রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ০৮:০৫ পূর্বাহ্ন

বেগম রোকেয়া এবং দেবী চৌধুরানীর রংপুরে

ফয়সাল আহমেদ
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০২৩
বেগম রোকেয়া

উত্তরবঙ্গ ইতিহাস ও ঐতিহ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল। ইতোমধ্যে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধানে বেশ কয়েকবার উত্তরবঙ্গে আসা হয়েছে। বিশ্ব ঐতিহ্য পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার, মহাস্থানগড়, গৌড়ের রাজধানীর অংশবিশেষ চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছোট সোনামসজিদ, আমবাগান, রাজশাহী, দিনাজপুরসহ বহু প্রত্মতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভ্রমণ করেছি। রংপুরেও ভ্রমণ করেছি তবে শুধু রংপর অঞ্চলকে কেন্দ্র করে নয়। এবার শুধু রংপুর অঞ্চলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থান ভ্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে একাই বেরিয়ে পড়ি। ২০২২ সালের ১৫ থেকে ১৮ অক্টোবর ছিল আমার রংপুর ভ্রমণপর্ব।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক-বিরোধী লড়াইয়ে কৃষকদের একটি বড় ভূমিকা ছিল এই অঞ্চলে। বাঙলার কৃষক বিদ্রোহ নিয়ে গ্রন্থাবলীতে গুরুত্বের সাথে এসেছে এই অঞ্চলের কথা। সৃষ্টি হয়েছে সাহিত্য। তারপরও আমি মনে করি, অনেক ইতিহাস ও সাহিত্য সৃষ্টির পরও উত্তর জনপদ যথাযথভাবে উঠে আসেনি আমাদের লেখালেখিতে। এবার অনলাইনে যাওয়া আসার টিকিট কেটেছি। রাত সাড়ে ১১টার নাবিল পরিবহনে যাত্রা করে দীর্ঘ যাত্রায় সকাল ৭টায় পৌঁছাই রংপুর শহরে। বগুড়া-রংপুরজুড়ে চার লেনের কাজ চলার কারণে ভীষণ যানজট ছিল। আমি রংপুর মেডিকেল মোড়ে নেমে যাই। বাসটি যাবে পঞ্চগড় পর্যন্ত। একটি অটোরিকশা নিয়ে চলে আসি লালকুঠি মোড়ের কাছে হোটেল রায়ানসে। বুকিং পূর্বে দেয়া ছিল। নাম এন্ট্রি করে দ্রুত রুমে উঠি। বেশ ঝটপট সকালের নাস্তা সারি মোড়ের একটি ব্যস্ত রেস্টুরেন্টে। সীমিত বাজেটে রায়ানস হোটেলের রুম এবং পরিসেবা ভালো। আমি দেরি না করে স্নান সেরে রওয়ানা হয়ে যাই আমার প্রথম গন্তব্য বেগম রোকেয়ার গ্রাম পায়রাবন্দের উদ্দেশ্যে।
যানবাহন বলতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। প্রথমে একটি অটোতে মডার্ন মোড় পর্যন্ত যাই। সেখান থেকে আরেকটি অটোতে পায়রাবন্দ পৌঁছতে আরো প্রায় ১৫ কি.মি. পথ পাড়ি দিতে হলো। পাশের সিটের তরুণীর সাথে কথা হয়। সে পায়রাবন্দের বেগম রোকেয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। আমি তার কাছে জানতে চাই বেগম রেকেয়ার লেখা পড়েছে কি না? উত্তরে সে জানায়, সেভাবে পড়া হয়নি তবে আগ্রহ আছে। কলেজে বইপড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃতও হয়েছে সে। আমি তার পাঠ্যাভাসের প্রশংসা করি। রোকেয়ার লেখা ভালোভাবে পড়ার জন্য অনুরোধ করি। অটো থেকে নেমে সোজা চলে যাই বাংলা একাডেমি পরিচালিত বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্রে। কম্পাউন্ডের ভেতরের মাঠে মেটালে তৈরি রোকেয়ার একটি ভাস্কর্য দেখতে পাই। ভাস্কর্যটি আরো ভালো হওয়া উচিত ছিল বলে আমার মনে হয়েছে। ভেতরে একটি