বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা মিয়ানমারের রাখাইনে স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ চলছে। এতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সীমান্ত পরিস্থিতি। তিন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর জোট থ্রি ব্রাদারহুড সম্প্রতি মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে রাখাইন রাজ্যের বেশির ভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।
মিয়ানমার বাহিনী এখন স্থল এলাকা থেকে কামান ও মেশিনগানের গোলাবর্ষণ ছাড়াও বিমান ও হেলিকপ্টার থেকে হাতছাড়া হওয়া এলাকায় অনবরত বোমাবর্ষণ করছে। এ সংঘর্ষের জের ধরে রাখাইনের সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশের তুমব্রু ও টেকনাফের কাছাকাছি মিয়ানমারের হেলিকপ্টার মহড়ার ফলে স্থানীয় বাসিন্দারা বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছেন এবং তারা ভারতসহ বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছেন। এতে বাংলাদেশ সীমান্তে নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকার ঘুমধুম, উখিয়ার সীমান্তে আনজুমান পাড়া ও টেকনাফ সীমান্ত পথ দিয়ে মিয়ানমার থেকে আবারো বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শঙ্কা করা হচ্ছে। উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তে কয়েক শ’ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের। এ কারণে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে এবং নাফ নদী এলাকায় রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য প্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি সর্বাতœক সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। এদিকে গত মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) দিবাগত রাত সাড়ে ৮টায় ঘুমধুম সীমান্তে ফের গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেয়েছেন স্থানীয় সীমান্তবাসী। এতে ঘুমধুম এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকার পাশাপাশি রাখাইনের সর্বত্র এই লড়াই ছড়িয়ে পড়ছে বলে সীমান্তের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। গত কয়েক দিনে সীমান্তের ওপারে তীব্র গোলাগুলির শব্দে প্রকম্পিত হচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা।
গতকাল বুধবার (৩১ জানুয়ারি) সকালে টেকনাফ সীমান্তের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ২০ থেকে ২৫ বার প্রচ- আওয়াজের মর্টাল শেল ও গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেয়েছেন তারা। নাফ নদী থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত কোস্ট গার্ড জলযান বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং ২৪ ঘণ্টা টহল জোরদার করেছেন। মিয়ানমারে রাখাইন এলাকার রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সীমান্তে জড়ো হওয়ার খবরে কোস্টগার্ড ও বিজিবির টহল সীমান্তে কড়া নজরদারি বাড়িয়েন। সীমান্তে বাংলাদেশী বাসিন্দারা রয়েছেন নানা আতঙ্কে। গত শনিবার বিকেলে রাখাইনে দুই পক্ষের গোলাবর্ষণে ছোড়া একটি গুলি এসে পড়েছে টেকনাফের উলুবনিয়া সীমান্তের একটি বাড়িতে। সীমান্তের ওপারে দিনব্যাপী মর্টাল শেল হামলা ও গোলাগুলির একপর্যায়ে একটি গুলি টেকনাফ সীমান্তে উলুবনিয়া গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলামের বাড়ির টিনের চালে এসে পড়ে। পরে গুলিটি বিজিবির স্থানীয় ফাঁড়ির ইনচার্জকে জমা দেয়া হয়। সীমান্তে নাফ নদ এবং স্থলভাগে বিজিবি সতর্ক টহলে রয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়ার পালংখালী এবং নাইক্ষ্যংছড়ি, আলীকদম পর্যন্ত ২৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে বিজিবি টহল জোরদার করেছে বলে বিজিবি সূত্র জানিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাসহ যেকোনো ধরনের প্রবেশ ঠেকাতে প্রস্তুত রয়েছে বিজিবি। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তা বাহিনীর সাথে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির লড়াইয়ে অন্তত ১২ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর)। হামলায় আহত হয়েছেন ৩০ জন। গত শুক্রবার রাজ্যের হপোন নিও লেইক গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে গণহত্যা থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান ফলকার টুর্ক। গত মঙ্গলবার হাইকমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।
তাতে বলা হয়, মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘর্ষে অনেক বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিদ্রোহীদের সাথে লড়াইয়ে একের পর এক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে নির্বিচার হামলা চালাচ্ছে সামরিক বাহিনী।
বিজ্ঞপ্তিতে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বিদ্রোহী ও জান্তা বাহিনীর সংঘর্ষের জেরে গত অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ৫৫৪ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আর গত বছরে সামরিক বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৬০০ জনের বেশি বেসামরিক মানুষ। সংখ্যাটা এর আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩০০ জন বেশি। এমন সময় এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলো, যখন মিয়ানমারের অনেক অঞ্চল সামরিক বাহিনীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে বিভিন্ন সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী। এ নিয়ে ফলকার টুর্ক বলেছেন, সারা বিশ্বে চলমান নানা সঙ্কটের মধ্যে এটা গুরুত্বপূর্ণ যে কারো কথা ভুলে যাওয়া হয়নি। মিয়ানমারের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন। গত বছরের অক্টোবর থেকে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে।
মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার বলেন, আমি মিয়ানমারের সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী নাগরিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাহস ও সহনশীলতার প্রশংসা করছি। একই সাথে মিয়ানমারে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানাতে এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে যেকোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানাচ্ছি। এদিকে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইনের এলাকাগুলোয় নতুন করে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে বান্দরবান জেলার সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
স্থানীয় ঘুমধুম এলাকার গণমাধ্যমকর্মী আজিজুল হক রানা বলেছেন, মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) দিবাগত রাত সাড়ে ৮টায় গোলাগুলির শব্দ শুনা যায়। স্থানীয় সীমান্তবাসীদের মধ্যে এখনো আঙ্ক বিরাজ করছে।
এদিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তবর্তী এলাকায় বন্ধ স্কুলগুলো গতকাল খুলে দেয়া হয়েছে। এর আগে সোমবার তুমব্রু এলাকার বিপরীতে ঢেঁকিবনিয়া বিজিপি সীমান্তচৌকি এলাকায় গোলাগুলির সময় মর্টারশেলের বিস্ফোরিত একটি অংশ শূন্যরেখায় এসে পড়লে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ওই পরিস্থিতিতে সীমান্তের কাছাকাছি বাংলাদেশের ঘুমধুমের পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়
গত রোববার (২৮ জানুয়ারি) দুপুর ২টার দিকে মিয়ানমারের বেশ কয়েকটি হেলিকপ্টার সীমান্ত এলাকায় মহড়া দিয়েছে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু বাজার থেকেই স্পষ্ট হেলিকপ্টার উড়তে দেখেছেন সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা। এর আগে শনিবার (২৭ জানুয়ারি) টেকনাফের সীমান্তবর্তী এক বাড়ির দেয়ালে গুলি লেগেছে। সীমান্তের ওপারে গত কয়েক দিনে সংঘর্ষ বাড়ায় ও উত্তেজনা তৈরি হওয়ায় বিজিবির পক্ষ থেকে সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকার কথা বলা হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া, তুলাতুলি ও কাঞ্জরপাড়া সীমান্ত, উখিয়া উপজেলার পালংখালির আনজুমান পাড়া এবং নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু ও ঘুমধুম এলাকায় বেশি গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
পালংখালী অনজুমান পাড়া এলাকার বাসিন্দারা জানান, মিয়ানমারের মংডু ও বলিবাজার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের সীমানার কাছাকাছি অবস্থান করছেন রোহিঙ্গারা। আবার কিছু রোহিঙ্গা ডিঙি নৌকা করে নাফ নদীতে অবস্থান করছে। তবে খবর পাওয়ার পর এলাকায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সবাই। মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি) রোহিঙ্গাদের কোনো ধরনের বাধাও দিচ্ছে না। এতে বাংলাদেশ সীমান্তের লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ আনোয়ারি বলেন, বেশ কয়েকদিন ধরে মিয়ানমারে আবারো উত্তেজনা শুরু হয়েছে। প্রতিদিন গুলির বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে। গত শনিবার মায়ানমার থেকে ছোড়া গুলি আমার ইউনিয়নের এক বাসিন্দার ঘরে পড়ে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সীমান্তের কাছাকাছি বসবাস করা মানুষরা। ইতোমধ্যে অনেক মানুষ ঘর ছেড়েছে। মিয়ানমারে উত্তেজনা শুরু হলে রোহিঙ্গা প্রবেশ নিয়ে শঙ্কা থাকে। শুনেছি কিছু রোহিঙ্গা সীমান্তের কাছাকাছি আছে। বিষয়টি আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি।
নাইক্ষছড়ির তুমব্রুর কোণারপাড়া এলাকার বাসিন্দা জলাল জানান, গত রোববার দুপুর ১টার পর তুমব্রুর কোণারপাড়া, ভাজাবনিয়া এবং তুমব্রু বাজার থেকেই ওপারে হেলিকপ্টার মহড়া দিতে দেখা গেছে। অন্তত ২৫ মিনিটেরও বেশি সময় হেলিকপ্টারটি চক্কর দিতে থাকে এবং এ সময় ব্যাপক গোলাগুলির শব্দও শোনা গেছে। তার আগে শনিবার দুটি মর্টারশেল এপারে এসে পড়ে। এতে পুরো এলাকার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের উনছিপ্রাং এলাকার জেলে পুতু বলেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি বিলার ডিলাতে কিছু রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। আমরা মাছ ধরতে গেলে তাদের সাথে দেখা হয়। বিজিবির টেকনাফ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লে. কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য প্রবেশ নিয়ে সতর্ক অবস্থানে আছে বিজিবি। সীমান্ত এলাকায় কঠোর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। একজন রোহিঙ্গাকেও প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। আমরা সব সময়ই সজাগ আছি। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: আদনান চৌধুরী বলেন, সীমান্তের কাছাকাছি মিয়ানমারের ওপারে গোলাগুলি হচ্ছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরের ঘটনা। রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য প্রবেশ নিয়ে বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে সতর্ক করা হয়েছে।