি করে থাকেন।
পরিচিত ও ফেকপেজ দিয়ে রিভিউয়ের খেলা: এই পেজগুলোতে ভিডিও ও স্ক্রিনশটের মাধ্যমে ক্রেতাদের পজিটিভ রিভিউ প্রচার করা হয়। কীভাবে যোগাযোগ হয়েছিল, কীভাবে ১০/১৫ কেজি ওজন কমে যাওয়ায় সুন্দর হয়ে উঠেছেন, কথিত ক্রেতাদের দিয়ে এসব বলানো হয়। আবার সেখানে মডেল ও অভিনেত্রীদের কেউ কেউ বিজ্ঞাপনে অংশ নেন। এদেরই এক জনের ভিডিও দেখে কমেন্টবক্সের মাধ্যমে যোগাযোগ করে জানা যায়, তিনি এই ওষুধ কিছু সেবন করেছেন ঠিকই। কিন্তু একইসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে, ব্যায়াম করে তবে ওজন কমেছে। তাহলে কেন এই রিভিউ দিলেন প্রশ্নে তিনি বলেন, বন্ধু মানুষ, তাই দিয়েছি।
এসব ওষুধে ত্বকের ক্ষতির অভিযোগও এসেছে উল্লেখ করা হলে পুষ্টিবিদ ও ত্বক বিশেষজ্ঞ তৌহিদা রহমান ইরীন বলেন, ‘ওজন নানা কারণে বাড়তে পারে। কেউ শারীরিকভাবে অলস ও নিষ্ক্রিয় হলে, হরমোনাল ইমব্যালান্স থাকলে, এমনকি পুষ্টির বৈষম্যের কারণেও ওজন বাড়তে পারে। ফলে ওজন কমানোর জার্নিটাতে চিকিৎসক পুষ্টিবিদদের পরামর্শ অবশ্যই নিতে হবে। তারা আপনার শরীরের জন্য কোনটা জরুরি, কোনটা বাদ দিতে হবে, সব নির্ধারণ করে একটা ডায়েট চার্ট দিলে তবেই সেটা কার্যকর হবে। ওজন কমানোর বিষয়টা নিজে নিজে করতে গেলে, গুগল পড়ে করতে গেলে, যেকোনও অঙ্গহানির শঙ্কাও তৈরি হতে পারে।’
এসব চটকদার বিজ্ঞাপন যারা দেয়, তাদের দ্রুততম সময়ে আইনের আওতায় আনা দরকার উল্লেখ করে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান এবং প্রিভেনটিভ মেডিসিনের অধ্যাপক লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘মানুষের শরীরের চিকিৎসা ব্যবস্থায় ব্যবহার্য কিছুই বিজ্ঞাপনযোগ্য নয়। ওজন কমানোর নামে যা বিক্রি করা হয়— তার মধ্যে কিছু দ্রব্য আছে ওজনও কমে না, ক্ষতিকরও নয়। আরেক প্রকার আছে— যা শরীরের বেশকিছু ক্ষতি করে এবং সেই ক্ষতির কারণে ওজন কিছুটা কমে। আরেক প্রকার দ্রব্য আছে, যা ব্যবহারে মারাত্মক ক্ষতি হয় এবং ওজনও কমে। আমার বিবেচনায় মানুষের শরীরের চিকিৎসায় বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিত। চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে ক্ষতিকর পণ্য ব্যবহারে লিভার, কিডনি পাকস্থলী ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’
কোথায় এবং কেন অভিযোগ করবেন: গত নভেম্বরে ওজন কমানোর জন্য এক মাসের ওষুধ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন খন্দকার রীমা। ওষুধ খাওয়ার এক মাসের মধ্যে ওজন কমেনি জানানো হলে— পেজ থেকে আরেক মাস কন্টিনিউ করার কথা বলা হয়। তাতেও কোনও ওজন কমেনি। এরমধ্যে রীমার শরীরে একের পর এক সমস্যা দেখা দেয়। এরমধ্যে রয়েছে ঘনঘন পেটের পীড়া ও চর্মরোগ। পরবর্তী সময়ে রীমা সেই পেজে যোগাযোগ করে বলেন, তার শারীরি সমস্যা এবং ওজন না কমার কথা। এরপর পেজ থেকে তাকে রীতিমতো ধমকানো শুরু হয় এবং জানিয়ে দেওয়া হয়— যেহেতু ওষুধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের জানানো হয়নি, সেহেতু তারা এর দায় নেবে না। এ ধরনের প্রতারিত হওয়ার পর অনেকেই জানেন না যে, অভিযোগটি করবেন আসলে কোথায়? চাইলে ভোক্তা অধিকারের কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করা যায়। জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের কর্মকর্তা মাসুম আরেফিন বলেন, ‘যদি কেউ অভিযোগ করেন, তবে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।’ তবে নেটিজেনদের অনলাইন কেনাকাটায় সতর্কতা অবলম্বনের কথাও বলেন তিনি।– বাংলা ট্রিবিউন