গ্রন্থাগার ছাড়া তেমন কিছু নেই। বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের গ্রন্থাগারিকের সাথে খানিক্ষণ কথা হয়। তিনি আমাকে হালকা খাবার ও চা দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। বেশ কিছুক্ষণ আলাপে এখানকার অনেক সমস্যা ও সংকটের কথা বললেন তিনি। বস্ত্র উৎপাদনকারীদের সংগঠন বিকেএমইএ একসময় লিজের নামে বেগম রোকেয়ার বসতবাড়ি দখল করে ছিল। রোকেয়া কমপ্লেক্সটি একটি প্রজেক্টের অধীনে কাজ হচ্ছিল। তখন বিকেএমইএ এসে দখল নিতে চাইল। ফলে হলো মামলা। মামলার আজো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি।
আমি রেগম রোকেয়া কমপ্লেক্সে আরো খানিকটা সময় কাটিয়ে চলে আসি তাঁর আদি ভিটায়। যেখানে থেকে তিনি তাঁর শৈশব, কৈশর ও তারুণ্যের দিনগুলি কাটিয়েছেন। তৎকালীন সমাজে মুসলিম নারীদের বিদ্যাশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রবল প্রতিবন্ধকতাকে অস্বীকার করে বহু কষ্টে এবং নানা কৌশলে নিজেকে শিক্ষিত করতে পেরেছিলেন রোকেয়া। তারপরের ইতিহাস আমরা জানি, বাংলাদেশ কিংবা ভারতবর্ষ নয় গোটা বিশ্বের হাতে গোটা কয়েকজন নারীর মধ্যে একজন নারী হিসাবে নিজের ভাবনা ও কাজের প্রকাশ ঘটান। বেগম রোকেয়ার সংগ্রাম ও একজন অনন্য সাধারণ মানুষ হওয়ার আতুঁরঘর এই বসতভিটা।
ভাঙ্গাচোরা দেয়াল, কয়েকটি পিলার এবং ভিটে-মাটির অংশবিশেষ বড় অযতœ ও অবহেলায় পড়ে আছে। পাশেই একটি দোকানে বই ও সুভ্যেনির বিক্রি হচ্ছে। দোকানীর কাছে শুনলাম মূল ভিটায় ঢোকার জন্য গেটের চাবি প্রতিবেশি একজন খালার কাছ থেকে নিতে হবে। দোকানীর মাধ্যমে খালার সন্ধান করলাম। খালা এসে গেট খুলে দিলেন। বই বিক্রেতা দোকানীও আমাকে খানিকক্ষণ সময় দিলেন। শক্তি অনুভব করি কী করে প্রচ- বৈরী পরিবেশে উঠে দাঁড়াতে হয় সেই শিক্ষায়। রোকেয়ার বাবা বা স্থানীয়দের বিরোধীতা ছিল স্ত্রী শিক্ষায়। কিন্তু ভাইদের সহযোগিতা এবং পরবর্তীতে তাঁর স্বামীর সহযোগিতার তাঁর জন্য অনুপ্রেরণা এবং শক্তি দান করেছে। কিন্তু সবকিছুর উর্ধ্বে ব্যক্তি রোকেয়ার অনমনীয় মনোভাব, গভীর অধ্যয়ন এবং নারী শিক্ষার জন্য তাঁর জীবন বাজি রেখে কাজ করা। রোকেয়ার ইতিহাস প্রতিটি বাঙালি তরুণ-তরুণীর গভীর মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। বেশ খানিকক্ষণ পায়রাবন্দে কাটিয়ে এবার ফেরার কথা ভাবছিলাম। মনে পড়ছে আমার একজন প্রিয় সাংবাদিক ও লেখক অকালপ্রয়াত মোনাজাত উদ্দিনের কথা। যার সঙ্গে আমার একুশে বইমেলায় পরিচয় হয়েছিল নব্বই দশকে। তিনি ‘পায়বন্দের শেঁকড় সংবাদ’ নামে একটি অসাধারণ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন যা বই আকারে প্রকাশ হয়েছিল। সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন এতো বছর পরও বেগম রোকেয়ার পায়রাবন্দ শিক্ষাদীক্ষায় খুব বেশি অগ্রসর হয়নি। অবশ্য এখন অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। পায়রাবন্দ থেকে পীরগাছা খুব দূরে নয়। আরেকজন যোদ্ধা নারীর জন্ম ও কর্মের ক্ষেত্র পীরগাছা। দেবী চৌধুরানী। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে এক অনন্য সাধারণ যোদ্ধার নাম। আমি এবার ভূগোলে খানিকটা ভুল করে বসি। যাবো পীরগাছা, উঠে পড়ি পীরগঞ্জগামী বাসে। ভুল শোধরাতে আমার ঘণ্টা ২ সময় অতিরিক্ত ব্যয় হয়ে যায়। আবার ফিরতি বাসযোগে রংপুর শহরে আসি। এখান থেকে অটোযোগে ১৮ কি.মি. দূরে পীরগাছা রওয়ানা হই। এখানে নেমেই খোঁজ করি দেবী চৌধুরানীর বাড়ি। এতো অল্প সময়ে দুটি স্থান দেখা খানিকটা কঠিন বৈকি। আমার জীবনের ঘোর লাগা এক সফর ছিল এইদিন।
