‘সে বিজয়ী, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করল’। (সূরা-আলা, আয়াত-১৪) আল কুরআনে ব্যক্তি পরিশুদ্ধতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পরিশুদ্ধ ব্যক্তি মাত্রই সফল। সফলতার মানদ- হলো পরিশুদ্ধতা। নিজেকে জাগতিক পাপরাশি থেকে মুক্ত করে সবসময় পবিত্র জীবন যাপনের নামই হলো পরিশুদ্ধতা। কুরআনের ভাষায়- পরিশুদ্ধ ব্যক্তিই সফল ব্যক্তি। মানুষকে পরিশুদ্ধ করতে হলে আল্লাহ তায়ালার কুরআন দিয়ে করতে হবে। (সূরা বাকারার ১২৯ নং আয়াতে কুরআনের আয়াত দিয়ে মানুষের পরিশুদ্ধির কথা বলা হয়েছে) এই মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাজিলের মাস হলো রমজান মাস। মানবজাতিকে পরিশুদ্ধ করতে তাই কুরআন এবং রমজানকে গভীরভাবে বুঝতে হবে। বুখারির এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’
মানুষ পরিশুদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে মিথ্যা হলো সবচেয়ে বড় বাধা। আমরা সবাই মিথ্যাকে সবচেয়ে বড় পাপ বলেই জানি। মিথ্যা সব পাপের জন্ম দেয়। মিথ্যা ছেড়ে দিলে সব পাপ দূরে চলে যায়। ইসলামে মিথ্যাকে ভয়ঙ্কর কাবিরা গুনাহ হিসেবে গণ্য করা হয়। আর রোজা রেখে মিথ্যা বলা ও তদানুযায়ী আমল বন্ধ না করলে সে রোজার কোনো দাম নেই আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার কাছে। কুরআনে আল্লাহ তায়ালা সত্যবাদীদের সাথে সঙ্গ স্থাপন করতে বলেছেন। (সূরা তাওবা, আয়াত-১১৯)
অন্য এক হাদিসে আছে, ‘আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, সওম ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম আমার জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান দেবো। সিয়াম ঢাল স্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন সিয়াম পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে- আমি রোজাদার। যার কব্জায় মুহাম্মদ সা:-এর প্রাণ, তার শপথ, অবশ্যই রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের গন্ধের চেয়েও সুগন্ধী। রোজাদারের জন্য রয়েছে দু’টি খুশি। যখন সে ইফতার করে, সে খুশি হয় এবং যখন সে তার রবের সাথে সক্ষাৎ করবে।’ (বুখারি)
হাদিসে অত্যন্ত চমৎকারভাবে রোজাকে ঢাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সাথে অশ্লীলতা, ঝগড়া-বিবাদ, গালি প্রতিরোধের উপায় বলা হয়েছে। রোজাদার ব্যক্তি কোনোভাবেই অশ্লীল কাজে জড়াবে না। ঝগড়া ও গালি এমনভাবে প্রতিরোধ করবে, সে মুখে বলবে- আমি রোজাদার। মেজাজের ভারসাম্য রক্ষায় হাদিসটি আমল করা আমাদের সবার জন্য অপরিহার্য। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদত করে, তার পেছনের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রমজানে সিয়াম পালন করবে, তারও অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করা হবে।’ (বুখারি)
লাইলাতুল কদর হলো কুরআন নাজিলের রাত। আর এই মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ রাতটি আসে রমজান মাসের শেষ দশকে। সাইয়েদুল মুরসালিন ইমামুল মুরসালিন খাতেমুন্নাবিয়িন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা: রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন। ইতেকাফকারীর জন্য লাইলাতুল কদর লাভ করা অত্যন্ত সহজসাধ্য। কারণ, তিনি এই রাতে মসজিদে অবস্থান করেন।
হাদিস অনুযায়ী ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় বিশেষভাবে লাইলাতুল কদরে ইবাদত ও সামগ্রিকভাবে পুরো রমজান মাসে সিয়াম পালন করলে মহান আল্লাহ তায়ালা অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন। মানুষ সব গুনাহ থেকে মাফ পেয়ে গেলে সে পবিত্র হয়ে গেল।
হজরত সাহল রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেন, ‘জান্নাতে রাইয়ান নামের একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন রোজা পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাদের ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে ন। ঘোষণা দেয়া হবে, সিয়াম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তারা ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পরই দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে, যাতে করে এ দরজাটি দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে।’ (বুখারি)
মানব জীবনের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হলো জান্নাত। মানুষ সিয়াম পালনের মধ্য দিয়ে মিথ্যা, ঝগড়া, গালি, অশ্লীলতার মতো বড় বড় পাপ থেকে পবিত্র হয়ে নিজেকে সারা রমজান মাসব্যাপী গড়ে তোলে। এই সংযম ও সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে পবিত্র ও চরিত্রবান হয়ে গড়ে ওঠা বান্দার জন্য অপেক্ষা করছে যে জান্নাত।
মূলত রমজান মাসে হাদিসে উল্লিখিত বদ স্বভাব মিথ্যা বলা, গালি দেয়া, ঝগড়া করা, অশ্লীলতার পথে চলা পরিহার করার মাধ্যমে মানব চরিত্র এমন এক পবিত্রতার চাদরে আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে এবং এর মাধ্যমে যে ব্যক্তিত্ববোধের জন্ম হয়, পরবর্তীতে উন্নত পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
সব ক্ষেত্রে মিথ্যা পরিহার সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে অকল্পনীয়ভাবে সাহায্য করবে। অশ্লীলতার মতো সমাজবিধ্বংসী ভয়াল থাবা রুখে দিতে রমজানে সবার সিয়াম পালনের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে সুখময় করতে ব্যক্তি, পরিবার থেকে গালি ও ঝগড়ার মতো বদভ্যাস দূর করতে এই রমজানের সিয়াম পালনকে অর্থবহ করে তুলতে হবে। এভাবেই কুরআন, রমজান ও সিয়ামের গভীর উপলব্ধি এবং অভ্যাস আমাদের সত্তাকে পবিত্র রাখবে সবসময়। লেখক : ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি