রোজার ফরজিয়তকে তুলে ধরে মহান আল্লাহ পাক আল-কোরআনে ইরশাদ করেছেন, “তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে।” (সূরা বাকারাহ, আয়াত : ১৮৩)
রোজার মর্ম: রোজা হচ্ছে ইসলামী ইবাদতের তৃতীয় রোকন। আরবী ভাষায় রোজাকে সাওম বলা হয়। যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে চুপ থাকা, বিরত থাকা। কোন কোন মুফাচ্ছিরীনদের বিশ্লেষণ মোতাবেক সাওমকে কখনও কখনও ছবরও বলা হয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে দৃঢ়তার সাথে নিবৃত্ত রাখা এবং সুদৃঢ় পন্থায় দৈহিক চাহিদাসমূহকে সংযত রাখা। এই অর্থসমূহের দ্বারা বুঝা যায় যে, ইসলামী পরিভাষায় রোজার প্রকৃত অর্থ ও মর্ম কি? বস্তুত রোজা হচ্ছে নফসের খাহেশ ও আশা-আকাক্সক্ষাসমূহকে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে সংযত রাখা এবং লোভ-লালসা উৎসাহ ব্যঞ্জক রঙিন পরিম-লে নিজের দেহ-মন প্রাণকে সংযত, সুদৃঢ়ভাবে বিমুক্ত রাখা। ব্যবহারিক জীবনে প্রাত্যহিক কর্মকা-ের মাঝে সাধারণত নফসানী খাহেশসমূহ এবং মানবিক লোভ-লালসা ও উচ্চাকাক্সক্ষাসমূহের বিকাশস্থল হচ্ছে তিনটি। যথা : খাদ্য, পানীয় এবং নারী। এই তিনটি উপকরণ এবং উপায় থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দৈহিক ও আত্মিক সম্পর্কসমূহকে সংযত ও সুসংহত রাখার নামই শরীয়ত মোতাবেক রোজা। কিন্তু একই সাথে এ সকল বাহ্যিক খাহেশসমূহের সাথে সাথে অভ্যন্তরীণ খাহেশসমূহও ও অমঙ্গল চিন্তাভাবনা হতে অন্তর ও যবানকে হেফাজত রাখার নাম বিশেষ শ্রেণীর নিকট রোজার মর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
রোজার প্রাথমিক ইতিহাস: রোজার প্রাথমিক ইতিহাস জানা যায় না। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত দার্শনিক স্পেন্সার নিজের বই চৎরহপরঢ়ষবং ড়ভ ঝড়পরড়ষড়মু-তে কতগুলো বন্য সম্প্রদায়ের উদাহরণ এবং জীবনবৃত্তান্তের উপর কিয়াস করে লিখেছেন যে, রোজার প্রাথমিক মানদ- এভাবেই হয়ত হয়ে থাকবে যে, আদিম বন্য যুগের মানুষ স্বভাবতই ক্ষুৎ-পিপাসায় আক্রান্ত থাকত এবং তারা মনে করত যে, আমাদের আহার্য বস্তু আমাদের পরিবর্তে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৃতদের নিকট পৌঁছে যায়। কিন্তু অনুমানসিদ্ধ উপাত্তকে যুক্তি ও বুদ্ধির আওতাভুক্ত লোকেরা কখনও স্বীকার করে নেয়নি। (ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা : ১০ম খ-, ১৯৪ পৃষ্ঠা, একাদশ সংস্করণ) মোটকথা অংশীবাদী ধর্মমতগুলোতে রোজার প্রারম্ভ এবং হাকীকতের যে কোন কারণই হোক না কেন ইসলামের দৃষ্টিতে এর প্রাথমিক পর্যায় ও শেষ পর্যায়কে বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রে নিজের অনুসারীদের ওকালতির প্রতি মোটেই ভ্রƒক্ষেপ করে না। ইসলামের মূল উৎস কোরআনুল কারীমে উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা পরহেজগার হতে পার।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৩) অপর এক আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন, “রমজান মাস হচ্ছে এই মাস যার মাঝে কোরআনুল কারীম নাজিল করা হয়েছে। যা মানুষের জন্য পরিপূর্ণ হেদায়েত, পথপ্রদর্শনের দলিল এবং সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য নির্ণয়কারী। সুতরাং তোমাদের মাঝে যে এই মাসকে পাবে তাকে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। আর যদি কেউ রুগ্ন হয় কিংবা সফরে থাকে তাহলে সে সমপরিমাণ রোজা অন্যান্য দিনসমূহে আদায় করবে। আল্লাহ পাক তোমাদের আসানী কামনা করেন এবং তোমাদের উপর কাঠিন্য আরোপিত হোক তা কামনা করেন না। যেন তোমরা রোজার নির্দিষ্ট পরিমাণকে পরিপূর্ণ করতে পার এবং (এই রোজা এ জন্য ফরজ হয়েছে) যাতে করে তোমরা এই হেদায়েত মোতাবেক আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করতে পার এবং যাতে করে তোমরা কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হতে পার। (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৪)
