সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ পূর্বাহ্ন

স্মার্টনেস, আধুনিকতা ও ইসলাম

জাফর আহমাদ:
  • আপডেট সময় শনিবার, ৬ জানুয়ারী, ২০২৪

সাধারণ পরিভাষায় যাকে আমরা আধুনিকতা বা স্মার্টনেস নামে অভিহিত করি ইসলামে একে মুহসিন বা পরিশীলিত বলা হয়। ইসলামের মুহসিন এসেছে আরবি ইহসান শব্দ থেকে কর্তৃবাচ্য হিসেবে। আর ইহসান এসেছে হুসনু শব্দ থেকে, যার অর্থ হলো- সুন্দর। সুন্দর কথা, সুন্দর কাজ, সুন্দর আচার-আচরণ, সুন্দর ব্যবহার, সুন্দর পোশাক যা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, রুচিসম্মত ও পবিত্র, সুন্দর লেনদেন, সুন্দর ইবাদত-বন্দেগি, এককথায় সুন্দর জীবন যাপন করার নাম ইহসান, যিনি এগুলো করেন তিনি মুহসিন। মুহসিনকে আল্লাহ অত্যন্ত ভালোবাসেন। আল কুরআনের একাধিক স্থানে এই ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে- ‘তোমরা ইহসান করো, কেননা আল্লাহ তায়ালা ইহসানকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা বাকারাহ-১৯৫) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ইহসানকারীদের সাথে আছেন।’ (সূরা আনকাবুত-৬৯) আধুনিক পরিভাষায় এরই নাম স্মার্টনেস, পরিশীলিত বা আধুনিকতা। এই একটি শব্দের মাধ্যমে ইসলাম যে চির আধুনিক, অটো আপডেটেড ও যুগোপযোগী এর জানান দেয়।
ইহসান শব্দের ব্যাখ্যা থেকেই জানতে পারবেন ইসলাম কোনো সেকেলে জীবনব্যবস্থা নয়। ইসলাম চির আধুনিক এক জীবনব্যবস্থার নাম। ইহসান মানে সুচারুরূপে কোনো কাজ করা। একটি কাজের আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা করে দিলেই অর্ডার পালিত হয়েছে এতে আপনি একজন সাধারণ মুসলিম হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারেন, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু নিজেকে মুহসিন দাবি করতে পারবেন না। মুহসিন দাবি করতে হলে আদেশ পালনের সাথে আরো কিছু অতিরিক্ত কাজ আপনাকে করতে হবে। তা হলো- আদেশটি অবশ্যই সুচারুরূপে পালন করতে হবে। যেই কাজের আদেশ করা হয়েছে তা মনের মাধুরি মিশিয়ে, ভালোবাসার সংযোগ ঘটিয়ে, নিজের সব যোগ্যতাকে ঢেলে দিয়ে, সব উপায়-উপকরণ তার পেছনে নিয়োজিত করে ও মন-প্রাণ উজাড় করে সুচারুরূপে ও সুন্দরভাবে পরিশীলিতার সাথে সুসম্পন্ন করার কারণে তিনি একই সাথে মুসলিম ও মুহসিন।
মানুষের জীবন যত বড় ইহসানের পরিধি ও ভূমিকাও তত বড়। ইহসান ছাড়া মানুষের জীবন সুন্দর হয় না। মানুষের জীবন ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যাপৃত। এই বিস্তর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইহসানের ভূমিকাও সমানভাবে প্রযোজ্য। জীবনের প্রতিটি স্তরে ইহসান যদি কার্যকর থাকে তাহলে জীবনের এই প্রতিটি ক্ষেত্রই ফুলে-ফলে সুশোভিত হতো; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উপরের কোনোটির ক্ষেত্রেই ইহসান নেই। আর ইহসান নেই বলেই অসুন্দর তার জায়গা দখল করেছে। ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই অশান্তি লেগে আছে।
