‘বাংলার আপেল’ খ্যাত দক্ষিণাঞ্চলের পেয়ারার দেখা মেলে আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসে। এ তিন মাসে বদলে যায় ঝালকাঠি, বরিশাল ও পিরোজপুরের ৫৫ গ্রামের চিত্র। এসময় খাল-বিল-নদী-নালায় পানি থই থই করে। সেই পানিতে বসে ভাসমান পেয়ারার বাজার। চাঙা হয় গ্রামীণ অর্থনীতি। তবে এবার পেয়ারার ফলন কম হয়েছে বলে জানিয়েছেন চাষিরা। দিন দিন ভাসমান পেয়ারা বাজারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে দেশে-বিদেশে। ভাসমান পেয়ারার বাজারে ভিড় জমান পর্যটকরা। পদ্মা সেতুর বদৌলতে বেড়েছে পর্যটকের সংখ্যা। সেইসঙ্গে ভাগ্যের চাকাও ঘুরেছে পেয়ারা চাষি, পাইকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। বরিশাল বিভাগের অন্যত্র ছিটেফোঁটা চাষ হলেও বরিশাল জেলার বানারীপাড়া, ঝালকাঠি সদর ও পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি ঘিরেই মূলত পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ। বরিশালের বানারীপাড়ার ১৬ গ্রামে ৯৩৭ হেক্টর, ঝালকাঠির ১৩ গ্রামে ৩৫০ হেক্টর ও স্বরূপকাঠির ২৬ গ্রামের ৬৪৫ হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়। এসব এলাকার মধ্যে ঝালকাঠির কীর্তিপাশা, ভিমরুলী, শতদশকাঠি, খাজুরিয়া, ডুমুরিয়া, কাপুড়াকাঠি, জগদীশপুর, মীরকাঠি, শাখা গাছির, হিমানন্দকাঠি, আদাকাঠি, রামপুর, শিমুলেশ্বর গ্রামের বিরাট অংশজুড়ে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় পেয়ারা।
এসব গ্রামের কয়েক হাজার কর্মজীবী পরিবার প্রায় দুইশ বছর ধরে পেয়ারার চাষ করছে। পেয়ারার চাষ, ব্যবসা ও বাজারজাতকরণেও রয়েছে কয়েক হাজার মৌসুমি ব্যাপারী ও শ্রমিক। এসময় অন্তত ২০টি স্থানে পেয়ারা পণ্যের মৌসুমি মোকাম সৃষ্টি হয়। এগুলো হলো ভিমরুলী, আতাকাঠি, ডুমুরিয়া, গণপতিকাঠি, শতদশকাঠি, রাজাপুর, মাদ্রা, আদমকাঠি, জিন্দাকাঠি, বর্ণপতিকাঠি, আটঘর, কুড়িয়ানা, আন্দাকুল, রায়েরহাট, ব্রাহ্মণকাঠি, ধলহার ও বাউকাঠি। প্রতি মৌসুমে এসব মোকামে দিনে ৫-৭ হাজার মণ পেয়ারা বেচাকেনা হয়।
পেয়ারা চাষের আদি ইতিহাস: ঠিক কবে থেকে দক্ষিণাঞ্চলের মাটিতে পেয়ারা চাষ শুরু হয়েছে, এমন প্রশ্নে স্থানীয়রা জানান, দুইশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা বংশানুক্রমে পেয়ারা চাষ করে আসছেন। তাদের মতে, আনুমানিক ২০০ বছর আগে স্থানীয় কালীচরণ মজুমদার ভারতের ‘গয়া’ থেকে এ জাতের পেয়ারার বীজ এনে এলাকায় বপন করেন। সেই থেকে ছড়িয়ে পড়ছে পেয়ারার চাষ।
তবে প্রবীণ পেয়ারা চাষি ভবেন্দ্রনাথ হালদার জানান, আগে বিচ্ছিন্ন আবাদ হলেও ১৯৪০ সাল থেকে শুরু হয়েছে পেয়ারার বাণিজ্যিক আবাদ। এ আবাদ ক্রমশ বাড়ছে। ২০১০ সালে এক হাজার ৯৩২ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক পেয়ারার আবাদ হয়। এসময় ফলন হয়েছে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমান পেয়ারার উৎপাদন পৌঁছেছে ৩০ হাজার মেট্রিক টনে।
চাষি পঙ্কজ বড়াল জানান, পেয়ারা গাছে তেমন কোনো সার বা আলাদা করে কিছু দেওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু পরিচর্যাই যথেষ্ট। সারা বছর তেমন কোনো কিছু করার দরকার হয় না। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসেই পেয়ারা গাছে ফুল আসতে শুরু করে। তবে বৃষ্টি শুরু না হলে পেয়ারা পরিপক্ব হয় না। জমি ভালো হলে হেক্টরপ্রতি ১২-১৪ মেট্রিক টন পেয়ারা উৎপাদন হয়।
