নরিল্যা দুধের বাজারে ব্যস্ততার শুরু কাকডাকা ভোর থেকেই। কর্মচাঞ্চল্য চলে সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত। এর মধ্যে কেউ দোহন করেন দুধ, কেউ গোসল করান গরুকে, কেউ বা ব্যস্ত সময় পার করেন ঘাস কাটায়। দিনভর এমন চিত্র দেখা যায় ধনবাড়ী উপজেলার ধোপাখালি ইউনিয়নের সুনিবিড় গ্রামে নরিল্যা , যেখানে জীবন মানে গাভী লালন-পালন আর দুগ্ধ উৎপাদন। এই গ্রামের পরিবার সরাসরি যুক্ত দুগ্ধ উৎপাদনে। গ্রামের বাসিন্দারা প্রতিদিন ৬ হাজার লিটার দুধ বিক্রি করেন। সব পাড়ায় সকাল-বিকেল দুধ নিতে আসেন পাইকাররা। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার নরিল্যা গ্রামের দুগ্ধ শিল্পের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। দিন দিন এ উপজেলায় নতুন নতুন দুগ্ধ খামার গড়ে উঠছে। কম খরচে অধিক মুনাফা আসায় লক্ষাধিক নারী-পুরুষ এ পেশা বেছে নিয়েছেন। অক্লান্ত পরিশ্রমে তাদের ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন করেছেন।
ছোট বড় প্রায় ১০টি দুগ্ধ সমবায়ী ও খামার গড়ে উঠেছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিপুল পরিমাণে দুধ বিভিন্ন জেলায় এবং রাজধানীতে সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে খামারিরা বেশি অর্থ উপার্জন করছেন। অনেকে শুধু গো খামার করে স্বনির্ভর হয়ে উঠছেন। বর্তমানে শিক্ষিত যুবকেরা গাভী পালনের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। এতে দারিদ্র্য দূরীকরণসহ ব্যাপক পুষ্টির চাহিদাও মিটানো সম্ভব হচ্ছে। স্থানীয় নরিল্যা গ্রামের কৃতি সন্তান সফল খামারি ধনবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব হারুনার রশিদ হীরা জানায়, ধনবাড়ী উপজেলায় বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৬০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে। তবে বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা আরও বেশি। তবে এর বেশির ভাগই উৎপাদন হচ্ছে এই নরিল্যা গ্রামে। এসব খামারে উন্নত জাতের গাভী রয়েছে প্রায় তিন থেকে চার হাজার। প্রতিদিন এলাকার চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত দুধ মিল্কভিটা, প্রাণ, ব্র্যাক, আড়ংসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সরাসরি ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করা হচ্ছে। ধনবাড়ী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে নরিল্যা গ্রাম। ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ১৫০টি পরিবারে প্রায় এক হাজার লোকের বসবাস। মানুষের প্রধান কাজ কৃষি ও গরু পালন। এখানে রয়েছে প্রায় ১৫০টি দুগ্ধ খামার। খামারগুলোতে জার্সি, ফ্রিজিয়ান, শাহিওয়াল, হলেস্টাইনসহ বিভিন্ন জাতের গরু রয়েছে। এরমধ্যে জার্সি, ফ্রিজিয়ান ও শাহিওয়াল গরুর সংখ্যা বেশি। এখানে যত গরিব পরিবারই থাকুক না কেন তাদের কম পক্ষে ৪ থেকে ৫ টি গরু রয়েছে। আর ধনী পরিবারের রয়েছে ৩০ থেকে ৫০ টি গরু। ধনবাড়ী উপজেলা দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সভাপতি নরিল্যা গ্রামের বাসিন্দা মো: আনুয়ার হোসেন জানান, ছোটবেলা থেকেই গরুর প্রতি ভালোবাসা বেশি। ক্লাস শেষে স্কুলের পাশে গরু বাঁধা থাকলে সেই গরু খেয়েছে কিনা তার প্রতি খেয়াল রাখতেন। মনে প্রাণে ভাবতেন, একদিন বড় হয়ে অনেক গরু পালবেন, সেই থেকে শুরু। তিনি এখন বড় একটি খামারের মালিক। দুধ বিক্রি করে এখানকার মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই গ্রাম এখন জেয়ালা দুগ্ধপল্লী নামে পরিচিতি পেয়েছে। তবে এখানে ড্রেনেজ ব্যবস্থার সমস্যা রয়েছে। যে কারণে এলাকার বাসিন্দারা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন। নরিল্যা গ্রামের বাশিন্দা শামছুল আলম প্রতিদিন প্রায় ২০০ লিটার দুধ বিক্রি করেন। তিনি জানান, পুরো গ্রামে কয়েক হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হলেও এখানে নেই সংরক্ষণাগার। এতে ফলে বিদ্যুৎ চলে গেলে কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে পাইকাররা না এলে দুশ্চিন্তায় থাকেন খামারিরা। দুগ্ধ সংরক্ষণাগার স্থাপনে সরকারি সহায়তা চেয়েছেন গ্রামের বাশিন্দা দের পক্ষে আলম। নরিল্যা গ্রামের বাশিন্দা গরু খামারি ইঞ্জিনিয়ার দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘নরিল্যা শান্তিপূর্ণ একটি গ্রাম। এখানে কারও সঙ্গে কারও বিরোধ নেই। সবাই তাদের গাভী ও বাছুর নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেন, তবে এই এলাকায় একটি সমস্যা আছে। ‘এত হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হলেও এখানে হিমায়িত করার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। আমরা আশা করব জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বিষয়টি আমলে নিয়ে এই শিল্পটাকে এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করবে।’