মোহাম্মদপুর সোসাইটি লিমিটেড এলাকার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় নাকে বিশ্রি গন্ধ আসে। খালে ভেসে থাকে কয়েক স্তরের ময়লা। পানির অস্তিত্বই যেন নেই। এই চিরচেনা চেহারাকে মাত্র দুই দিনে পাল্টে দিয়েছে শ খানেক খ্যাপাটে যুবক। উদ্যোক্তা কার্টুনিস্ট মোর্শেদ মিশুকে এখন অনেকেই চেনেন। তরুণদের নিয়ে চমকে দেওয়ার মতো একের পর এক কাজ করে চলেছেন তিনি। এলাকাবাসী বলছেন, এই ময়লার নিচে যে পানি ছিল সেটাই তো ভুলে গিয়েছিলাম! প্রশ্ন হলো- দুই দিনে এমন পরিচ্ছন্ন একটি খাল যাদের উপহার দেওয়া হলো তারা কি পারবেন সেই পরিচ্ছন্নতা ধরে রাখতে?
সরেজমিন দেখা যায়, গত তিন দিনে আবারও ময়লায় ভরে উঠতে শুরু করেছে খাল। ময়লা আবার জমছে ব্রিজের নিচে নিচে। স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার বলছেন, ‘এই খালটি হাজারীবাগ থেকে এদিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বেড়িবাঁধ হয়ে পৌঁছায় নদীতে। কে কোথায় ময়লা ফেলবে তা ঠিক করে রাখা কারোর একার পক্ষে সম্ভব না।’
কিন্তু যুবকেরা প্রমাণ করেছে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। কথা হয় খাল পরিষ্কারের উদ্যোক্তা মিশুর সঙ্গে। তার প্রকল্পের নাম ‘খালে হবে’। কেমন করে এর শুরু হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কয়দিন আগে যখন কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকা শহর ডুবে গেলো তখন একটা ভিডিও ফেসবুকে নজরে এসেছিল। সেটা দেখেই মনে হলো খাল পরিষ্কার করে ফেলতে পারলে কেমন হয়। কারা এর সঙ্গে যুক্ত হতে চান ফেসবুকের মাধ্যমে জিজ্ঞেস করলে প্রায় একশ জন ইচ্ছা পোষণ করেন। এই স্বেচ্ছাসেবকদের কাজে লাগাতে হলে খাওয়া, পানি, খরচের টাকা কোথা থেকে আসবে ভাবতে গিয়ে দেশ বিদেশের বন্ধুদের কাছ থেকে বেশকিছু আর্থিক সহযোগিতা পাই। এরপর স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এলাকার সব পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের আমাদের সঙ্গে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর দুই দিনে আমরা ১ থেকে ৪ নম্বর ব্র্রিজের পুরো অংশ পরিষ্কার করতে সক্ষম হই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যেকোনও দেয়াল, স্থান পরিষ্কারের পর রঙ করে দেই। আমাদের সঙ্গে ছিল এশিয়ান পেইন্ট ও অ্যাওয়ারনেস থ্রি সিক্সটি।’
কী পেলেন পরিষ্কার করতে গিয়ে? জানতে চাইলে মিশু বলেন, ‘মানুষ স্বর্ণালঙ্কার এবং নগদ টাকা বাদে এই খালে ফেলেনি এমন কিছু নেই। বাসার তোষক, কমোড, বসার পাটি, থেকে শুরু করে সব ছিল। শুরুতে আমরা যখন ময়লা টানছিলাম তখন অনেক সময় লাগছিল। পরে সিটি করপোরেশন থেকে ডুবুরি এনে তারা ব্রিজের নিচের অংশে যেসব পাইপ আছে, সেগুলো ফাঁকা করে ময়লা যাওয়ার রাস্তা করে দিলে কাজ একটু সহজ হয়।’ এলাকার এক শিক্ষার্থী রবিন বলেন, ‘এটা অবিশ্বাস্য। আমরা দাঁড়িয়ে থেকে যেভাবে পেরেছি সহযোগিতা করেছি। এই ময়লা যে কোনোদিন সরবে এটা ভাবতেই পারিনি। এর নিচে আসলেই পানি ছিল; এটা আগের ছবি দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। এখন এলাকাবাসীর উচিত এখানে যেন কেউ ময়লা না ফেলে সেই ব্যবস্থা করা।’ এই বিশাল এলাকা পরিষ্কার করতে দুই দিনে খরচ হয়েছে মাত্র ৮৬ হাজার ৫৩০ টাকা। কার কাছ থেকে কত টাকা এসেছে এবং সেটা কীভাবে খরচ হয়েছে সেই হিসাবও দেওয়া হয়েছে ইতোমধ্যে। কাজটির সঙ্গে শুরু থেকেই যোগাযোগ ছিল ওয়ার্ড কমিশনার আসিফ আহমেদ সরকারের। তিনি বলেন, ‘কিছু তরুণ আমাকে এই কাজটি করার কথা অবহিত করলে আমি তাদের সব ধরনের সহযোগিতার কথা জানাই। এই তরুণেরা সবাই শিল্পী। তারা এরকম নানা কাজ করে। এবার খালটা পরিষ্কার করেছে বটে, কিন্তু তিন দিনের মধ্যেই আবার ময়লা জমতে শুরু করেছে।’
কেন এ পরিস্থিতি হলো, আর যাতে ময়লা না জমে সে জন্য কোনও উদ্যোগ তিনি নিতে পারতেন কিনা প্রশ্নে বলেন, ‘খালটি হাজারীবাগ থেকে শুরু হয়ে মোহম্মদপুরের ভেতর দিয়ে বেড়িবাঁধ দিয়ে বের হয়ে গেছে। এই পুরো এলাকায় কে কীভাবে ময়লা ফেলে তা মনিটরিং করা তো সম্ভব নয়। এখানে বাসার নষ্ট ফ্রিজ থেকে শুরু করে সব পাবেন।’ করণীয় কী জানতে চাইলে বলেন, ‘মানুষ সভ্য না হলে কিছু করার নেই।’ যদিও মিশু সেভাবে দেখেন না। তার কথায়, ‘কয়েক স্তরের ময়লা ছিল। পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। দেখলেই মনে হচ্ছে খাল যেন বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছে। মানুষ ময়লা ফেলবে, থামানো যাবে না। কিন্তু পরিষ্কার নিয়মিত করলে কয়েক স্তরের পুরু না হলে এত কষ্ট আর হবে না। সেটা বিবেচনা করা দরকার।’
ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে মিশু বলেন, ‘আগামী দুই বছরের মধ্যে ২০০ এবং ৫ বছরের মধ্যে ৫০০ জায়গা পরিষ্কার করে সুন্দরভাবে রঙ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি। আমাদের এই আন্দোলনকে আপডেটিং সোসিও-ওয়াল নেটওয়ার্ক বলছি।’-বাংলাট্রিবিউন