কুড়িগ্রামের চারণকবি ও প্রবীণ পল্লিকবি রাধাপদ রায়ের (৮০) ওপর হামলার ঘটনার দুই দিন পর একটি মহল এটিকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হামলা দাবি করলেও এই নিয়ে ভিন্নমত কবি ও তার পরিবারের। এটিকে ভিন্নখাতে নিতে নারাজ তারা। পরিবার ও এলাকাবাসী বলছে, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত আক্রোশ ও শত্রুতার জেরে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। কবি, কবিপুত্র ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। স্থানীয় থানা পুলিশ বলছে, নিছক ঘটনায় পূর্বশত্রুতার জেরে এই হামলা। প্রাথমিক তদন্তে অন্য কোনও কিছুর অস্তিত্ব পায়নি পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন।
কবি রাধাপদ রায় কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের মাদাইখাল গোড্ডারাপাড় গ্রামের বাসিন্দা। একসময় পেশায় নির্মাণশ্রমিকের কাজ করা রাধাপদ এক দশক আগে কিশোরগঞ্জের মন্দিরে থাকতেন। সেখানেই তিনি কবিতা ও ছন্দের চর্চা শুরু করেন। স্বভাবকবি খ্যাত এই প্রবীণ মূলত বিগত ৫-৬ বছর পূর্বে পল্লিকবি হিসেবে পরিচিতি পান। স্ত্রী, তিন মেয়ে ও তিন ছেলে নিয়ে তার পরিবার।
হামলাকারী কে? কবির ওপর হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত যুবকের নাম রফিকুল ইসলাম (৩৫)। পেশায় দিনমজুর অভিযুক্ত যুবক একই ইউনিয়নের কচুয়ারপাড় গ্রামের মৃত মোহাম্মদ আলীর ছেলে। তার বড় ভাই কদুর রহমানের সঙ্গে গত ছয় মাস আগে কবি রাধাপদের বাগবিত-া হয়। তিনিও পেশায় দিনমজুর। এলাকায় খোঁজ নিয়ে এই দুই ভাইয়ের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তারা এলাকায় শ্রমিকের কাজ করে জীবন নির্বাহ করেন।
কেন কবি রাধাপদের ওপর হামলা? হামলায় আহত কবি রাধাপদ রায় গত পাঁচ দিন ধরে নাগেশ্বরী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। ৩০ সেপ্টেম্বর (শনিবার) সকালে কবির বাড়ির পশ্চিমে ডুবুরির ব্রিজের পাশে রফিকুল নামে এক যুবক তার ওপর আকস্মিক হামলা করেন। হামলায় তার পিঠে ও ঘাড়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। কবি রাধাপদ রায় এবং তার ছেলে জুগল চন্দ্র জানান, প্রায় ছয় মাস আগে উপজেলার হাশেমবাজার এলাকার মিলন নামে এক যুবক রাধাপদের বড় ছেলে মাধব রায়কে ঢাকায় কাজ করতে নিয়ে যান। ঢাকা থেকে ফিরে আসার পর তাদের দুই জনের মধ্যে লেনদেন নিয়ে ঝামেলা চলছিল। এ নিয়ে একদিন মিলন রাধাপদের বাড়িতে এলে পাওনা টাকা নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। ওই দিন বাড়ির কাছে অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচির মাটি কাটার কাজ করছিলেন কদুর রহমান ও রফিকুলসহ বেশ কয়েকজন শ্রমিক। রাধাপদের বাড়ির আঙিনায় চলা আলোচনায় কদুর রহমান এগিয়ে গিয়ে মিলনের হয়ে কথা বলেন।