ব্যক্তিগত জীবনে ইহসান : মানুষের ব্যক্তিগত জীবনটি তার অন্যান্য অবস্থার গুরুত্বের দিক থেকে আলাদা। কারণ যার ব্যক্তিগত জীবন সুন্দর হবে তা তার অন্যান্য অবস্থাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করবে। যার ব্যক্তিগত জীবন পরিশীলিত ও সুন্দর তার পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক জীবনও সুন্দর এবং পরিশীলিত। এ জন্য ইসলাম মানুষের ব্যক্তিগত জীবনকে পরিশীলিত ও সুন্দর করার দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। ব্যক্তি গঠনের জন্য ইসলাম তার জন্য বিশেষ কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে। প্রথম কর্মসূচি হলো- ব্যক্তিগত ইবাদত। দৈনন্দিন সালাতগুলো ইহসান শিক্ষার এক নম্বর কর্মসূচি। কারণ এই সালাত মানুষের সামগ্রিক জীবনব্যবস্থাকে পরিশীল ও স্মার্ট করে েেতিল। সালাত ইহসানের সাথে পালন করো, ইহসানের সাথে সালাত আদায় মানে তুমি যেন আল্লাহকে দেখছ, যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে মনে করো তিনি তোমাকে দেখছেন। তা হলে তোমার সালাত সুন্দর ও সুচারু হবে। সোনালি যুগের সুন্দর মানুষেরা এমনভাবে সালাত আদায় করেছেন যে, উড়ন্ত পাখি কোনো একটি স্থায়ী জড়পদার্থের স্তম্ভ মনে করে তার মাথায় এসে বসত। মু’মিনের স্থায়ী একটি ইবাদত হলো- ‘দাওয়াত ইলা আল্লাহ’। সেখানে আল্লাহ তায়ালা হাসানা শব্দ ব্যবহার করেছেন, বলেছেন- ‘তোমরা মানুষকে তোমাদের রবের দিকে হিকমত ও হাসানা মানে কৌশল ও সুন্দর ভাষায় আহ্বান করো।’
সুন্দরভাবে কথা বলা স্মার্টনেসের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান : তাই আল্লাহ বলেছেন- ‘হে মু’মিনরা! আল্লাহকে ভয় করো ও সঠিক কথা বলো। আল্লাহ তোমাদের কার্যকলাপ ঠিকঠাক করে দেবেন এবং তোমাদের অপরাধগুলো মাফ করে দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে সে বড় সাফল্য অর্জন করে।’ (সূরা আহজাব : ৭০-৭১) রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ ও কিয়ামতের উপর ঈমান আনে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ মু’মিন কখনো অশ্লীল, অশালীন ও গালিগালাজ করতে পারেন না। কারণ তিনি এমন এক পূতপবিত্র ও সর্বোত্তম কথা বলে ঈমান এনেছেন যেটিকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ‘কালিমাতুত তাইয়েবা’ বা ‘পবিত্র কথা’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই মু’মিন ব্যক্তির মুখ থেকে সর্বদা মধুর বাক্য ঝরবে এবং অন্যের কান যেটিকে শ্রুতিমধুর বা মধুর বাণী হিসেবে গ্রহণ করবে। মু’মিন কখনো অশ্লীল-অশালীন কথা, গালিগালাজ, অভিশাপ, তিরস্কার, ব্যঙ্গোক্তি, অবজ্ঞা, দাম্ভিকতা, গর্ব-অহঙ্কার, কটূক্তি, দম্ভোক্তি, কুৎসা রটনা, হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা, তুচ্ছজ্ঞান করতে পারেন না। এগুলো কালিমা তাইয়েবার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী আচরণ। যিনি কালিমা তাইয়েবার ভিত্তিতে নিজের জীবনব্যবস্থাকে গড়ে তোলেন, তার