ততক্ষণে গোধূলি বেলা। আমি একটি ভ্যান ঠিক করে যাত্রা করি দেবী চৌধুরানীর বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাজার এবং চৌধুরানী নামে রেলস্টেশনের নাম থাকলেও তাঁর বসতভিটা চিনতে বেশ বেগ পেতে হলো আমার। অবশেষে খুঁজে পেলাম দেবী চৌধুরানীর বাড়ির ভিটে ও পুকুর। মূল বাড়ির কোনো অস্তিত্বই নেই। দেখা মেলে কেবলই পরিত্যক্ত জলাশয় ও জঙ্গলের অস্তিত্ব। স্থানীয় কয়েকজন কৃষকের সাথে কথা হয়। তারা আজো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করলেন তাদের নেত্রী প্রিয় দেবীকে। কৃষককণ্যা দেবী চৌধুরানী জমিদারের বউ হওয়া সত্ত্বেও কৃষকের পক্ষে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।
পীরগাছায় জমিদার বাড়ি ছিল। রাত হয়ে যাওয়ায় রওয়ানা দিয়েও সেখানে যেতে পারিনি। কাচারী অফিসে সুজন বিশ্বাস নামে এক যুবকের সাথে পরিচয় হয়। সুজন আমাকে চা পান করান। আফসোস করে সুজন, সন্ধ্যা না হলে পীরগাছা জমিদার বাড়িতে নিয়ে যেতো। যদিও এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। আমি বলি, পরের বার ঘুরে দেখবো জমিদার বাড়িটি। বিদায় নেয়ার সময় বলি, সংস্কৃতিকর্মীরা বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। বিচ্ছিন্ন থাকলে পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ির মতো সাপ-খোপের বসবাস শুরু হবে!
বেগম রোকেয়া এবং দেবী চৌধুরানীর সময়ের ব্যবধান প্রায় একশ বছরের। সময়ের প্রয়োজনে একজন নারী কৃষক-প্রজাদের সংগঠিত করেছিলেন। ব্রিটিশ স্রামাজ্যর বিরুদ্ধে ভবানী-পাঠক মজনু শাহের সাথে মিলে তীব্র সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন। তিনি পীরগাছার চন্ডীপুর নামক গ্রামে সহযোদ্ধাদের নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন।
অন্যদিকে বেগম রোকেয়া পিছিয়ে পড়া নারীদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ এবং বুদ্ধির মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। দুজনই যোদ্ধা। জীবনে এবং কর্মে। মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে এই দুই মহীয়সী নারীর চিন্তা ও কর্মের দূরত্ব খুব বেশী নয়। বরং কাছাকাছি। কাছাকাছি তাঁদের আদি ভিটার ঠিকানা। বেগম রোকেয়ার জন্ম রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। দেবী চৌধুরানীর জন্ম পীরগাছার কৈকুড়ী ইউনিয়নের মকসুদ খাঁ গ্রামে। দুঃখজনক হলেও আরেকটি জায়গায় মিল আছে। এর দায় আমাদের। কারো বাড়িঘরের মূল কাঠামো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি! ভাবছি, এখনও কি রাষ্ট্র ও সমাজ এঁদের ভয়ে ভীত? সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে ইচ্ছুক নয়? অথবা নিতান্ত অবহেলা। যে অবহেলায় আমরা বহু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন বিনষ্ট করে ফেলেছি ইতোমধ্যে!