এই পবিত্র আয়াতসমূহে শুধু কেবল রোজার কতিপয় আহকামই বর্ণনা করা হয়নি; বরং রোজার ইতিহাস, রোজার হাকীকত, রমজানের বিশেষত্ব¡ এবং রোজার প্রতি আরোপিত আভিযোগসমূহের প্রত্যত্তরসমূহ বিস্তারিতভাবে এবং চিত্তাকর্ষকরূপে বিবৃত করা হয়েছে। পরবর্তী আলোচ্য বিষয়াদির মাঝে শ্রেণীবিন্যাস সহকারে এ সকল বিষয়ের প্রতি আমরা অবশ্যই আলোকপাত করতে যতœবান হব।
রোজার ধর্মীয় ইতিহাস: কোরআনুল কারীমের উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহের সুস্পষ্টভাবে একথা তুলে ধরা হয়েছে যে, বর্তমান ইসলামের সাথেই শুধু কেবল রোজার সম্পৃক্ততা সুনির্দিষ্ট নয়; বরং কোরআনুল কারীম অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী মাযহাবগুলোতেও রোজাকে একটি ধর্মের বিশেষ অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অন্ধকার যুগের আরবদের সামনে রাসূলুল্লাহ (সা:) উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন যে, পৃথিবীর প্রতিটি ধর্ম বিশ্বাসের মাঝে রোজা অবশ্যই ফরজ ইবাদত হিসেবে পরিগণিত ছিল। কিন্তু তৎকালীন আরবের বিরুদ্ধবাদী সম্প্রদায় এমন কি বর্তমান যুগের কোন কোন প-িত ব্যক্তিরাও মনে করে যে, রাসূলুল্লাহ (সা:) প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। এমতাবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর দাবী যদি সর্বাংশে সত্য ও যথার্থ বলে প্রতিপন্ন হয় তাহলে একথা মেনে নিতে দ্বিধা সংকোচের অবকাশ মোটেই থাকবে না যে, তিনি উপাদানভিত্তিক জ্ঞানবত্তার ঊর্ধ্ব পরিম-লে অবশ্যই অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই দাবীর সত্যতা প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে ইউরোপের অধিক প্রামাণ্য গ্রন্থের উদ্ধৃতি আমরা পেশ করছি যা অনুসন্ধানীদের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকবে। ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার রোজার প্রবন্ধ লেখক (ঋধংঃরহম) উল্লেখ করেছেন যে, “রোজার বিধি-বিধান আদায় পদ্ধতি, আবহাওয়া, সামাজিক ব্যবস্থা এবং সভ্যতা বিবর্তনের দরুন যদিও বিভিন্ন রূপ পরিদৃষ্ট হয় তথাপি আমরা অতি কষ্টে এমন কোন ধর্মের নাম উপস্থাপন করতে পারব না, যেখানে রোজাকে ধর্মীয় বিধানের অন্তর্ভুক্ত বলে স্বীকার করা হয়নি।” সামনে অগ্রসর হয়ে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, “বস্তুত রোজা একটি ধর্মীয় প্রথা হিসেবে সকল স্থানেই স্বীকৃত আছে।”
ভারতবর্ষকে ধর্ম বিকাশের সবচেয়ে পুরাতন স্থান হিসেবে দাবী করা হয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, বর্ত বা ব্রত অর্থাৎ রোজা থেকে এখানকার ধর্মগুলোও বিমুক্ত ছিল না। ভারতীয় বর্ষপঞ্জীতে প্রতি মাসের এগার ও বার তারিখে ব্রাহ্মণদের উপর একাদশীয় রোজা অপরিহার্য ছিল। এই হিসেব অনুসারে বার মাসে সর্বমোট ২৪টি রোজা পাওয়া যায়। কোন কোন ব্রাহ্মণ কার্তিক মাসে প্রত্যেক সোমবারে উপবাস ( রোজা) ব্রত পালন করেন। হিন্দু যোগীরা চিল্লা পালন করে অর্থাৎ তারা চল্লিশ দিন পর্যন্ত পানাহার বর্জন করে উপোস থাকার প্রচেষ্টা চালায়। ভারতবর্ষের সকল ধর্ম মতে বিশেষ করে জৈন ধর্মের মাঝে রোজা পালনের শর্তাবলী অত্যন্ত কঠিন। তাদের মতানুসারে