তারা জানান, এতে রাধাপদের স্ত্রী নিয়তি রাণী কদুরকে না জেনে অযাচিত কথা বলতে বারণ করেন। এ সময় কদুর রহমান তাকে উদ্দেশ করে অশ্রাব্য গালি দিলে রাধাপদ প্রতিবাদ করে তাকে মারতে উদ্যত হন। উপস্থিত লোকজন তাদেরকে নিবৃত্ত করেন। ভাইকে মারতে উদ্যত হওয়ায় এর প্রতিশোধের হুমকি দেন রফিকুল। ছয় মাস আগের সেই ঘটনার জের থেকে গত শনিবার সকালে সুযোগ বুঝে হামলা করেছেন বলে ধারণা করছেন রাধাপদ ও তার পরিবারের সদস্যরা।
রাধাপদ রায় বলেন, ‘রফিকুলের সঙ্গে আমার কোনও বিরোধ নেই। তবে তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে ছয় মাস আগে আমার তর্কাতর্কি হয়েছিল। তাকে মারতে উদ্যত হয়েছিলাম। এ নিয়ে তার বড় ভাইয়ের ইন্ধনে আমার ওপর হামলা করে থাকতে পারে।’ রাধাপদের ছেলে ও মামলার বাদী জুগল চন্দ্র বলেন, ‘সেসময় রফিকুল ছয় মাস কিংবা এক বছর পর হলেও প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। ওই ঘটনার জেরেই বাবার ওপর হামলা করেছে বলে আমাদের ধারণা। এখানে অন্যকিছু নেই।’
সাম্প্রদায়িক কিংবা ধর্মীয় মতবিরোধ প্রশ্নে জুগল বলেন, ‘এ ধরনের কিছু নেই। যারা বলছেন তারা সঠিক বলছেন না। এলাকায় আমাদের সঙ্গে কারও বিরোধ নেই। আমরা হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে থাকি।’ জীবন সায়াহ্নে উপস্থিত প্রবীণ বাবার ওপর হামলার ঘটনায় এই ছেলে বলেন, ‘আমাদের তিন ভাইয়ের কাউকে মারলেও এত কষ্ট পাইতাম না। কিন্তু বৃদ্ধ বাবাকে মারছে, এতে খুব কষ্ট পাইছি। বাবা কোমরেও ব্যথা পাইছেন। এটা নিয়া কষ্টে আছেন।’
এদিকে হামলার ঘটনায় কদুর রহমান ও রফিকুলকে আসামি করে গত রবিবার (১ অক্টোবর) রাতে মামলা নথিভুক্ত করেছে পুলিশ। ঘটনার পর থেকে দুই আসামি পলাতক থাকলে সবুধবার সকালে রফিকুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে সোমবার রাতে কদুর রহমানের স্ত্রী, শ্যালক ও শ্বশুরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেয় পুলিশ। পরে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তাদের ছেড়ে দেয়।
তৎপর পুলিশ ও প্রশাসন: ঘটনার পর সামাজিকমাধ্যমে কবির ওপর হামলার সমালোচনা ও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে নড়েচড়ে বসে পুলিশ ও প্রশাসন। নাগেশ্বরী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তারা প্রত্যক্ষদর্শী ও রাধাপদের স্ত্রীর বক্তব্যও নিয়েছেন। এ ঘটনায় পূর্বশত্রুতা ছাড়া অন্য কিছুর আলামত পায়নি পুলিশ। সহকারী পুলিশ সুপার (নাগেশ্বরী সার্কেল) সুমান রেজা বলেন, ‘হামলার শিকার কবি ও তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। এলাকায় গিয়ে খোঁজ খবর নিয়েছি। ছয় মাস আগের দ্বন্দ্বের জের ছাড়া আমরা এখনও কিছু পাইনি। মামলার এজাহারেও তাই বলা হয়েছে। এ ঘটনায় পেশা, ধর্ম কিংবা সাম্প্রদায়িকতার কোনও বিষয় নেই।’ নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাউছার আহামেদ বলেন, ‘আমরা সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে ছয়মাস আগের দ্বন্দ্ব ছাড়া অন্য কিছু পাইনি। আমাদের অন্যান্য সোর্স থেকেও এর বাইরে কিছু পাওয়া যায়নি।’-বাংলাট্রিবিউন