সুদ বর্তমান অর্থব্যবস্থার একটি অন্যতম কাঠামো হলেও এটি মূলত ধ্বংসই ডেকে আনে। কারণ, সুদনির্ভর সমাজের ভিত কখনোই মজবুত হয় না। কুরআনের ভাষায়- ‘আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং সদকাকে বৃদ্ধি করেন’। (সূরা বাকারাহ-২৭৬)
অন্যভাবে যদি বলা যায়, সুদ এক ধ্বংসাত্মক ব্যাধি। এ ব্যাধির বিষাক্ত ছোবলে আক্রান্ত যাদের জীবন, দুনিয়াই তাদের একরকম নরক। বিশ্ববাসীকে এ ব্যাধি থেকে বাঁচাতেই সুদ নিষিদ্ধের বিধান। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন- ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম’। (সূরা বাকারাহ-২৭৫)
নবীজী সা: সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, তন্মধ্যে চতুর্থ কাজটি সুদ। (বুখারি-২৭৬৬)
সুদ কী : ‘সুদ’ শব্দটি উর্দু। এর আরবি প্রতিশব্দ ‘রিবা’। রিবা অর্থ-বৃদ্ধি, আধিক্য, স্ফীত ইত্যাদি।
রিবার পারিভাষিক সংজ্ঞায় রাসূল সা: বলেছেন, ‘প্রত্যেক ওই ঋণ যা মুনাফা টেনে আনে, তাই সুদ।’ (ফিকহুস সুনান : ২০৭৩, ২৪৫৭)
ইবনে জারির তাবারি, মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন, জাহেলি যুগে প্রচলিত এবং কুরআনে নিষিদ্ধ রিবা বা সুদ হলো- কাউকে নির্দিষ্ট মেয়াদে ঋণ দিয়ে মূলধনের অতিরিক্ত নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ গ্রহণ করা। (সংক্ষিপ্ত মাআরেফুল কুরআন, পৃষ্ঠা-১৫৩)
সুদের প্রচলন : আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি ইহুদিদের জন্য বহু পবিত্র বস্তু হারাম করেছি যা তাদের জন্য হালাল ছিল। তাদের পাপের কারণে, আল্লাহর পথে অধিক পরিমাণে বাধা প্রদানের কারণে এবং এ কারণে যে, তারা সুদ গ্রহণ করত। অথচ এ ব্যাপারে তদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। বস্তুত আমি কাফেরদের জন্য তৈরি করে রেখেছি বেদনাদায়ক শাস্তি।’ (সূরা নিসা : ১৬০-১৬১)
এ আয়াতে এই কথা স্পষ্ট যে, মূসা আ:-এর উম্মত বনি ইসরাইল তথা ইহুদিদের ওপরও সুদ হারাম ছিল। নির্ভরযোগ্য অনেক সূত্র থেকে জানা যায়, তাওরাতেও রিবা শব্দের উল্লেখ ছিল। মানে হজরত ঈসা আ:-এর জন্মের পাঁচ শতাধিক বছর আগে নবী মূসার যুগেও সুদের প্রচলন ছিল।
পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের শরিয়াহ অ্যাপিলেট বেে র অন্যতম সদস্য ওয়াজিউদ্দীন আহমদ বলেছেন, মানবসভ্যতা যতটা পুরনো, সুদের ধারণা ততটাই প্রাচীন। (সুদ সমাজ অর্থনীতি, ডিসেম্বর ১২১২ সংস্করণ, পিডিএফ, লেখক : অধ্যাপক মুহাম্মদ শরিফ হুসাইন, পৃষ্ঠা-৮৬)
