শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪৭ অপরাহ্ন

সমাজসেবক জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০২৩
অধ্যাপক এম আর খান। - ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বময় করোনা মহামারী যখন অপরিমেয় ক্ষতিসাধনের পর, বাংলাদেশের সমাজ ও স্বাস্থ্য অর্থনীতি যখন ডেঙ্গু মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে তখন জাতীয় অধ্যাপক ডা: এম আর খানের মতো কর্মনিষ্ঠ দায়িত্বশীল সমাজসেবকের অভাব অনুভূত হচ্ছে তীব্রভাবে। কেননা তিনি নিজে চিকিৎসক সমাজের দার্শনিকতুল্য প্রতিনিধি ছিলেন, সমাজসেবার মনোভাব নিয়ে সবাইকে সমন্বিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতেন, সর্বোপরি সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে তার ছিল যথেষ্ট সম্মান ও সমীহের সাথে প্রভাবক ভূমিকা পালনের সক্ষমতা। দেশের শিশু চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রবাদপুরুষ, শিশুবন্ধু, সমাজহিতৈষী, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসাক্ষেত্রে দক্ষ প্রশাসক, চিকিৎসা-শিল্প উদ্যোক্তা, সদালাপী, সদা সংস্কারমনষ্ক এবং সমাজসেবায় একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ রফি খান যিনি- এম আর খান হিসেবে ছিলেন সুপরিচিত। সাতক্ষীরার রসূলপুর গ্রামে তার জন্ম। পিতা আবদুল বারী খান সাতক্ষীরার সমাজহিতৈষী সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মা জায়েরা খানম ছিলেন বিদূষী নারী। তিনি ছিলেন তৎকালীন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সংবাদপত্র জগতের পথিকৃত মাওলানা মো: আকরাম খানের নিকটাত্মীয়। তার সহধর্মিণী মরহুম আনোয়ারা খান কলকাতা সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। ছিলেন একজন স্বনামধন্য সমাজসেবী। জাতীয় অধ্যাপক এম আর খানের (জন্ম ১ আগস্ট ১৯২৮-মত্যু ৫ নভেম্বর ২০১৬)। প্রাথমিক জীবন শুরু হয় সাতক্ষীরার রসূলপুর প্রাইমারি স্কুলে। সাতক্ষীরার পিএন হাইস্কুল থেকে ১৯৪৩ সালে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাস করেন। কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। কলেজে ড. কুদরত-ই-খুদার ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৯৪৫ সালে আইএসসি পাস করেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে সেখান থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ব্রিটেনের এডিনবার্গ স্কুল অব মেডিসিন থেকে ১৯৫৭ সালে ডিটিএমঅ্যান্ডএইচ এবং লন্ডন স্কুল অব মেডিসিন থেকে ডিসিএইচ ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি এডিনবার্গ থেকে ১৯৬২ সালে এমআরসিটি ও ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ থেকে এফসিপিএস এবং ১৯৭৮ সালে এফআরসিপি ডিগ্রি নেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) থেকে পিএইচডি লাভ করেন।
কর্মজীবনে ডা: এম আর খান দেশে-বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। ১৯৫৯-৬৩ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার কেন্ট ও এডিনবার্গ গ্রুপ হাসপাতালে যথাক্রমে সহকারী রেজিস্ট্রার ও রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দেশে ফিরে ১৯৬৩ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে শিশু বিভাগে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে যোগদানের পর সেখানে শিশু বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে যোগ দিয়ে সেখানকার হাসপাতালে শিশু বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭০ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে প্রফেসর অব পেডিয়াট্রিকস হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে আইপিজিএমআরে অধ্যাপক পেডিয়াট্রিকস হিসেবে বদলি হয়ে আসেন। সেখানে ডিসিএইচ এবং এফসিপিএস কোর্স চালু করেন। ১৯৭৩ সালে যুগ্ম পরিচালক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৭৮ সালে ঢাকা শিশু হাসপাতালে পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। স্বল্প সময়ে সেখানে প্রভূত উন্নতি করেন। ১৯৭৯ সালে আবার আইপিজিএমআরে হেড, ডিপার্টমেন্ট অব পেডিয়াট্রিকস পদে যোগ দেন এবং ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত কর্মরত থেকে সেখানে পেডিয়াট্রিকসের বিভিন্ন কোর্স সফলতার সাথে পরিচালনা করেন। ১৯৮৮ সালে দীর্ঘ চাকরি জীবন শেষে পিজি (আইপিজিএমআর) হাসপাতাল থেকে অবসরে যান।
