বাংলাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কর্মসংস্থানেরও ৪০ শতাংশের বেশি কৃষি খাতে। সেবা ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ার ফলে কৃষির অবদান শতাংশ হারে কমেছে ঠিক, তবে খাদ্য উৎপাদনে ধারাবাহিক অগ্রগতি ও কর্মসংস্থানে অবদান রাখায় অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা অপরিবর্তিত রয়েছে। ২০০৮-০৯-এর বৈশ্বিক মন্দার সময়ও কৃষি খাত রিয়েল ইকোনমিতে অর্থায়নের কৌশল অবলম্বন করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছিল। সম্প্রতি মহামারীর কারণে শিল্প ও সেবা খাত তছনছ হয়ে প্রবৃদ্ধি তলায় নেমে গেলেও কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বেড়েছে।
দেশের কৃষির এই সফলতার মূল কারিগর কৃষক। তবে কৃষি গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণবিদ এমনকি সরকারের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। দেশ গড়ার এই নীরব কারিগর কৃষকরা কেবল কৃষিতে ভূমিকা রেখে ১৮ কোটি মানুষের ক্ষুধার অন্ন জোগান এমন নয়; বরং অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে কৃষকের রয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা। এর মধ্যে অন্যতম, দেশের প্রধান রফতানি খাত গার্মেন্ট সেক্টরের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা ওই দরিদ্র কৃষকের সন্তান। বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানো প্রবাসী শ্রমিকদের প্রায় সবাই কৃষকেরই সন্তান। অথচ আমদানি-রফতানির নামে আন্ডার/ওভার ইনভয়েসিং করে ডলার পাচার করে শিল্পপতিরা। দেশের গ্রিন অর্থাৎ বাতাসের অক্সিজেনের একচ্ছত্র উৎপাদনকারী কৃষক; অন্যদিকে একচ্ছত্র কার্বন উৎপাদনকারী শিল্পপতিরা। বলতে গেলে কৃষকই বাঁচিয়ে রাখছে দেশের অর্থনীতি। তবে আজকের আলোচনা কেবল কৃষকের ঋণ দেয়া-নেয়া নিয়ে। কৃষকদের সফলতার বেশির ভাগ নিজস্ব অর্থায়নে হলেও অনেক সময় কৃষকও জরুরি প্রয়োজনে ঋণ নেন। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঋণ পেতেও কৃষকদের অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে অনৈতিক সুবিধাও দিতে হয়। বাহ্যত কিছু ক্ষেত্রে কৃষি ঋণের সুদের হার কম হলেও বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা প্রদানের ফলে সুদের হার অনেক বেড়ে যায়। সত্যি যে, ব্যাংক থেকে কৃষকরা ঋণ পান সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ সুদে। অথচ এনজিওর মাধ্যমে নেয়া ঋণের সুদ দাঁড়ায় ২৫-৩০ শতাংশে। অধিকন্তু দেশের মোট ঋণের স্থিতির একটি সামান্য অংশ কৃষক ঋণ পেয়ে থাকে।
দেশের ব্যাংকঋণের প্রায় ৯০ শতাংশই বড় শিল্প, ব্যবসায় ও সেবা খাতের সাথে সম্পৃক্ত। টাকার অঙ্কে শিল্প খাতের মেয়াদি ঋণের স্থিতি চলতি বছরের জুন শেষে ছিল ১৪ লাখ ৯৪ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছর শেষে ব্যাংকিং এই ঋণের মধ্যে ঝুঁঁকিপূর্ণ ছিল তিন লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। ২০২২ সাল শেষে মোট অনাদায়ী ঋণ ছিল ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা। সেই হিসাবে মোট ঋণের চার ভাগের এক ভাগই ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলো এখন নিজেরাই নিজেদের ঋণ পুনঃতফসিল করছে। ফলে ব্যাংক নিজেই খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে। বাস্তবে খেলাপি ঋণ আরো বেশি হতে পারে। অনেক ব্যাংক ঋণ আদায় করতে না পেরে তারল্য-সঙ্কটে ভুগছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, এই ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশই খেলাপি। টাকার অঙ্কে খেলাপি ঋণ এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই (জানুয়ারি-মার্চ) বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। এই খেলাপি ঋণের ৫৫ শতাংশই শিল্প খাতের। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে জাহাজ ভাঙা ও নির্মাণ খাত। এ খাতে বিতরণকৃত ঋণের ২২ দশমিক ৪৩ শতাংশই এখন খেলাপি। এ ছাড়া তৈরী পোশাক খাতে খেলাপি ঋণের হার ১১ দশমিক ১২ শতাংশ, বস্ত্র খাতে ১১ দশমিক ৫৪ ও চামড়া শিল্পের ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ ঋণখেলাপি। খেলাপি হওয়া ঋণের বেশির ভাগই বড় গ্রাহকদের নেয়া।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে খেলাপি ঋণ এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা হলেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে তা প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। কারণ আইএমএফ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ, সন্দেহজনক ঋণ ও আদালতের আদেশে খেলাপি স্থগিতাদেশ থাকা ঋণও খেলাপি দেখানোর পক্ষে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ এসব ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে জড়িত থাকে। এসব ঋণ আর ফেরত আসছে না। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হচ্ছে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। গত ক’বছরে আর্থিক খাতে নানা রকম কেলেঙ্কারি ঘটেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। যেসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি, সেগুলো তারা এড়িয়ে যায়। যারা ভালো কাজ করে সেইসব ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো সুবিধা তো পায়ই না; বরং অনেক বিড়ম্বনার শিকার হয়। অন্যদিকে, যারা মন্দ অথচ ক্ষমতাসীন তাদের বিষয়ে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেয় না। খেলাপি এসব বড় গ্রাহক ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিলেও আইনি প্রক্রিয়ারও বাইরে থেকে যাচ্ছেন। দেশের কৃষকরা ঋণ গ্রহণ এবং পরিশোধে বড় ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিদের চেয়ে ব্যতিক্রম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, দেশের কৃষকরা ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণ নিচ্ছেন, সুদসহ তার চেয়ে বেশি পরিশোধ করছেন। দেশের মোট ঋণের মাত্র ৫২ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা ছিল কৃষি খাতে। এর মধ্যে কেবল গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) কৃষকরা ৩২ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। সে হিসাবে ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে কৃষকরা পেয়েছেন মাত্র ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। বিপরীতে তারা পরিশোধ করেছেন ৩৩ হাজার ১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ দেশের মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে কৃষি খাতের অংশ মাত্র ২ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর আগেও কৃষকরা ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের চেয়ে বেশি পরিশোধ করেছেন। এমনকি কোভিড-১৯ সৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যেও কৃষি খাতে ঋণ বিতরণের চেয়ে বেশি আদায় হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। ওই বছর কৃষকরা ২৭ হাজার ১২৪ কোটি টাকা ব্যাংককে পরিশোধ করেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ব্যাংকের ঋণ খেলাপের সংস্কৃতির মধ্যেও কৃষকরা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছেন। প্রকৃত কৃষক কখনই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হন না। করোনার সময় নীতি ছাড়ের মধ্যেও তারা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেছেন। অন্যদিকে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বড় বড় শিল্প গ্রুপ ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এটি ভালো লক্ষণ নয় যে বড়রা ঋণ পরিশোধ করে না। এই অভ্যাস হঠাৎ করে নয়; বরং ধারাবাহিকভাবে এসেছে এবং এটি নীতিমালার ব্যর্থতা।’ তিনি আরো বলেন, ‘একাধিকবার ঋণ পুনঃতফসিলের চর্চা ব্যাংকিং খাতে সম্পদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টির কারণ।’ তার মতে, ‘এটি খেলাপিদের উৎসাহ দেয় এবং এটি ভুল প্রণোদনা। বিশ্বের কোথাও এমনটি ঘটে না। এটি কখনোই সমস্যা সমাধান করে না।’ সানেমের আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ‘পুনঃতফসিল করা ঋণ ফেরত না পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।’ তিনি বলেন, ‘এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার সহজ উপায় নেই। সরকার কিভাবে এই পরিমাণ অর্থ তুলে আনবে সেটিই বিবেচ্য। এ ক্ষেত্রে কৃষকরা ব্যতিক্রম।’
খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “কৃষিসহ ছোট ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ বেশ ভালো থাকে। এ শ্রেণীর গ্রাহকরা কথা শোনে। তারা মামলাকে বেশ ভয় পায়। নিজের ও পরিবারের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু বড়দের ক্ষেত্রে এটি একেবারেই ভিন্ন। তারা ঋণ নেয় না দেয়ার জন্য। এদের ‘মাসল পাওয়ার’ বেশি। এই বড় ঋণখেলাপিদের ঋণ নিয়ে সমালোচনা আছে যে তারা এই ঋণগুলো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নেয়নি। কোনো না কোনো সম্পর্ক কিংবা প্রভাবের কারণেই তারা ঋণ পেয়েছেন। এমন গ্রাহকরা আইন-আদালতকে তোয়াক্কা করেন না। এ কারণে বড় গ্রাহকদের বিরুদ্ধে মামলা করেও ঋণ আদায়ের নজির খুব কম। জামানত যথাযথ থাকলে তবেই কিছু ঋণ আদায় হয়। জামানতের সম্পত্তি ঠিক না থাকলে বড়রা ঋণ পরিশোধের চিন্তাও করে না।”
কৃষকদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হলো, দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক প্রান্তিক কৃষকদের কাছে ঋণ পৌঁছার সক্ষমতাই তৈরি করতে পারেনি। এ কারণে ব্যাংকগুলো কৃষি খাতের ঋণের ৫০-৮০ শতাংশ এনজিওকে দিয়ে দিচ্ছে। সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছে ১০ শতাংশ ঋণ। কৃষি খাতের এই মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশ দিয়েছে দুই ব্যাংক-বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। বিশেষায়িত এ দু’টি ব্যাংক কৃষকদের মধ্যে সরাসরি ঋণ বিতরণ করে। এর মধ্যে কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশ। আর রাকাবের খেলাপি ঋণের হার ১৬ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সুপারনিউমারি অধ্যাপক আলী হোসেন প্রধানিয়া বলেন, ‘গত দেড় দশকে বিকেবি ও রাকাব কৃষি খাতে বড় কিছু ঋণ বিতরণ করেছিল। সেগুলো আর ফেরত আসেনি। খেলাপি হওয়া প্রায় এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার বড় ঋণ বাদ দিলে কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশের নিচে থাকত। বড় কিছু ঋণ প্রভাবশালীরা বাগিয়ে নিয়েছেন। প্রকৃত কৃষকরা ব্যাংকঋণের শতভাগই ফেরত দিচ্ছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ অপ্রত্যাশিত কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কেউ কেউ খেলাপি হন।’
বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষি ও এসএমই খাতের জন্য বেশ কিছু পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে। ফলে দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোও কৃষি খাতে ঋণ বিতরণে আগ্রহী হয়েছে। আশা করা যায়, পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকে দেশের কৃষক ও প্রান্তিক ছোট উদ্যোক্তারা উপকৃত হবেন, উপকৃত হবে দেশ এমনকি উপকৃত হবে ব্যাংকের ব্যবসায়।সংকলিত লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট Mizan12bd@yahoo.com