রাতে হোটেলে ফিরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে ঘুম থেকে উঠে চিলমারী উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবো ভেবেছি। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে চিলমারী যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করে দিতে হলো। কারণ মূল চিলমারী বন্দর এখন শুধুই স্মৃতি। নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে জানলাম রংপুর এসে। আরডিআরএস-এর রুম বুকিংও বাতিল করি। অবশ্য একবার শুধু কুড়িগ্রামের চিলমারী বন্দরের উদ্দেশ্যে যাবো। বন্দর নাইবা সচল থাকুক, তার স্মৃতি তো আছে! তবু যেতে পারতাম কিন্তু চিলমারী গেলে রংপুরের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা তাজহাট জমিদার বাড়ি দেখা হবে না। আমার অবশ্য ট্রেনের টিকেট কনফার্ম করা চিলমারী থেকে রংপুর হয়ে ঢাকাগামী ট্রেনে। সকালে চলে যাই কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট রোড ধরে তিস্তার ওপারে। বাস আমাকে ওপারেই সেতুর কাছেই নামিয়ে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি তিস্তা সেতুর কাছে। তিস্তায় ইতোমধ্যে চর পড়া শুরু হয়েছে। ভারতের সাথে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় এই অঞ্চলের কৃষকের পানির জন্য হাহাকার করতে হয় শুকনো মৌসুমে। আবার ভরা বর্ষায় পানি প্রবাহ ছেড়ে দেয়ায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির তৈরি হয় ভাটির দেশের মানুষের। তিস্তাপারে বসে বারবার মনে পড়ছিল বিখ্যাত ভাওয়াইয়া গানটি: ও কি গাড়িয়াল ভাই/ হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে ৃ। আব্বাস উদ্দিনের বিখ্যাত এই ভাওয়াইয়া গানের উৎসভূমি চিলমারী বন্দর এবং বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদে খানিকক্ষণ নৌকায় ভেসে থাকার ইচ্ছে ছিল। তবে এবার চিলমারী যাওয়া না হলেও জেলে মোহনচন্দ্র দাসের জীবন সংগ্রামের গল্প শুনতে শুনতে দীর্ঘক্ষণ ভেসে ছিলাম তিস্তা নদীতে।
কাউনিয়া রেলস্টেশন, তিস্তা রেলসেতু ঘুরে দেখা, চলতি পথে আরো মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম এবং জীবন ভাবনার বিচিত্র গল্পে দিন কেটে যায় আমার। মোহন দাশের জীবন বড় কষ্টের। মাছ ধরে একসময় কোনোরকমে সংসার চালাতে পারতেন। এখন তিস্তায় স্বাভাবিক পানি প্রবাহ না থাকায় মাছও নেই। তবুও পূর্ব পুরুষের পেশা মাছ ধরা তিস্তায় নামেন প্রতিদিন। বউ তাকে দুটো রুটি আর সবজি করে দেন দুপুরে খাবারের জন্য। কোনো কোনোদিন সারাদিনেও জালে মাছ ওঠে না। তাই নৌকায় উপরে রোদ থেকে রক্ষার জন্য সুন্দর করে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে পর্যটক আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। এতে কোনো কোনো দিন তার বাড়তি কিছু আয় হয়। এভাবেই কোনোরকমে জীবন ধারণ করছেন মোহন। তিনি আরো জানালেন, তিস্তার উপর আরেকটি চার লেনের রেলসেতু হবে। খুব সহজ-সরলভাবে তার প্রশ্ন, এতো বড় বড় প্রজেক্ট হয়, আমাদের ভাগ্যের তো কোনো উন্নয়ন হয় না, দাদা!
মোহনদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটি অটোতে চড়ে তিস্তা সেতু পার হয়ে চলে আসি কাউনিয়া বাজারে। মোহন দাশ বলে দিয়েছেন, কোন রেস্টুরেন্টে ভালো খাবার। কাউনিয়া এসে একবার দেখে আসি রেলস্টেশনটি। বহু পুরনো স্মৃতি রয়েছে এই স্টেশনটি ঘিরে। যে রেস্টুরেন্টে আহার সারি সেখানে পরিচয় হয় এক যুবকের সাথে। নাম আমিনুল ইসলাম। মূল বাড়ি কুড়িগ্রামে। কথায় কথায় বাড়ে ঘনিষ্ঠতা। তাঁর জীবনের কিছু দুঃখের কথা বলে আমিনুল। বিশেষত বন্ধুদের স্বার্থপরতার কথা। নিজেকে নিঃস্বার্থভাবে বিলিয়ে দিলেও বন্ধুরা করুণা ছাড়া কিছুই করেনি তাকে। তার মূল আক্ষেপ বন্ধুরা বিভিন্ন স্থানে ভালো চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। কিন্তু সে কোথাও স্থিতু হতে পারল না। এই মুহূর্তে সে একটি বালু মহালের সুপার ভাইজার হিসাবে চাকরি করছে। বন্ধুরা শুধু তাঁর কাছ থেকে নানা রকম সেবা বা কাজ করিয়ে নিতে চায়! কেউ তার দুঃখের কথা বুঝলো না ইত্যাদি।
আমি জানতে চাই, আপনি কি বন্ধুদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন? আমিনুল বলে, না, না, আমি কেনো বলব? প্রকৃত বন্ধুর তো উচিত আরেক বন্ধু কী অবস্থায় আছে নিজে থেকে বুঝতে পারা। আর তা না পারলে কীসের বন্ধুত্ব? আমিনুল আরো বলে, মনে যতোই দুঃখ থাক আমি প্রকাশ করব না এবং বন্ধুত্বও নষ্ট করব না। আমি বেশ অবাক হই! আজকাল এমন বন্ধু অন্তঃপ্রাণ মানুষও আছে? আমিনুল আমাকে চা খাওয়ায়। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কাউনিয়া থেকে রংপুরগামী একটি বাসে চড়ে বসি।
বাস থেকে নেমে একটি অটো নিয়ে চলে আসি রংপুর তাজহাট জমিদার বাড়ি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রংপুর শহরের সন্নিকটে মাহিগঞ্জের জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতা করেন পাঞ্জাব থেকে আগত স্বর্ণ ব্যবসায়ী মান্নালাল রায়। মান্নালাল রায় হীরা, মানিক, জহরতখচিত তাজ বা টুপির ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল মুনাফা লাভ করেন। রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে অনেক জমিজমা এই জমিদার ও তার পররর্তী উত্তরাধিকারীদের করায়ত্ত হয়। যথারীতি জোটে ব্রিটিশ আনুকূল্য। ১৯০৮ সালে ‘মহারাজা’ কুমার গোপাল রায় জমিদারী লাভ করে এই প্রাসাদোপম বাড়ি নির্মাণ করেন। সেই সময়ে এখানে তাজ বিক্রির হাট বসতো। তাজহাট নামকরণে এর যোগসূত্র রয়েছে বলে অনেকে ধারণা করেন। ১৬ একর জায়গাজুড়ে সাদা রঙের দৃষ্টিনন্দন এবং মার্বেল পাথরসহ মূল্যবান নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে বিশাল জমিদার বাড়িটি নির্মিত। এটি দীর্ঘদিন বেদখল হয়ে ছিল স্থানীয় প্রভাবশালীদের দ্বারা। অনেক বড় বড় এবং শক্তিশালী সরকারী সংস্থাও নাকি এখানে তাদের ঘাঁটি বা ক্যাম্প করতে চেয়েছিল। একসময় এই ভবনটি রংপুরের বিভাগীয় হাইকোর্ট হিসাবেও ব্যবহৃত হতো। অবশেষে মামলার মাধ্যমে এটি যথাযথ কর্তৃপক্ষ প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এটি এখন রংপুর জাদুঘর। অবশ্য আরো দুটি সংস্থার অফিস এখনো রয়ে গেছে।
