রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেফতার দুই চিকিৎসকের মুক্তির দাবিতে দুই দিনের কর্মবিরতি পালন করছেন সারাদেশের গাইনি চিকিৎসকরা। এসময়ে ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখা ও অস্ত্রোপচার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। তাদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে একই পথে হেঁটেছেন অন্যান্য চিকিৎসকরা। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ রোগী কার্যত চিকিৎসাসেবা থেকে বি ত হচ্ছেন। চিকিৎসা না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। গত শনিবার (১৫ জুলাই) গাইনি ও প্রসূতিবিদ চিকিৎসকদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনিকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা ও ডা. মুনা সাহাকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে সোমবার (১৭ জুলাই) ও মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) কর্মবিরতি পালনের এ কর্মসূচি ঘোষণা করে। গত সোমবার ছিল কর্মবিরতি পালনের প্রথমদিন। এদিন রোগী নিয়ে রাজধানীর উত্তর বাড্ডার ইবনে সিনা হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকের খোঁজে আসেন সাইদুল নামে একজন। হাসপাতালে এসে জানতে পারেন কোনো চিকিৎসক নেই। অন্যদিকে সাধারণ ডায়াগনস্টিবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে চাইলেও মঙ্গলবার পরীক্ষার ফলাফল দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
ভুক্তভোগী সাইদুল বলেন, ‘অন্য আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখানেও কোনো চিকিৎসক নেই। এখানে যদি পরীক্ষাও করাতে পারতাম অন্য কোনো উপায়ে চিকিৎসকের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে পারতাম। তাও সম্ভব না। এক প্রকার বিপদেই আছি।’ এদিন ইবনে সিনা হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে আসেন আসাদ নামে এক রোগী। তিনি বলেন, ‘ শরীর খারাপ, আজ সারাদিন দুর্বল বোধ করছিলাম। হাসপাতালে এসেছি ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে। এখানে ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য নমুনা নিচ্ছে, তবে এর ফল মঙ্গলবার)দেবে না। পরশু (বুধবার) যদি চিকিৎসক আসেন তাহলে তখন ফল দেবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক ও কনসালটেশন সেন্টার কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক বর্তমানে চিকিৎসা দিচ্ছেন না। এছাড়া যেসব পরীক্ষায় চিকিৎসক প্রয়োজন হয় সেসব পরীক্ষার স্যাম্পল (নমুনা) নেওয়া হলেও চিকিৎসক না আসা পর্যন্ত ফল দেওয়া সম্ভব হবে না।’ একই এলাকায় অবস্থিত এ এম জেড হাসপাতাল ঘুরেও একই চিত্র দেখা যায়। সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় এ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, কোনো চিকিৎসক কনসালটেশন দিচ্ছেন না। বন্ধ আছে অন্যান্য সেবাও। তবে হাসপাতালে ভর্তি রোগী দেখতে রাউন্ডে আসেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর। তবে এসময় কিছু জরুরি রোগী আসায় কয়েকজনকে দেখবেন বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এসময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক আজ সেবা দিচ্ছেন না। তবে ডা. আহমেদুল কবীর রাউন্ডে এসেছেন। তারও কোনো রোগী দেখার কথা ছিল না। তবে কয়েকজন জরুরি রোগী তাদের দেখে তিনি চলে যাবেন। হাসপাতালটিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্যাম্পল নেওয়া হলেও মঙ্গলবার সেগুলোর ফল দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।
চিকিৎসকদের এ কর্মবিরতি পালনে বস্তুত থমকে পড়েছে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকরা সেবা দিলেও এতে পূরণ হচ্ছে না মানুষের এ মৌলিক চাহিদা। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগী ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘চিকিৎসা আমাদের অধিকার। অন্যদের সমস্যার কারণে আমাদের কেন ভোগান্তিতে পড়তে হবে? আজ যদি কোনো রোগী মারা যায়, সে দায় চিকিৎসকদেরই নিতে হবে।’ তবে চিকিৎসকদের কর্মবিরতির দাবির সঙ্গে বাংলাদেশে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) একাত্মতা জানায়নি বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির মহাসচিব ডা. এহতেশামুল চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘ধর্মঘটের কারণে চিকিৎসা সংকট দেখা দিলে তার দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশন বা সংগঠনের, বিএমএ কোনো দায় নেবে না। দেশের এ ক্রান্তিকালে (ডেঙ্গু পরিস্থিতি)) হাসপাতাল বা চেম্বার বন্ধ রাখা যাবে না।’ এ চিকিৎসক নেতা বলেন, ‘বিএমএ কোনোভাবেই এর সঙ্গে যুক্ত নয় এবং এ হঠকারী সিদ্ধান্ত সমর্থন করে না। ধর্মঘটের কারণে যদি কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে, তার দায়িত্ব সেসব সংগঠনের এবং সরকার দেশের প্রচলিত আইন তাদের ওপর প্রয়োগ করতে পারবে। আমরা দেখবো দুই দিন দেখবো তারা ধর্মঘট পালন করে কি না, তারপর ব্যবস্থা নেবো। আমরা ৬৪ জেলায় জানিয়ে দিয়েছি, বিএমএ এ ধর্মঘটের বা এ ধরনের কোনো কর্মসূচির সঙ্গে কোনোভাবে সম্পৃক্ত নয়।’
জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ফয়জুল হাকিম, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রওশন আরা, জনস্বাস্থ্য সংগঠক অনুপ কুন্ডু ও সামিউল আলম দুই দিন দেশের ক্লিনিক্যাল চিকিৎসকদের ৩৬টি সংগঠনের ডাকে ১৭ হাজার বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টারে সব ধরনের চিকিৎসা, পরামর্শ ও অপারেশন বন্ধের সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এক বিবৃতিতে তারা বলেন, এর ফলে (কর্মবিরতি) ডেঙ্গুর বর্তমান বিপদজনক পরিস্থিতিতে আক্রান্ত রোগীদের সুচিকিৎসা হুমকিতে পড়বে। তারা জানান, গ্রেফতার দুই চিকিৎসককে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে সারাদেশে চিকিৎসাসেবা ক্ষেত্রে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসন করতে হবে।