চল্লিশ দিন পর্যন্ত ১টি রোজা প্রলম্বিত হয়। গুজরাট এবং দাক্ষিণাত্যে প্রতি বছর জৈন ধর্মের অনুসারীরা কয়েক সপ্তাহ যাবৎ রোজা ব্রত পালন করে। প্রাচীন মিসরীয়দের মাঝেও রোজাকে অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির অন্তর্ভুক্ত দেখা যায়। গ্রীক ধর্মানুসারীদের মাঝে শুধু কেবল মহিলারা ‘থাসমো ফেরিয়া-এর ৩য় তারিখে রোজা রাখত। পার্শিয়ান ধর্মে যদিও সাধারণ অনুসারীদের উপর রোজা ফরজ নয়। কিন্তু তাদের ইলহামী কিতাবের একটি শ্লোক দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তাদের উপর রোজার হুকুম প্রযোজ্য ছিল বিশেষ করে ধর্মীয় নেতাতের জন্য পাঁচ বছর রোজা রাখা আবশ্যক ছিল। (ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা : ১০ম খ-, ১৯৩-৯৪ পৃষ্ঠা, একাদশ সংস্করণ)।
ইহুদীদের মাঝেও রোজা ছিল আল্লাহর আরোপিত ফরজ ইবাদত। হযরত মূসা (আ:) কুহে তুরে চল্লিশ দিন পর্যন্ত ক্ষুৎ-পিপাসার ভিতর দিয়ে অতিবাহিত করেছেন। (নির্গমন : ৩৪-৩৮) সুতরাং সাধারণভাবে হযরত মূসা (আ:)-এর অনুসারীদের মাঝে চল্লিশ দিন রোজা রাখাকে উত্তম বলে বিবেচনা করা হত। কিন্তু তাদের উপর চল্লিশতম দিনে রোজা রাখা ফরজ যা তাদের সপ্তম মাসের (তাশরিন) দশম তারিখ পড়ত। তৌরাত : সফরুল আহবার : ১৬-২৯-৩৪ : ২৩-২৭) এ জন্য এই দশম দিনকে আশুরা বলা হত। আর আশুরার এই দিনটি ছিল ঐ দিন যে দিন হযরত মূসা (আ:)-কে তৌরাতের ১০টি আহকাম দান করা হয়েছিল। এ জন্য তৌরাত কিতাবে এই দিনের রোজাকে পালন করার প্রতি জোর তাকীদ করা হয়েছে। বস্তুত উপরোল্লিখিত দিক-নির্দেশনা ছাড়া ইহুদীদের অন্যান্য ছহীফাসমূহের মাঝে অন্যান্য দিনের রোজার হুমুক-আহকামও বিস্তৃতভাবে পাওয়া যায়। (প্রথম শামুয়েল ৭-৬ এবং ইয়ারমিয়া ৩৬-৬) খৃস্টান ধর্মে বর্তমানকালেও রোজার প্রভাব বিদ্যমান। হযরত ঈসা (আ:)ও চল্লিশ দিন পর্যন্ত জঙ্গলে অবস্থান করে রোজা রেখেছেন। (মথি : ৪-২) হযরত ইয়াহইয়া (আ:) যিনি হযরত ঈসা (আ:)-এর সমসাময়িক ছিলেন তিনিও রোজা রাখতেন এবং তার উম্মতগণের মাঝেও রোজা রাখার রীতির প্রচলন ছিল। (মার্কস : ২-১৮) ইহুদীরা বিভিন্নকালে অসংখ্য ঘটনাবলীর স্মৃতিস্বরূপও এর সাথে অনেকগুলো রোজা সংযোজন করেছিল। এর অধিকাংশই ছিল বেদনাময় স্মৃতির স্মরণিকা। এই সকল রোজার মাধ্যমে তারা নিজেদের অতীত বেদনাময় স্মৃতিগুলোকে উজ্জীবিত করে তুলত। এমন কি দেহ-মনের মাঝেও বেদনার ছাপ ফুটিয়ে তুলত। কোযাত ২০-২৬, ১ম শামুয়েল ৭-৬ ও ৩১-১৩ এবং লুক : ৬-১৬) হযরত ঈসা (আ:) স্বীয় আমলে কিছুসংখ্যক রোজা রাখার অনুমতি বা অবকাশও ছিল। একবার কতিপয় ইহুদী সমবেত হয়ে হযরত ঈসা (আ:)-এর নিকট এই আপত্তি উত্থাপন করল যে, তোমার অনুসারীরা কেন রোজা রাখছে না। হযরত ঈসা (আ:)- এর জবাবে বললেন, ‘তবে কি বরযাত্রীগণ যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের সাথে অবস্থান করে তারা ততক্ষণ পর্যন্ত রোজা রাখত পারে না। সুতরাং এমন এক সময় আসবে যখন দুলা তাদের সাথে থাকবে না তখন তারা রোজা রাখবে।” (মার্কস : ২-১৮)
এই দিকনির্দেশনায় দুলা বলতে নির্দেশ করা হয়েছে হযরত ঈসা (আ:)-এর পবিত্র সত্তাকে এবং বরযাত্রী বলা হয়েছে তার অনুসারী হাওয়ারীদের। এ কথা সুস্পষ্ট যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোন স্বীয় উম্মতের মাঝে অবস্থান করেন ততক্ষণ উম্মতদের শোক পালনের কোন প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় না। সুতরাং উপরোল্লিখিত বর্ণনার দ্বারা বুঝা যায় যে, হযরত ঈসা (আ:) হযরত মূসা (আ:)-এর আমলে প্রবর্তিত ফরজ এবং মুস্তাহাব রোজাসমূহকে নয়; বরং শোক পালনার্থে প্রচলিত নব্য