জাহেলি যুগে সুদের ব্যাপক প্রচলন ছিল। আর এ তো নিতান্তই স্বাভাবিক। কেননা, সে সময়ে ধনিক শ্রেণীর অহঙ্কার ও দাপট ছিল পাহাড়সম। দীন-দুঃখী ও দুর্বলদের ওরা মানুষ মনে করত না। নানান অত্যাচার আর অবিচারে দরিদ্রদের অবস্থা ছিল বেগতিক। অনেকে তো এও বিশ্বাস করত, গরিব হওয়া মানেই নির্যাতন ভোগ। সুতরাং সেকালে সুদের ব্যাপকতা স্বাভাবিকই বটে। ইমাম রাজি রহ: লিখেছেন, জাহেলি যুগে আরবে সুদের বিশেষ নিয়ম প্রচলিত ছিল। এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ ঋণ দিত এবং ঋণগ্রহীতার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে সুদ আদায় করত। মেয়াদ শেষে, গ্রহীতার কাছে মূলধন ফেরত চাওয়া হতো। সে তা আদায় করতে অক্ষম হলে, সুদের পরিমাণ বৃদ্ধি করে মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া হতো। (সুদ ও ইসলামী ব্যাংকিং,পৃষ্ঠা-৪৩, লেখক : মাওলানা ফজলুর রহমান)
জাহেলি যুগে সুদের অনেক প্রকার ছিল। রাসূল সা: তাদের সব প্রকার সুদকে বাতিল বলে আখ্যা দিয়েছেন। (আবু দাউদ-৩৩৩৪)
অন্যান্য ধর্ম ও দর্শনের দৃষ্টিতে সুদ : অনেকের ধারণা, সুদ কেবল নবী মুহাম্মাদ সা:-এর শরিয়তেই নিষিদ্ধ। এ ধারণা ঠিক নয়। আমাদের নবীজী পৃথিবীতে আসার হাজার বছর আগেও অন্যান্য আসমানি কিতাবে আল্লাহ তায়ালা সুদ নিষিদ্ধ করেছিলেন। সেসব কিতাবের মধ্যে জাবুরসহ অন্যান্য সহিফার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা যেসব পুস্তক তাওরাত ও ইঞ্জিল বলে দাবি করে, তা বহু বিকৃত। তথাপি এসব পুস্তকেও সুদের নিন্দা রয়েছে, যা তাদের মতবাদেও সুদ নিষিদ্ধের প্রমাণ বহন করে।
ইহুদিদের মৌলিক আইনগ্রন্থ তালমুদ ও মিশনাহ মতে সুদ নিষিদ্ধ। এমনকি সুদি কারবারের মধ্যস্থতা অবলম্বন এবং সাক্ষী প্রদানও নিষিদ্ধ। (সুদ সমাজ অর্থনীতি, অধ্যাপক মুহা: শরীফ হুসাইন, পৃষ্ঠা-৮৬)
হজরত ঈসা আ:-এর ওপর অবতীর্ণ কিতাব ইঞ্জিল। খ্রিষ্টানদের ভাষায় ঞযব এড়ংঢ়বষ ড়ভ ঔবংঁং. বর্তমানে গ্রন্থটি বিকৃত হলেও, তাতে সুদ গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বলা হয়েছে- ‘তোমরা ধার দাও তবে তার বিনিময়ে কিছু পাওয়ার আশা করো না।’ (সুদ সমাজ অর্থনীতি, পৃষ্ঠা-৮৬)
তা ছাড়া খ্রিষ্টধর্মের শুরু থেকে মার্টিন লুথারের সংস্কার আন্দোলনের সূচনা (১৫৪৭ সাল) এবং পোপশাসিত চার্চ থেকে অন্যান্য চার্চ পৃথক হওয়া পর্যন্ত সুদ নিষিদ্ধ ছিল। (সুদ, প্রফেসর হাবিবুর রহমান, পৃষ্ঠা-১১)
হিন্দু ধর্মে ‘মনু’-এর বিধিমালায় সুদি লেনদেন অবৈধ বলা হয়েছে। তা ছাড়া প্রাচীন হিন্দু সমাজে একটি প্রবাদ প্রচলিত ছিল- ‘নগচ্ছেৎ শুন্ডিবায়লং’ অর্থাৎ ‘সুদখোরের বাড়িতে যেয়ো না।’ (সুদ সমাজ অর্থনীতি, পৃষ্ঠা-৮৯)
বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটল (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৪, ৩২২) তার গ্রন্থ ‘পলিটিক্স’-এ সুদকে একধরনের জালিয়াতি বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং প্লেটো (খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৭, ৩৪৮) তার গ্রন্থ Lows-এ সুদের নিন্দা করেছেন। (সুদ, প্রফেসর হাবিবুর রহমান, পৃষ্ঠা-১১)
সুদের ভয়াবহতা : আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘সুদখোররা কিয়ামতের দিন এমন অবস্থায় দাঁড়াবে যে, শয়তান স্বীয় স্পর্শ দ্বারা তাদের পাগল করে দিয়েছে।’ (সূরা বাকারাহ-২৭৫)
আল্লাহ আরো বলেন- ‘হে মু’মিনরা তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের অবশিষ্টাংশ ছেড়ে দাও; যদি তোমরা মু’মিন হয়ে থাকো। আর যদি এমনটি না করো (সুদ না ছাড়ো) তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের ব্যাপারে সাবধান হয়ে যাও।’ (সূরা বাকারাহ-২৭৯)
হজরত সামুরা ইবনে জুন্দুব রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: স্বীয় স্বপ্নের আলোচনায় বলেন, ‘আজ রাতে আমার কাছে দু’জন ব্যক্তি এলো। আমি তাদের সাথে চললাম। চলতে চলতে উপস্থিত হলাম এক রক্ত-নদীর তীরে। দেখতে পেলাম এক ব্যক্তি নদীতে হাবুডুবু খাচ্ছে। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে আরেক ব্যক্তি। হাবুডুবু খাওয়া ব্যক্তি যখনই সাঁতরে নদীর কিনারে চলে আসে, তীরে দাঁড়ানো ব্যক্তি তার মুখের উপর পাথর নিক্ষেপ করে। পাথরের ধাক্কায় লোকটি আবারো নদীর মাঝখানে চলে যায়। আমি হাবুডুবু খাওয়া লোকটির ব্যাপারে সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করলাম। তারা বলল, লোকটি সুদখোর।’ (বুখারি : ১৩৮৬, ২০৮০)
অন্য হাদিস মতে, সুদদাতা, গ্রহীতা, যে ব্যক্তি সুদি কারবারের সাক্ষী থাকে এবং যে সুদের হিসাব-নিকাশ বা সুদের চুক্তিপত্র ইত্যাদি লিখে দেয় সবার প্রতি রাসূলে করিম সা: লানত করেছেন। (মুসনাদে আহমাদ-৬৬০, তিরমিজি-১২০৬)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে হানজালা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেছেন, ‘এক দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) সুদ গ্রহণ করার পাপ, ৩৬ বার ব্যভিচার করা থেকেও জঘন্য।’ (মিশকাত-২৮২৫)
সুদখোর অত্যাচারী ও নির্দয় হয়ে থাকে। দীন-দুঃখীদের আর্তনাদ তার কান অবধি পৌঁছে না। কৃপণতা ও লোভ তার রক্ত- মাংসে মিশে যায়। রব্বে কারিমের দেয়া সম্পদের অপব্যবহার করে সে। ফলে দিন দিন বেড়েই চলে সমাজে বিপর্যয়। আর এভাবেই ধ্বংস হয় বিভিন্ন দেশ-সমাজ। তাই আসুন সুদকে না বলি, সুষ্ঠু-শৃঙ্খল সমাজ গড়ি। লেখক : শিক্ষার্থী, মারকাযুল মাআরিফ আল ইসলামিয়া, উত্তর বাড্ডা, ঢাকা