‘সবুজ আপেল’ যায় বিদেশেও: দেশের চাহিদা মিটিয়ে ব্রাজিল, পর্তুগিজ, কলম্বিয়া, মেক্সিকো, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে এখানকার পেয়ারা। পেয়ারার সবচেয়ে বড় মোকাম সদর উপজেলার ভীমরুলী ভাসমান পেয়ারার হাট। এ হাটের পাইকারি ব্যবসায়ী হারুন খান জানান, তিনি মোকাম থেকে সিজনে প্রতিদিন ৩-৪ মণ পেয়ারা সিলেটে বড় ব্যবসায়ীদের কাছে পাঠান। সেখান থেকে এ পেয়ারা যায় বিদেশে। শুধু ভীমরুলীর হাট নয়, প্রতিটি মোকাম থেকেই পেয়ারা বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। বিদেশের বাজারে এ রসালো পেয়ারার চাহিদা ব্যাপক। মৌসুমে চাঁদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রলার, নৌকা ও ট্রাকে পেয়ারার চালান নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা।
ফলন কম, লোকসানে চাষিরা: চলতি বছর পেয়ারার ফলন কম হয়েছে বলে জানায় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। অনাবৃষ্টির কারণে অনেক মুকুল ঝরে গেছে। এ কারণে ফলন কম হয়েছে। ছবি তুলতে দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করে জিন্দাকাঠির পেয়ারা চাষি রনজিৎ কুমার বলেন, ‘ছবি দিয়া কী হইবো? ছবি করলে গইয়াও (পেয়ারা) লজ্জা পায়। বাঁচার পথ থাকলে হেইয়ার (তার) পদ্ধতি করেন।’
কাপুড়কাঠি গ্রামের সুনীল মণ্ডলের পেয়ারার বড় বাগান রয়েছে। তার বাগান থেকে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মণ পেয়ারা হাটে ওঠে। ৪০০ টাকা মণ দরে এসব পেয়ারা বিক্রি করে ১২ হাজার টাকার মতো আয় হয়। এ আয় থেকে ১০ জন পেয়ারা সংগ্রহকারীকে রোজ দিতে হয় ছয় হাজার টাকা। সঙ্গে রয়েছে পরিবহন ব্যয়। সবমিলিয়ে প্রতিদিনই লোকসান গুনছেন সুনীল মণ্ডল। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩৬ গ্রামে পেয়ারা চাষ হলেও বর্তমানে ৫৫ গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। কাগজে-কলমে ৩০ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদনের হিসাব থাকলেও হিসাবের বাইরে আরও কয়েক হাজার টন পেয়ারা উৎপাদন হয় বলে চাষিরা জানিয়েছেন।
স্থানীয় পেয়ারা চাষি মুকুন্দ ঘরামী বলেন, ‘এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। কৃষি ব্যাংক সামান্য পরিমাণ ঋণ দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল সামান্য। বিদ্যুৎ সরবরাহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলেও বিনিয়োগকারীরা এখানে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।’ পর্যটক ব্যবসায়ী নিশীথ হালদার শানু ও গৌতম মিস্ত্রি বলেন, পেয়ারা মৌসুম ঘিরে দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক আসেন এখানে। আগে শুধু নৌপথে আসতেন তারা। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে।
পেয়ারা চাষি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ভবেন হালদার জানান, চাষাবাদে দরকার স্বাভাবিক মাত্রায় বৃষ্টি। কিন্তু চলতি বছর গাছের পরিচর্যা সঠিকভাবে করা হলেও বৃষ্টি না থাকায় যে পরিমাণ ফুল এসেছিল তার বেশিরভাগই ঝরে গেছে। এখন গাছে যে পরিমাণ ফল হয়েছে তাতে ভালো দাম পাচ্ছি, কিন্তু এ টাকায় খরচ উঠছে না। আমাদের লোকসান হচ্ছে।’ এ বিষয়ে ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মনিরুল ইসলাম বলেন, জেলার হাজার হাজার মানুষের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ও জীবিকার অবলম্বন পেয়ারা। পদ্মা সেতুর কারণে সড়ক পথে দিনের মধ্যেই পেয়ারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে। তবে এবার ফলন কম হলেও চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন বলে জানান তিনি।- জাগো নিউজ