রোজার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন এবং তিনি স্বীয় অনুসারীদের পূর্ণ আন্তরিকতা ও বিশুদ্ধচিত্ততার সাথে রোজ রাখার উপদেশ প্রদান করতেন। যেমন “অতঃপর তোমরা যখন রোজা রাখবে তখন লোক দেখানো মনোবৃত্তি সম্পন্ন মানুষের মত নিজেদের মুখম-লকে উদাস করে রাখবে না। কেননা, এ শ্রেণীর লোক নিজেদের মুখম-লের আসল রূপ বিকৃত করে ফেলে যেন মানুষ মনে করে যে, তারা রোজাদার। আমি তোমাদের কাছে সত্য কথাই বলছি। এ শ্রেণীর লোকেরা তাদের বিনিময় পেয়ে গেছে। সুতরাং তোমরা যখন রোজা রাখবে তখন মাথায় তেল ব্যবহার করবে, মুখম-ল ধৌত করবে। এতে করে তোমরা মানুষের নিকট নয়; বরং তোমাদের পিতার নিকট গোপনীয়ভাবে অবস্থান করবে। তোমরা যা রোজাদার তা সুস্পষ্ট এবং তোমাদের পিতার নিকট যা প্রছন্ন ও গোপনীয় তিনি তার সরাসরি প্রতিফল ও বিনিময় অবশ্যই প্রদান করবেন। (মথি : ৬-৬-৭)
অপর এক স্থানে হযরত ঈসা (আ:)-এর নিকট তাঁর অনুসারীরা জিজ্ঞেস করল যে, আমরা আমাদের অপবিত্র অন্তরসমূহকে কিভাবে দূর করে দিতে সক্ষম হব? প্রত্যত্তরে হযরত ঈসা (আ:) বললেন, অন্তরসমূহের কলুষতা ও অপবিত্রতাকে দোয়া এবং রোজা ছাড়া দূর করার কোন ব্যবস্থা নেই। (মথি : ১৭-২১)
আরববাসীরাও ইসলামের পূর্বে রোজা সম্পর্কে কমবেশি ওয়াকিবহাল ছিল। মক্কার কোরাইশগণ অন্ধকার যুগে আশুরার (অর্থাৎ ১০ মুহররম) দিনে এ জন্য রোজা রাখত যে, এই দিনে খানায়ে কাবার উপর নতুন গেলাফ চড়ানো হত। (মুসনাদে ইবনে হাম্বল : ষষ্ঠ খ-, ২৪৪ পৃ:) মদীনায় বসবাসকারী ইহুদীরাও পৃথকভাবে আশুরা উৎসব পালন করত। (সহীহ বুখারী : কিতাবুস সাওম, ১ম খ-, ১৬২ পৃ:) অর্থাৎ ইহুদীরা নিজেদের গণমানুসারে ৭ম মাসের ১০ম দিনে রোজা রাখত।
উপরোক্ত বিশ্লেষণের দ্বারা একথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয় যে, কোরআনুল কারীমের নির্দেশ, “তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল” কতখানি ঐতিহাসিক সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত।
রোজার হাকীকত: মানুষের সকল প্রকার আত্মিক অবনতি ও দুর্ভাগ্যসমূহকে এবং তার অসফলতার কার্যকারণসমূহ যদি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে সর্বশেষ পরিণাম ফল এই দাঁড়াবে যে, পৃথিবীর বুকে মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনসমূহের প্রতি মুখাপেক্ষি এবং তারা বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুসরণ করে চলে। তাদের অন্তরের যে কোন অনুকম্পন এবং তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্ভুত যাবতীয় চেষ্টা ও তদবীর কোন প্রয়োজন এবং উদ্দেশ্য থেকে খালি নয়। নৈতিক অবস্থা যার সার্বিক সম্পর্ক আত্মিক অবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট। যদি এর তাহকীক করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে, এর ভিত্তিও সাধারণত কোন না কোন প্রয়োজন অথবা গরজে নফসানীর উপর অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত। এ জন্য আমাদের সকল প্রকার দুর্ভাগ্য, অপবিত্রতা এ সকল কারণেই ফলশ্রুতি মাত্র। সুতরাং প্রয়োজন এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যদি মানুষের সংস্পর্শে থেকে বহু দূরে চলে যায় এমনকি এগুলোর ছোঁয়া হতে মানুষ যদি সম্পূর্ণরূপে অমুখাপেক্ষি ও বিমুক্ত হয়ে যায় তাহলে সে আর মানুষরূপে বরিত হবে না বরং তাকে ফেরেশতা বলাই সমীচীন হবে।