চিন্তাধারায় পরিচ্ছন্নতা, স্বভাবে প্রশান্তি, মেজাজে ভারসাম্য, চরিত্রে পবিত্রতা, আচরণে মাধুর্য, ব্যবহারে নম্রতা, লেনদেনে সততা, কথাবার্তায় সত্যবাদিতা, ওয়াদা ও অঙ্গীকারে দৃঢ়তা, সামাজিক জীবন যাপনে সদাচার, কথাবার্তায় চিন্তার ছাপ, চেহারায় পবিত্রতার ভাব ফুটে উঠবে। মোট কথা, সামগ্রিক জীবনব্যবস্থায় বৈপ্লবিক একটি পরিবর্তন সূচিত হবে। যে জীবনধারার কোথাও কোনো অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হবে না। তাই একজন মুসলিম ও মু’মিন থেকে উত্তম স্মার্ট ও আধুনিক অন্য কেউ হতে পারে না।
স্মার্টনেসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে পোশাক। পোশাক-পরিচ্ছদের বেলায় ইসলামের নির্দেশ হচ্ছে- ‘হে বনি আদম! প্রত্যেক ইবাদতের সময় তোমরা নিজ নিজ সুন্দর সাজে সজ্জিত হও।’ পোশাক দামি ও বিদেশী ব্র্যান্ডের হলেই তা স্মার্ট হয় না; বরং পরিশীলিত পোশাক বলতে তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও বিন্যস্ত, হোক তা কম দামের। শারীরিক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় জিনিস থেকে মুক্ত থাকা, এলোকেশে ধূলিমলিন না থাকা। আপনার মাথার চুল ও মুখের দাড়ি এলোমেলো, উষ্কখুষ্ক ও ধূলিমলিন, এককথায় বেলেহাজ অবস্থায় থাকা মু’মিনের কাজ নয়; বরং ভালো ও রুচিসম্মত বেশভূষা এবং মাথা ও দাড়ির চুলগুলো ভালোভাবে চিরুনি দিয়ে সুবিন্যস্ত করে রাখা একজন পরিশীলিত মু’মিনের কাজ।
খানাপিনার বেলায় হালাল খাদ্য গ্রহণ ও হারাম খাদ্য বর্জনের কথা বলা হয়েছে। ‘আর খাও ও পান করো; কিন্তু সীমা অতিক্রম করো না, আল্লাহ সীমা অতিক্রমকারীদের পছন্দ করেন না।’ অর্থাৎ- মু’মিনদের দৈন্যদশা, অনাহারক্লিষ্ট জীবন ও হালাল জীবিকা থেকে বঞ্চিত থাকা আল্লাহর কাছে প্রিয় নয়। তাঁর বন্দেগি করার জন্য তোমাদের কোনো পর্যায়ে এসবের শিকার হতে হোক এটি তিনি চান না; বরং তোমরা তার দেয়া উত্তম পোশাক পরলে এবং পবিত্র ও হালাল খাবার খেলে তিনি খুশি। এভাবে ব্যক্তিগত জীবনের প্রতিটি বিষয়ে ইসলামের বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে।
পারিবারিক জীবনে তোমরা পিতা-মাতার সাথে ইহসান করো, মানে সুন্দর আচরণ করো। পিতা-মাতার সাথে ইহসান করো মানে এমন আচরণ, যেই আচরণে স্বতঃস্ফূর্ত অগাধ প্রেম-ভালোবাসা ও গভীর মনোযোগ থাকে। তাদের জন্য মন-প্রাণ উজাড় করে দিতে হবে। যাতে তুমি মুহসিনের স্তরে পৌঁছতে পারো। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়স্বজনদের সাথে ভালো আচরণ করো।
সামাজিক জীবনে প্রতিবেশীকে ইসলাম এতটাই গুরুত্ব দিয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সা: আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ‘প্রতিবেশীকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, তাতে আমার মনে হচ্ছে তাদেরকে ওয়ারিশদার করে দেয়া হয় কি না।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘সেই ব্যক্তি মুসলিম নয়, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ নয়।’
