হিমাগার ও মজুতদারদের কারসাজিতে বাজারে আলুর অস্বাভাবিক দাম- এমন প্রতিবেদন খোদ সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের। গত জুলাই মাসে ওই প্রতিবেদন কৃষি মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিল সংস্থাটি। এরপর গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ওই মাসে আরেক দফা বৈঠকও হয়েছে। অবৈধ মজুতদারদের তথ্য দেওয়া হয়েছে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরসহ (ডিজিএফআই) অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও। এরপরও নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ। সে কারণে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে সাধারণ মানুষকে অস্বাভাবিক বাড়তি দামে আলু কিনতে হচ্ছে। আর ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে সিন্ডিকেট।
জানা গেছে, বাংলাদেশে আলুর সরবরাহ ও মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে গত ১০ জুলাই কৃষি মন্ত্রণালয়কে জমা দেওয়া ওই প্রতিবেদনে কৃত্রিমভাবে আলুর বাজার অস্থির করার চেষ্টার কারণে অসাধু ব্যবসায়ীদের সরকারি বিভিন্ন তদারকি সংস্থা ও পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে সুপারিশ করা হয়। কোনো কর্তৃপক্ষ যদি কোনো সিন্ডিকেটের তথ্য দেয় তবে অবশ্যই সেটা আমরা ব্যবস্থা নেই। এমন কোনো প্রতিবেদন আমাদের কাছে আসেনি। হয়তো কোনো কারণে মাঝপথে আটকে গেছে
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি মৌসুমে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ হয়েছে ১০ টাকা ৫০ পয়সা। চাষিরা এ আলু বাজারে সর্বোচ্চ ১৫ টাকার মধ্যে বিক্রি করেছেন। এখন (জুলাই) দেশের ৩৬৫টি হিমাগারে ২৪ লাখ ৯২ হাজার টন আলু সংরক্ষণ করা রয়েছে। কৃষকের হাতে আলু শেষ হওয়ার পর জুন থেকে হিমাগারের আলু বাজারে সরবরাহ আসতে থাকে। কিন্তু এ সরবরাহ ঠিকভাবে হচ্ছে না। কৃত্রিমভাবে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী আলুর দাম বাড়াচ্ছেন। এর মধ্যে হিমাগার মালিকরা চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত পরিমাণ আলু বাজারে ছাড়ছেন।
জানা যায়, এবছর দেশে আলু উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ১১ লাখ টন, যেখানে স্থানীয় চাহিদা ৯০ লাখ টন। চাহিদার বিপরীতে প্রায় ২২ লাখ টন আলু বেশি উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। অথচ পাইকারি পর্যায়ে আলুর দাম সব খরচ মিলে কোনোভাবে ২৪ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়, যা খুচরায় এসে সর্বোচ্চ ৩২ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হবে। যদিও বাজারে এখন সর্বনিম্ন ৪০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হচ্ছে। কখনো কখনো আলু কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকা কেজিতেও।
ওই প্রতিবেদন দেওয়ার পর দেড়মাস পেরিয়ে গেছে। বাজারের তথ্য বলছে, এখনো আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে দেশের কোনো বাজারে অভিযান চালানো হয়নি, কোনো হিমাগারেও তদারকি করতে দেখা যায়নি। এর মধ্যে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে বাজারে কিছু অভিযান চললেও আলুর ক্ষেত্রে চোখ এড়িয়ে গেছে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো।
এ বিষয়ে কথা হয় কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাসুদ করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গত কোরবানি ঈদের পর বাজারে আলুর দাম অস্বাভাবিক বাড়তে থাকায় ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে কৃষি বিপণনের কিছু করণীয় নেই। এটা সরকারের অন্য সংস্থার কাজ। সেসব প্রতিষ্ঠানকে এটা জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই।’
এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিবের উপস্থিতিতে একটি বৈঠকও হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা রেজা শাহবাজ হাদী। তিনি বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সেটি সংবাদমাধ্যমে আসে। এরপর পিএম অফিসে (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) এ নিয়ে ৩১ জুলাই মিটিং হয়। সেখানে আমরা কোথায় কী পরিমাণ বাড়তি আলুর স্টোরেজ (মজুত) রয়েছে, সেটা ব্রিফ করেছি। ডিজিএফআই এসেও তথ্য নিয়েছে। এরপর আর কোনো অ্যাকশন হয়নি।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া ওই প্রতিবেদন তদারকি করেছেন পিপিসি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব রুহুল আমিন তালুকদার। সিন্ডিকেট ঠেকাতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে এ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। এদিকে বাজারে অস্থিতিশীল পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থা জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও প্রতিযোগিতা কমিশন। সংস্থা দুটি আলুর সরবরাহ ও মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ধরনের তদারকির নির্দেশনা বা ওই প্রতিবেদন পায়নি।
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘কোন সংস্থা কীভাবে ব্যবস্থা নেবে? কোনো কর্তৃপক্ষ যদি কোনো সিন্ডিকেটের তথ্য দেয় তবে অবশ্যই সেটা আমরা ব্যবস্থা নেই। এমন কোনো প্রতিবেদন আমাদের কাছে আসেনি। হয়তো কোনো কারণে মাঝপথে আটকে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘একতরফা বাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোকে দায় দিলেই হবে না। কৃষি বিপণনের নিজস্ব মাজিস্ট্রেট রয়েছে। তারাও বাজারে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারে। ভোক্তা-অধিকার সব করবে, তাহলে অন্য সংস্থার কোনো দায়িত্ব নেই? আর কোনো ফাইন্ডিংস নিয়ে ঘরে বসে থাকলে লাভ কী? ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে এখন প্রথম শুনলাম।’ ভোক্তা অধিকার সব করবে, তাহলে অন্য সংস্থার কোনো দায়িত্ব নেই? আর কোনো ফাইন্ডিংস নিয়ে ঘরে বসে থাকলে লাভ কী? ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে প্রথম শুনলাম
দিকে আলুর বাজারে সরকারি তদারকির এমন অনীহা প্রসঙ্গে একজন সরকারি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সিন্ডিকেট (সিন্ডিকেটের তথ্য) জেনেও আলুর বাজারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, কারণ হিমাগার ব্যবসায়ীরা বেশ প্রভাবশালী। কেউ কেউ ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তারাই এখন বাজারে অন্যান্য পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন মহলের সঙ্গে সভা-সেমিনারে থাকেন।’
তবে ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই যোগাযোগ করা হলে প্রতিবেদনে তথ্যের ঘাটতি রয়েছে- এমন দাবি করেছিল হিমাগার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটি জানায়, এবছর আলু উৎপাদনের যে তথ্য সরকার দিচ্ছে তা সঠিক নয়। এর চেয়ে ২০ থেকে ২২ শতাংশ কম উৎপাদন হয়েছে। গত বছর সব কোল্ড স্টোরেজ ভরা থাকলেও এবার ২০ শতাংশ পর্যন্ত আলু কম রয়েছে। কৃষকের হাতে যে আলু জুন পর্যন্ত থাকে, সেটা এবার এপ্রিলেই শেষ হয়েছে।
জুলাই পর্যন্ত কোল্ড স্টোরেজে যে আলু ছিল তার মধ্যে ৬০ শতাংশ খাওয়ার এবং ৪০ শতাংশ বীজ আলু। এই ৬০ শতাংশের মধ্যে ১০ শতাংশ কোল্ড স্টোরেজ মালিকদের, ১০ শতাংশ কৃষকের এবং বাকি ৪০ শতাংশ স্টকারদের (মজুতদার)। উৎপাদন কমায় মজুতদাররা বাজারকে প্রভাবিত করছেন। তারাই বাজারে আলু কম ছাড়ছেন, অতিরিক্ত লাভ করছেন। এতে হিমাগার মালিকদের সম্পৃক্ততা নেই।
কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু ওই সময় বলেন, ‘প্রথমত ওই প্রতিবেদনে যত আলু উৎপাদনের কথা বলা হচ্ছে, এবছর ততটা উৎপাদন হয়নি। সরবরাহ কমায় হিমাগার মালিকদের দায় নেই।’
তিনি বলেন, ‘যারা আলু স্টক করেছেন তারা বাজারে চাহিদার তুলনায় কম আলু দিচ্ছেন। আবার প্রতি কেজি আলু কোল্ড স্টোরেজ থেকে মানভেদে ৩০-৩১ টাকায় বিক্রি করছেন। তারাই কেজিপ্রতি ১২ থেকে ১৩ টাকা পর্যন্ত লাভ করছেন। এ কারণেই বাজারে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। হিমাগার মালিক নয়, যারা মজুতদার তারাই বাজার অস্থিতিশীল করেছেন।’- জাগো নিউজ