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, মানুষের প্রয়োজনসমূহ এবং তাদের বিভিন্নমুখী আশা-আকাক্সক্ষা এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা একটি বৃহত্তর পরিসরে সীমাহীনরূপে পরিদৃষ্ট হয় এগুলোর আসল হাকীকত কি? আমাদের অন্তরে রয়েছে আশা-আকাক্সক্ষার একটি খনি এবং ইচ্ছা ও অভিব্যক্তির সুবিশাল প্রান্তর এবং সেখানে অবস্থান করছে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে অসংখ্যা প্রয়োজনীয়তার অগণিত সম্ভার। কিন্তু তাই বলে কি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাকাদি, আলীশান ইমারতরাজি, সুস্বাদু আহার্য সামগ্রী এবং দ্রুতগামী যানবাহনসমূহ ছাড়া আমরা বেঁচে থাকতে পারি না? আমাদের সন্তান-সন্ততি, পরিবার-পরিজন, অর্থ-সম্পদ এবং আমাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও চাকর-বাকরদের পরিবেষ্টিত অবস্থার
বিপরীত পরিম-লে আমাদের জীবনী শক্তি ও ব্যক্তিসত্তার কি সমাধি রচিত হয়ে যাবে? অনেক রাজা-বাদশাহ ফকিরদের মতো জীবন অতিবাহিত করেছেন। সাধারণ্যের প্রচলিত কথায় জানা যায়, ইব্রাহীম আদহাম বাদশাহ হয়েও ফকিরী গ্রহণ করেছিলেন এবং আনন্দ ও তৃপ্তির সাথে রূহানী জিন্দেগী অতিবাহিত করেছিলেন।
স্বীয় উদ্ভাবিত প্রয়োজনসমূহের বিলুপ্তি এবং বিস্মৃতির পর মানুষের মৌলিক প্রয়োজনীয়তাসমূহের বিস্তৃত পরিম-ল হয়তো সামান্য দু-একটি বিন্দুর মতোই থেকে যাবে এবং তা হলো শক্তি ও গেজা অর্থাৎ দানা এবং পানি, যা ব্যতীত মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। রূহ এবং প্রাণের দেহের মাঝে অবস্থিত শুধু সদ্দে রমক (শুধু কেবল প্রাণ রক্ষা পায় এ পরিমাণ) হলেই অব্যাহত থাকে। সদ্দে রমক শুধু কয়েক লোকমা আহার্য এবং কয়েক ঢোক পানির ওপরই নির্ভরশীল। এ কথা সত্যি যে, এরপর মানুষের সব প্রয়োজনের উৎস ও উৎপত্তিস্থল এসব কয়েক লোকমা খাদ্য এবং কয়েক ঢোক পানির সুবিস্তৃত অবস্থাও স্বল্পতাহেতু জটিলতার পরিণাম মাত্র। এই দৃষ্টিকোণ থেকে একজন মানুষ এবং একজন ফেরেশতা অর্থাৎ আলমে নাসুত এবং আলমে মালাকুতের দুই বাসিন্দাদের মাঝে বিভেদ ও পার্থক্যের দেয়াল যদি কায়েম করা যায় তাহলে শুধু এই জিনিসটিই যাবতীয় পৃথকীকরণ ও শ্রেণীভেদকে পরিবেষ্টন করে রাখবে। মানুষের সব অপরাধ ও গোনাহসমূহের সূচি যদি তৈরি করা যায় এবং লোভ-লালসা এবং হত্যা ও রক্তপাতের সর্বশেষ কারণসমূহ যদি তালাশ করা হয় তাহলে সেই দুটো জিনিসের বিস্তৃতি ও স্বল্পতা এবং জীবন ধারণের জন্য কঠিন পরিশ্রমের একমাত্র উপাদান হিসেবেই এগুলোকে অনুভব করা যাবে।
এসব কারণে দুনিয়ার সব মাযহাবে বস্তুভিত্তিক অপবিত্রতা থেকে মুক্ত ও পবিত্র থাকার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকাকে প্রাথমিক অপরিহার্য শর্ত হিসেবে স্থিরীকৃত করেছে। এর আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, মানুষ যেন পর্যায়ক্রমে নিজের প্রয়োজনীয়তাসমূহের পরিম-লকে সংক্ষিপ্ত এবং সঙ্কুচিত করে তোলে এবং শক্তি ও আহার্র্যের অনুসন্ধান এবং লোভ-লালসা থেকে নিস্তার লাভের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা জারি রাখে। কেননা, মানুষের যাবতীয় অপরাধ ও গুনাহসমূহ এই একক শক্তিমত্তার সর্বশেষ পরিণাম ফল। যদি ইই অন্বেষা ও প্রয়োজনীয়তা দূরীভূত হয়ে যায়, তাহলে ক্রমাগতভাবে আমরা আলমে নাসুতে অবস্থান করেই আলমে মালাকুতের সমুজ্জ্বল প্রভা ও দীপ্তি অবলোকন করতে সক্ষম হব। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ শুধু কেবল মানুষ হিসেবেই অবস্থান করবে ততক্ষণ পর্যন্ত আহার্য বস্তু হতে সামগ্রিকভাবে অমুখাপেক্ষী হওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে এসব আবিলতা হতে মুক্ত থাকার জন্য বিশ্বের সব ধর্মেই একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই সময়সীমার মাঝে সব মানুষই মানবিক প্রয়োজনীয়তার নিগঢ় হতে স্বল্প সময়ের জন্য বিমুক্ত থাকতে পারে এবং এই স্বল্প সময়ের মনোনিবেশ দ্বারা মালায়ে আলা ঊর্ধ্ব জগতের পবিত্রতম পরিম-লে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। যেহেতু এই পৃথিবীর জীবন কেবলমাত্র আল্লাহপাকের ইবাদত ও বন্দেগীর মাঝেই অতিবাহিত করতে হবে, সেহেতু এ পৃথিবীর সব ধর্মের মানুষই নিজেদের জীবন পরিক্রমার স্বল্পতম সময়ে যথাসম্ভব রোজার ভিতর দিয়ে সেই দায়িত্ব ও কর্তব্যকে পালন করতে পারে।