রাতে হোটেলে ফিরে স্থানীয় রেস্তোঁরায় খাওয়া সারি। এরপর আবার ক্লান্তির ঘুমে শরীর এলিয়ে দেই। সকালে উঠেই দৌঁড়াতে হবে হোটেল থেকে বেশ খানিকটা দূরে রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। বাহন বলতে ধীর গতির ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। ঘুম থেকে উঠে পাশের রেস্তোরাঁতে নাস্তা সেরে অটো নিয়ে রওয়ানা হয়ে যাই রংপুর রেলস্টেশনের উদ্দেশ্যে। কুড়িগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি এক ঘণ্টা দেরীতে এসে পৌঁছায়। আমি আমার নির্দিষ্ট কেবিনে উঠে পড়ি। দু’জন বোরখা পরিহিতা রয়েছেন আমাদের কেবিনে। সম্ভবত তারা কুড়িগ্রাম থেকে আসছেন। বোরখাপরা একজন নারী অনেক বেশী পর্দানশীল এবং অভিজাত কেউ মনে হলো। পানি পান করার সময়ও সঙ্গের মহিলা, যিনি হয়তো তার আত্মীয়া বা গৃহকর্মী হবেন, আমাকে আড়াল করে রাখলেন। বেগম রোকেয়ার দেশে এই অবগুণ্ঠনবাসীনীর দেখা পেয়ে রোকেয়ার সেই সময়ের কথা মনে পড়ল। ইতোমধ্যে কেবিনের অন্য যাত্রীরাও উঠে এসেছেন। পরিবেশ স্বাভাবিক হতে শুরু করলো। অন্তত আমার কাছে। একটু পরে দেখলাম উপরের লাইট, ফ্যান বা এসি ছাড়া কিংবা বন্ধ করা ইত্যাদি নিয়ে অবগুণ্ঠনবাসিনী প্রয়োজনীয় কথাও বলছেন আমাদের সাথে। একজন বয়স্ক স্কুল মাস্টার উঠলেন পার্বতীপুর থেকে। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে তিনি বললেন, তাঁর কিডনীর সমস্যা আছে, তাই বেশিক্ষণ বসতে পারেন না। তিনি বাঙ্কের উপরে উঠে শুয়ে পড়লেন। প্রায় ১১ ঘণ্টা যাত্রাপথে তিনি একবারমাত্র মূত্র ত্যাগহেতু ওয়াশরুমে যাওয়া ছাড়া বাঙ্কের উপর ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলেন। এ ছাড়া আরো দু’জন যাত্রীর একজন চাকরিজীবী এবং অপরজন ব্যবসায়ী মনে হলো। তারা উঠলেন জয়পুরহাট থেকে।
দুপুরে আহার করতে গেলাম খাবার গাড়িতে। এখানে একটাই খাবার মেলে মোরগ পোলাউ। আমি তাই নিয়ে খেতে শুরু করেছি একটি ছোট্ট টেবিলে বসে। ওমা, এর মধ্যে পাশে বসে আহাররত দু’জন তরুণ-তরুণীর অনুরোধে বাড়ি থেকে রান্না করা হাঁসের মাংসও নিতে হলো। এই সহজ-সরল আতিথেয়তা উত্তরবঙ্গেই সম্ভব। বিচিত্র মানুষের দেশে, বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে ঢাকায় আমার ফিরতি সর্বশেষ গন্তব্য কমলাপুর স্টেশনে নামি রাত ১১টায়।-রাইজিংবিডি.কম




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com