সাতক্ষীরায় নিজের গ্রাম রসূলপুরকে আদর্শগ্রাম তথা দারিদ্র্যমুক্ত হিসেবে গড়ে তুলতে তার উদ্যোগ দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূয়োদর্শন হিসেবে বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। ‘নিজের গ্রামকে আগে দারিদ্র্যমুক্ত করি’ এ প্রত্যাশা ও প্রত্যয়ে দীপ্ত বাংলাদেশের সব সচেতন মানুষ তার মতো কর্মবীরের অনুসরণে একযোগে কাজ করতে পারলে, সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা অসম্ভব নয়। ‘রসূলপুর আদর্শ গ্রাম’ এই মডেলে তার প্রত্যয় ও প্রত্যাশা ছিল। এর আদলে গড়ে উঠুক বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রাম ও জনপদ। পল্লী উন্নয়ন ভাবনা ও কর্মযজ্ঞে রসূলপুর ছিল পল্লী উন্নয়নে সমৃদ্ধ চেতনার নাম। শিশুদের সেবার মানসে ১৯৮৩ সালে শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এটি পাঁচ জেলার ১২টি কর্ম এলাকায় সম্প্রসারিত। চুয়াডাঙ্গা, টাঙ্গাইল ও সাতক্ষীরাতে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবা ছাড়া অনানুষ্ঠানিক সান্ধ্যকালীন প্রাথমিক শিক্ষা, ভোকেশনাল ট্রেনিং, পরিবেশের উন্নয়ন, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি, আর্সেনিক ও জীবাণুমুক্ত পানি সরবরাহের লক্ষ্যে আর্সেনিক ফিল্টার বিতরণ, টিউবওয়েল ও স্যানিটারি ল্যাট্রিন স্থাপন, গরিব ও দুস্থ চক্ষুরোগীদের চিকিৎসা ও অপারেশনে আই ক্যাম্পের আয়োজন, প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন অন্ন, বস্ত্র ও অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী বিতরণ, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবা প্রদান এবং দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে পুনর্বাসন কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাড়ি নির্মাণ, টিউবওয়েল ও স্যানিটারি ল্যাট্রিন স্থাপন, ক্ষুদ্রঋণ প্রদানসহ নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ঢাকার মিরপুরে ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ ও শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট এবং যশোরে শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠ করেছেন তিনি। শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন বাদেও স্থানীয় জনগণ এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় নিজের পেনশনের টাকা, পৈত্রিক জমিজমা এবং স্ত্রীর সঞ্চয়ের অর্থে ১৯৮৫ সালে সাতক্ষীরা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত উল্লেখযোগ্য অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য- ডা: এম আর খান অ্যান্ড আনোয়ারা ট্রাস্ট্র, উত্তরা মহিলা মেডিক্যাল কলেজ, নিবেদিতা চিলড্র্রেন হাসপাতাল অ্রান্ড রিসার্স সেন্টার,সেন্ট্রাল হাসপাতাল ইত্যাদি। মহৎপ্রাণ মানুষেরা নিজের জন্য নয় অন্যের কল্যাণে নিবেদন করেন নিজের সব ধন ও ধ্যান ধারণাকে। উৎসর্গ করেন নিজের স্বার্থ ও ভবিষ্যৎ ভাবনাকে। এম আর খান আনোয়ারা বেগম ট্রাস্ট ফান্ড এমন এক মহৎ উদ্দেশ্যে নিবেদিত, শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন আর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তিনি উৎসর্গ করেছিলেন নিজের সঞ্চয়, সম্পদ ও সামর্থ্য। একমাত্র কন্যা সন্তান ডা: ম্যান্ডি করিম কানাডায় প্রবাসী এবং ২০১১ সালে স্ত্রী আনোয়ারা খানের মৃত্যুর পর নিজের জন্য পরিবারের জন্য যেন ছিল না তার আর কোনো পিছুটান। তাই একের পর এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তার একান্ত প্রত্যাশা ছিল স্থায়িত্ব লাভ করুক জনদরদি এই ফান্ড ও প্রতিষ্ঠান। সাতক্ষীরা তথা দেশের মানুষ পাক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধ জীবনযাপনের দিশা।
সময়ের সিঁড়ি বেয়ে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি দেখেছেন, শিখেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন মানুষের অসহায়ত্বকে সহায় হয়ে দাঁড়ানোর অনিবার্যতা। ‘দুর্বল মানুষ যদি পার হয় জীবনের অথৈ নদী’ তাতে নিজের কোনো ক্ষতি নেই; বরং বিপদমুক্ত মানুষের কলরবে সাফল্যে ভরবে দেশ ও জাতি। কেন তাই এ পথে পিছিয়ে যাব? রেখেছিলেন এ প্রশ্ন নিজের কাছে, দেশের কাছে। চিকিৎসা ও সমাজসেবায় একজন লেখক ও গবেষক হিসেবে তার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে। চিকিৎসা শাস্ত্রে তার অন্যতম প্রকাশনার তালিকায় রয়েছে- ‘আপনার শিশুর যতœ নিন’, ‘মা ও শিশু’,‘ এসেনস অব পেডিয়াট্রিকস, প্রাথমিক চিকিৎসা, আপনার শিশুকে সুস্থ রাখুন, এসেনস অব এন্ডোসকপি, ড্রাগ থেরাপি ইন চিলড্রেন। অন্যূন ৩৭টি রিসার্চ পেপার দেশ-বিদেশে স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
শিশুরা দেশ ও জাতির ভবিষ্যত। মানুষের সৃজনশীল সম্ভাবনার সত্তা তাকে পুষ্টি দিয়ে মননশীল করে সুচিকিৎসা দিয়ে সুস্থভাবে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে- এ সুযোগ লাভ তার অধিকার। ডা: এম আর খান শিশু চিকিৎসার ওপর বিদেশে বড় ডিগ্রি অর্জন করে সেখানে বড় চাকরির সুযোগ ও সুবিধা ছেড়ে চলে এসেছিলেন দেশে। দেশে শিশু চিকিৎসাব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় প্রতিষ্ঠায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন পথিকৃতের ভূমিকায়। অধ্যাপক ডা: এম আর খান শিশুরোগ চিকিৎসা ও সমাজসেবায় অসামান্য অবদানের জন্য বিভিন্ন সময়ে তার কর্মের স্বীকৃতি পেয়েছেন এবং ঈর্ষণীয় সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার তাকে ১৯৯৫ সালে জাতীয় অধ্যাপক, সমাজসেবা বিষয়ে অবদানের জন্য ২০০৯ সালে একুশে পদক এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পদক দেয়। লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com