কোরআনুল কারীমে সিয়াম সাধনার এসব হাকীকত ও মানদ-কে শুধুমাত্র একটি শব্দের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সে শব্দটি হলো তাকওয়া বা পরহেজগারী। রোজার হাকিকত ও বিশেষত্ব সুলভ তাকওয়া ও পরহেজগারী পৃথিবীর সব ধর্মেই একইভাবে অবলম্বন করা হয়েছে। এ কারণে কোরআনুল কারীমও অন্য ধর্মগুলোকে রোজার এই অভ্যন্তরীণ হাকীকতের সাথে সম্পৃক্ত করে ঘোষণা করেছে, “তোমাদের উপর সিয়াম ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল যাতে করে তোমরা তাকওয়া ও পরেহজগারী অর্জন করতে পার।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৩) প্রকৃতপক্ষে রোজার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে তাকওয়া ও পরহেজগারী অর্জন করা। অর্থাৎ নিজের খাহেশতাকে নিজের আওতাভুক্ত রাখা এবং দৈহিক কামনাবাসনার তীব্র প্রভঞ্জনের ছোঁয়াচ হতে নিজেকে বিমুক্ত রাখা। এর দ্বারা সুস্পষ্ট বোঝা যায় যে, রোজা আমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে এক প্রকার রূহানী চিকিৎসা হিসেবে। শুধু তাই নয়, আল-কোরআনে ইসলামে রোজার ওপর দুটো সুনির্দিষ্ট বিশেষত্বের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “যেন আল্লাহপাক তোমাদেরকে যে পথ প্রদর্শন করেছেন সে মোতাবেক তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করতে পার এবং আল্লাহর শোকর গুজারী আদায় কর।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৩)
এই মৌলিক দিকনির্দেশনার বিশ্লেষণ করার লক্ষ্যে আমাদেরকে অবশ্যই রমজানুল মুবারকের দিকে নজর দিতে হবে। কেননা, রমজানের মূল হাকীকত অনুধাবন না করা পর্যন্ত এই বিশেষত্বটি আমরা পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হব না।
রমজানের হাকীকত: এই বস্তুময় পৃথিবী যেভাবে বস্তুভিত্তিক নিয়ম-শৃঙ্খলা এবং আইনের আওতাভুক্ত তেমনি আল্লাহপাক রূহানী জগতেও এই শ্রেণীর একটি নিয়মশৃঙ্খলা বিধান এবং কার্যকারণ সম্পর্কিত বিষয়ের সিলসিলা কায়েম রেখেছেন। যে বিশ্বাসের সাথে আপনি এই দাবি করতে পারেন যে, বিষ মানুষের ধ্বংসকারী ঠিক সেই বিশ্বাসের সাথে আত্মিক রোগসমূহের চিকিৎসক বলতে পারেন যে গুনাহ হচ্ছে মানুষের রূহের হত্যাকারী। অর্থাৎ গুনাহ মানুষের রূহানী শক্তিকে হত্যা করতে সক্ষম। পয়গাম্বরগণ নুবওতসুলভ ফয়েজ ও বরকতসমূহকে কবুল করার জন্য নিজেদের রূহে কীভাবে শক্তি উৎপাদন করেন দুনিয়ার বুকে কখন আবির্ভূত হন তাদের মুজিজাসমূহ কোন সময়ে অনুষ্ঠিত হয় এবং তারা নিজেদের এই দাবিকে কীভাবে উপস্থাপন করেন, অস্বীকৃতি ও বিরুদ্ধবাদিতার প্রবাহকে কীভাবে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তিত করেন এবং কীভাবে আহ্বান অস্বীকারকারীরা বিফল এবং ভগ্নমনোরথ হয় এবং বিশ্বাসীগণ সফল এবং কামিয়াবরূপে গড়ে ওঠেন। সুতরাং এসব প্রতিটি বস্তুর বিকাশ সুনির্দিষ্ট ও সুনিয়ন্ত্রিত একক বিধান মোতাবেকই পরিসাধিত হতে থাকে। আল- কোরআনের সর্বমোট ১৩টি স্থানে সুন্নাতুল্লাহ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু এর প্রত্যেকটির মাঝেই বেশির ভাগ রূহানী শৃঙ্খলা বিধান ও নিয়মনীতির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
ইতিহাস বিশারদগণ যেভাবে রাজনৈতিক ঘটনাবলির বার বার আগমন এবং বিভিন্ন বৈপ্লবিক কর্মকা-কে বার বার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে শেষ পরিণাম পর্যন্ত উপনীত হয়ে সাধারণ ইতিহাসের নিয়ম-নীতি ও প্রবর্তন করেন ঠিক তেমনি আম্বিয়ায়ে কেরামের জীবনেতিহাস এবং দিন-তারিখ ও ঘটনাবলীকে বার বার উপস্থাপনের দ্বারা নবুওতের বৈশিষ্ট্যাবলীর নিয়মনীতিকে আমাদের জন্য বিন্যস্ত করা হয়।
পয়গাম্বর সুলভ এসব ইতিহাস এবং নিয়মনীতির মাঝে একটি হচ্ছে এই যে, নবী স্বীয় মানবতার পরিপূর্ণতা লাভ করে নবুওতের খায়ের ও বরকতকে কবুল করা এবং যোগ্যতা লাভের জন্য এন্তেজার করতে থাকেন তখন তিনি একটি সময় পর্যন্ত মানবিক দুনিয়ার সমুদয় কর্মকা- হতে পৃথক হয়ে মালাকুতি বৈশিষ্ট্যাবলীর মাঝে সমাসীন হন। সে সময় হতেই তার দিল ও দেমাগে আল্লাহপাকের ওহীর প্রসবন তরঙ্গের সৃষ্টি করতে থাকে। সিনাই পর্বতের মর্যাদাপূর্ণ পয়গাম্বর হযরত মূসা (আ.) যখন তৌরাত গ্রহণ করার জন্য গমন করলেন তখন চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত অভুক্ত অবস্থায় অতিবাহিত করেছিলেন। (প্রন্থান : ৩৪-৩৮) তাছাড়া ছায়ীর পর্বতে আগমনকারী পবিত্র সত্তা [হযরত ঈসা (আ.)] ইঞ্জিলের বাণী লাভ করার পূর্বে চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত পর্যন্ত সিয়াম পালন করেছিলেন। (মথি : ৪-২) অনুরূপভাবে ফারানের অগ্নিখরা শরীয়তধারী পয়গাম্বর (রাসূলুল্লাহ (সা.)] কোরআন অবতীর্ণের পূর্বে একমাস পর্যন্ত মক্কার হেরা নামক গিরি গুহায় সকল প্রকার ইবাদত-বন্দেগীতে নিমগ্ন ছিলেন। পরিশেষে সে অবস্থায় নামুসে আকবর [হযরত জিব্রাঈল (আ.)] “পাঠ কর তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন” এই প্রাণস্পর্শী শুভ সংবাদ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। (সহিহ বুখারি : বাদউল ওহী অধ্যায়, এক মাসের বর্ণনা, সহীহ মুসলিম : কিতাবুল ঈমান কা-ে এবং সীরাতে ইবনে হিশাম গ্রন্থে সন্নিবেশিত আছে)
আল-কোরআনে এই বরকতময় ঘটনাকে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “রমজান মুবারকের ঐ মাস যে মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-২৩) এই ঘটনাটি কোনো পবিত্র রজনীর ইতিহাস? আল-কোরআনে এর কথাও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “নিশ্চয়ই আমি এই কোরআনকে এক বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি।” (সূরা কদর : রুকু-১) এই আয়াতসমূহের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রমজান সেই পবিত্রতম মাস যেখানে সর্বপ্রথম কোরআনুল কারীম দুনিয়াতে নাজিল হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সমগ্র জগতের পথ নির্দেশনা এবং মানুষের উপকার ও হিত সাধনের লক্ষ্যে আল্লাহর সংবিধানের সর্বপ্রথম পৃষ্ঠাটি প্রদান করা হয়েছে। কোরআনুল কারীমের বহনকারী এবং ওহীয়ে ইলাহীর সংরক্ষণকারী এই উভয় ব্যক্তি সত্তা একই গিরি গুহার অভ্যন্তরে ক্ষুৎপিপাসায় অত্যন্ত কাতর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন। একই কারণে এই পবিত্র মাসে অভুক্ত থাকা এবং পিপাসার্ত থাকা (রাজা) এবং কোন ইবাদতগাহে একাকী অবস্থান করা (ইতেকাফ) এবং অহী নাজিলের রাতে (লাইলাতুল কদর) বিনিদ্র থাকা এবং বিনীতভাবে রাত অতিবাহিত করা শরিয়তে মোহাম্মদীর অনুসারীদের একান্ত কর্তব্য। তাইত পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন, “যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস তাহলে আমার অনুসরণ কর। আল্লাহপাক তোমাদেরকে ভালবাসবেন।” (সূরা আলে ইমরান : রুকু-৪)
