কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে ১০০ শয্যার হোপ ফিল্ড হসপিটাল ফর উইমেন ১ সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন উখিয়ার ১০টির বেশি আশ্রয়শিবিরের লাখো রোহিঙ্গা নারী। হোপ ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ জানায়, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) অর্থসহায়তা বন্ধ করায় হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। হাসপাতালটি বন্ধ হওয়ায় চিকিৎসক, নার্সসহ অন্তত ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি হারিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। জুলাই-আগস্ট মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে অনেকে আন্দোলনে নামেন। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, ভেতরে কয়েকজন অন্তঃসত্ত্বা নারী চিকিৎসকের অপেক্ষায় বসে আছেন। তাঁদের একজন গোল বাহার (২৫) এসেছেন মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরের সি-৪ ব্লক থেকে। আর রোকেয়া বেগম (১৮) এসেছেন পাশের লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবির থেকে। রোকেয়া প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় তিনি সন্তান প্রসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। কারণ, ৮০ কিলোমিটার দূরে কক্সবাজার শহরের হাসপাতালে যাওয়ার সামর্থ্য তাঁর নেই।
এ সময় হাসপাতাল ভবনের সিঁড়িতে বসে ছিলেন দুই রোহিঙ্গা নারী তসলিমা বেগম (২৮) ও শরিফা আকতার (২৩)। দুই মাস আগে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে দুজনের সন্তান প্রসব করানো হয় এই হাসপাতালে। এখন হাসপাতাল বন্ধ হওয়ায় তাঁরা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। সিঁড়ির এক কোনায় আরেক রোহিঙ্গা তরুণীকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তিনি বলেন, চিকিৎসক না থাকায় সেবা পাচ্ছেন না। তিনি ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এ বিষয়ে আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা কামাল উদ্দিন বলেন, এই আশ্রয়শিবিরে ৭৫ হাজার রোহিঙ্গার বসতি। আশপাশের আরও ১০টি আশ্রয়শিবিরে বসত করছেন ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। যেখানে গর্ভবতী রয়েছেন ৩৩ হাজারের বেশি। ৯০ শতাংশ গর্ভবতী ও প্রসূতির চিকিৎসা চলে এই হাসপাতালে। কিন্তু হঠাৎ হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় লাখো নারী বিপাকে পড়েছেন। অনেকে ঝুঁকি নিয়ে ঘরে ধাত্রীর মাধ্যমে সন্তান প্রসবে বাধ্য হচ্ছেন।
হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ও হোপ ফাউন্ডেশনের ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপক শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ইউএনএফপিএ অর্থসহায়তা বন্ধ করায় হাসপাতালে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সন্তান প্রসব ও অস্ত্রোপচার বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। সেখানে অন্তঃসত্ত্বা নারী, মানসিক রোগী, কিশোরীদের স্বাস্থ্যসহায়তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রকল্প বন্ধ হওয়ায় হাসপাতালের ১৮২ কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি হারিয়েছেন। এর মধ্যে চিকিৎসক ২৬ জন, নার্স ২৪ জন, মিডওয়াইফ ১৯ জন, মেডিকেল সহকারী ৯ জন। বাকিরা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, গত ছয় বছরে এই হাসপাতালে সেবা নিয়েছেন ৪ লাখ ৭২ হাজার ৩৭০ জন। এর মধ্যে সন্তান প্রসবসংক্রান্ত সেবা নিয়েছেন ৭ হাজার ৫২৮ জন। এর মধ্যে স্বাভাবিক সন্তান প্রসব হয়েছে ৮ হাজার ৬৩টি এবং অস্ত্রোপচার হয়েছে ৩ হাজার ৪৬৫টি। তা ছাড়া ৬০ হাজার ৯১৯টি শিশু ও নবজাতক; ২১ হাজার ৮১৩ নারীকে প্রসবকালীন এবং ৮ হাজার ৩৮১ জনকে প্রসব–পরবর্তী সেবা দেওয়া হয়েছে। সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবাই বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। হাসপাতালটিতে অত্যাধুনিক দুটি অপারেশন থিয়েটার (অস্ত্রোপচার কক্ষ), ল্যাব, আলট্রাসাউন্ড, এক্স–রে, ইসিজির যন্ত্র রয়েছে। হাসপাতালটি বন্ধ হওয়ায় মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য সেবা সংকটে পড়বে জানিয়ে কক্সবাজারের সিভিল সার্জন বিপাশ খীসা প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা নাগরিকদের জরুরি মাতৃস্বাস্থ্য সেবার জন্য হাসপাতালটি ভূমিকা রেখে আসছিল। ঝুঁকিপুর্ণ অন্তঃসত্ত্বা নারীদের স্বাভাবিক ও সিজারিয়ান ডেলিভারির একমাত্র নির্ভরযোগ্য হাসপাতাল ছিল এটি। বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে গুরুতর শারীরিক অবস্থার গর্ভবতী মায়েদের এই হাসপাতালে পাঠানো হতো। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় লোকজনও এই হাসপাতালে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য সেবা ছাড়াও কোভিড-১৯, ডেঙ্গু, জলবসন্ত, কলেরা, দন্তরোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে আসছেন। কিন্তু গত ১ আগস্ট থেকে হাসপাতালের বিপরীতে ইউএনএফপিএ আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দিলে সংকট দেখা দেয়। সিভিল সার্জন উল্লিখিত সমস্যার কথা তুলে ধরে এবং হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম দ্রুত চালু করার সুপারিশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর ৫ আগস্ট চিঠি লেখেন। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি কোনো নির্দেশনা পাননি।
টেকনাফ উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, হোপ ফাউন্ডেশনের প্রকল্পটি বন্ধ হওয়ায় উপজেলার হোয়াইক্যং ও সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়োগকৃত চিকিৎসক, চিকিৎসা সহকারী, প্যারামেডিক, ল্যাব টেকনিশিয়ান, ফার্মাসিস্ট, মিডওয়াইফ, আয়া ও নৈশপ্রহরী প্রত্যাহার করা হয়। তাতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতেও সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। কেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম দ্রুত চালু করতে তিনি ১৭ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কক্সবাজার উপপরিচালক বরাবর চিঠি লিখেছেন। হোপ ফাউন্ডেশনকে অর্থসহায়তা বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশে ইউএনএফপিএ’র প্রতিনিধি ক্রিস্টিন ব্লোখাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউএনএফপিএ হোপ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে রোহিঙ্গা শিবির এবং তাদের আশ্রয়দাতা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে কাজ করছিল। সম্প্রতি হোপ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। ইউএনএফপিএ’র অনেক অংশীদার কক্সবাজারে নারী ও কন্যাশিশুদের সেবায় কাজ করছে। সেখানে সেবাদানে যাতে কোনো ঘাটতি না হয় সেজন্য আমরা ওই সব অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি।’
বিপাকে ৩০০ নারী-পুরুষ: উখিয়ার রতœাপালং হোপ বার্থ সেন্টারে মাসিক ১৭ হাজার টাকায় পাঁচ বছর ধরে মিডওয়াইফ সহকারী হিসেবে চাকরি করেন স্থানীয় নারী জ্যোস্না আকতার। চাকরির টাকায় চলত দুই সন্তানের লেখাপড়া ও সংসারের খরচ। তাঁর স্বামী বেকার। জ্যোস্না আকতার বলেন, ১ সেপ্টেম্বর থেকে হাসপাতাল বন্ধ হলেও তিনি জুলাই-আগস্ট মাসের বকেয়া বেতন পাননি। দ্রুত আরেকটি চাকরি না জুটলে সংসারে দুর্যোগ নেমে আসবে। চাকরি হারিয়ে আন্দোলনে নামা স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের মুখপাত্র ও উখিয়ার বাসিন্দা মইন উদ্দিন শাহীন বলেন, ‘আমরা অন্তত ৩০০ মানুষ ৪-৬ বছর ধরে হোপ ফাউন্ডেশনের অধীনে চাকরি করছিলাম। কিন্তু জুলাই ও আগস্ট মাসের বেতন–ভাতা পরিশোধ না করে হঠাৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছাঁটই করে হোপ কর্তৃপক্ষ। এর প্রতিবাদে আমরা আন্দোলন করেছি। পরে হোপ কর্তৃপক্ষ আমাদের লিখিতভাবে জানিয়েছে, তারা ১৫ অক্টোবরের মধ্যে দুই মাসের বেতন পরিশোধ করবে।’ এ বিষয়ে হোপ ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. জাহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, আশ্রয়শিবিরের ভেতরে ১০০ শয্যার হোপ ফিল্ড হাসপাতাল এবং উখিয়া ও টেকনাফের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো ছয় বছর ধরে ইউএনএফপিএর অর্থায়নে পরিচালিত হয়ে আসছিল। কিন্তু ১৯ জুলাই ইউএনএফপিএর পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা হোপ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী নয়। ১ আগস্ট থেকে ইউএনএফপিএ অর্থসহায়তা বন্ধ করে দেয়। তাতে বিপাকে পড়েন প্রকল্পের অধীনে চাকরিরত ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী। পরবর্তী সময়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) মধ্যস্থতায় ইউএনএফপিএ জুলাই ও আগস্ট মাসের অর্থসহায়তা দিতে সম্মত হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জুলাই মাসের বেতন ৩০ সেপ্টেম্বর এবং আগস্ট মাসের বেতন ১৫ অক্টোবর পরিশোধ করা হবে।
আরআরআরসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হোপ ফাউন্ডেশনকে বাদ দিয়ে আরেকটি বেসরকারি সংস্থা দিয়ে কাজ করাতে চায় ইউএনএফপিএ। জুলাই ও আগস্ট—দুই মাসের বেতন–ভাতা আটকে ছিল। ইউএনএফপিএর কান্ট্রি ডিরেক্টরের সঙ্গে তিনি (আরআরআরসি) কথা বলে ওই দুই মাসের সঙ্গে সেপ্টেম্বর মাসের বেতন ভাতাও নিশ্চিত করেছেন। হোপ ফাউন্ডেশনের চকরি হারানো কর্মকর্তা–কর্মচারীরা এখন জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের বেতন-ভাতা পাবেন।