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলাম সুন্দর ও স্মার্ট অর্থনৈতিক আচরণ প্রদান করেছে। ইসলাম চরমপন্থা ও মুক্তবাজার দুই প্রান্তিক মতবাদের পরিবর্তে মধ্যমপন্থার অর্থব্যবস্থা দিয়েছে। অন্যান্য টুলসের সাথে সাথে ‘করজে হাসানা’-এর কথা বলা হয়েছে। হাসানা মানে সুন্দর। আল্লাহ বলেন- ‘তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিতে থাকো। যা কিছু ভালো ও কল্যাণ তোমরা নিজেদের জন্য অগ্রিম পাঠাবে, তা আল্লাহর কাছে সঞ্চিত ও মজুদরূপে পাবে। এটি অতীব উত্তম। আর এর শুভ প্রতিফলও খুব বড়।’ (সূরা মুজাম্মিল-২০) করজে হাসানা দু’টি আরবি শব্দের সমন্বয়। করজ অর্থ ধার, ঋণ বা লোন আর হাসানা অর্থ সুন্দর, পরিশীলিত ও উত্তম। করজে হাসানা মানে উত্তম ঋণ। আমাদের সমাজে প্রচলিত লোন, ঋণ, ধার ও কর্জ একই অর্থবোধক বিভিন্ন ভাষার শব্দ। লোন ইংরেজি, ঋণ বাংলা ও কর্জ আরবি ভাষার শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থায় অনেকটা বলপূর্বক শব্দগুলোর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ভাবার্থ সৃষ্টি করা হয়েছে। কর্জ তার প্রকৃত বা স্বভাবার্থ নিয়ে অটুট থাকলেও ঋণ ও লোন শব্দকে কর্জ থেকে আলাদা করা হয়েছে। অর্থাৎ লোন ও ঋণকে বর্তমানে শোষণের হাতিয়ারের ভাবার্থে ব্যবহার করছে। মূলত কর্য, ঋণ, লোন ও ধার বলতে এমন দু’টি পক্ষ বা ব্যক্তি যাদের মধ্যে এমন লেনদেন সংঘটিত হওয়া যাতে এমন শর্ত থাকে যে, ঋণ, লোন, ধার বা কর্জ হিসেবে যে পরিমাণ অর্থ বা দ্রব্য দেয়া-নেয়া হবে, সেই পরিমাণ অর্থ বা দ্রব্য ঋণ বা লোনগ্রহীতা ঋণদাতাকে নির্দিষ্ট সময়ে ফেরত দেবে। আল কুরআনে আল্লাহ এটিকে কল্যাণকর বা উত্তম ঋণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। কাজেই ঋণ বা লোন কোনো খারাপ বা নিষিদ্ধ কোনো লেনদেন নয়, যতক্ষণ এগুলো তার প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এ কল্যাণকর ও উত্তম ঋণকে সমাজের সুবিধাভোগীরা এর সাথে অতিরিক্ত কিছু যোগ করে অকল্যাণ ও হারাম ঋণে পরিণত করেছে। প্রচলিত ব্যাংকগুলো এ অতিরিক্ত অংশকে সুদ বলে থাকে। অর্থাৎ প্রদত্ত ঋণের ওপর শর্ত হিসেবে অতিরিক্ত কিছু আদায় করা হলে তাকে সুদ বলা হয়।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামের স্মার্টনেস দেখার জন্য আজ থেকে ১৫ শ’ বছর আগে রাসূলুল্লাহ সা:-এর যুগসহ তাঁর খলিফাদের রাষ্ট্র পরিচালনার দিকে দৃষ্টিপাত করুন। তাদের রাজনৈতিক সহাবস্থান, আচার-আচরণের দিকে দৃষ্টিপাত করুন- ইসলামের সৌন্দর্য পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। তাদের অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক জীবনের সৌন্দর্য বর্তমান বিশ্বের মুসলিম ও অমুসলিম দেশের প্রত্যেকের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় আদর্শ হতে পারে। কারণ ইসলামের মতো সুন্দর ও পরিশীলিত এবং চির আধুনিক আদর্শ অন্য কোনো জীবনব্যবস্থায় নেই। লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com