এক্ষেত্রে একটি বিষয় স্মরণ রাখা দরকার যে, বিভিন্ন বর্ণনার দ্বারা এ কথা সুস্পষ্টভাবে জানা যায় না যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) হেরা গিরি গুহায় রোজা রাখতেন। যেমন বুখারী বাদউল ওহী অধ্যায় এবং সীরাত হিশামের দ্বারা জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) হেরা গিরি গুহায় রোজা রেখেছিলেন। কিন্তু তবু ইঙ্গিত-ইশারার দ্বারা অনুধাবন করা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্যান্য ইবাদতের সাথে হেরা গিরি গুহায় রোজাও পালন করতেন। এ প্রসঙ্গে সহীহ বুখারি ও সীরাতে ইবনে হিশামে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সে সময়ে তিনি ইতেকাফ এবং রোজা অবস্থায় অতিবাহিত করেছিলেন।
বর্তমানকালের কতিপয় অভিজ্ঞ গ্রন্থকারগণও কোরআনুল কারীমের ইঙ্গিত-ইশারাকে অবলম্বন করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) সে সময়ে রোজা রেখেছিলেন। (খুদরী মিসরীর তাসরিউল ইসলামী : পৃষ্ঠা ৮ এবং ৪৩)
এই বিস্তীর্ণ বিশ্লেষণের দ্বারা বোঝা যায় যে, রোজা, ইতেকাফ এবং লাইলাতুল কদরের হাকীকত ইসালামের দৃষ্টিতে কতখানি এবং এ কথাও বোঝা যায় যে, পবিত্র রমজান মাসকে রোজার জন্য ইসলাম কিসের ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট করেছে। এ জন্য এই পবিত্র মাসে সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে নয়; বরং অবস্থা ও আকর্ষণের ভিত্তিতে অনুপ্রাণিত হওয়া একান্ত দরকার। যে মাসে কোরআনের ধারক ও বাহক অনুপ্রাণিত ছিলেন যে, ইহা দুনিয়ার হেদায়েত লাভ এবং রাহনুমায়ির ক্ষেত্রে স্মরণীয় ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অনুপ্রেরণা ও আস্থার আকর্ষণ কোরআনুল কারীমের বাণীবাহকের অনুকরণে আমরাও নিজেদেরকে একান্তভাবে অনুপ্রাণিত ও আকর্ষিত করে তুলি। এই হেদায়েত ও পথ নির্দেশনা লাভ করার ফলে আমাদের শোকর গুজারী ও আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনার কোটা পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে।
রোজা ফরজ হওয়ার উপযুক্ত সময়: হিজরি দ্বিতীয় সালই ছিল রোজা ফরজ হিসেবে আরোপিত হওয়ার উপযুক্ত সময়। এখানে উল্লেখ্য যে, ইসলামী ইবাদত যদি দেহ-প্রাণের সংযোগ হতে খালি হতো এবং এর দ্বারা দৈহিক অনুশীলন লক্ষ্যণীয় হতো তাহলে নামাজের পূর্বেই রোজা ফরজিয়ত আরোপিত হতো। সাধারণ্যে প্রচলিত মতানুসারে রোজা হচ্ছে উপবাস পালন করার নাম। আরব দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থায় কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সৌভাগ্য নসীব হওয়া স্বাভাবিক ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পর অবিশ্বাসী কাফেররা মুসলমানদের যেসব পেরেশানি ও দুশ্চিন্তায়
নিমগ্ন করেছিল এর ফলে তাদেরকে আরবে প্রচলিত সাধারণ রুজিরোজগারের দিক থেকেও অস্বস্তিকর পরিবেশে ফেলে দিয়েছিল। যেসকল লোক রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদর্শন করেছিল সে সকল গোত্রের লোকজন তাদের সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। এমতাবস্থায় রোজা এমন একটি অবশ্য পালনীয় ইবাদত ছিল যা আরব দেশের সাধারণ অবস্থা এবং মুসলমানদের বর্তমান জিন্দেগীর জন্য খুবই উপযোগী বিবেচিত হতে পারত। কেননা, নামাজ এবং হজের মতো এতে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিরও আশঙ্কা ছিল না। বস্তুত রোজা ছিল এক প্রকার নিশ্চুপ ইবাদতের তরীকা যা কোনো প্রকার বাধা-বিপত্তি ছাড়াই জারি রাখা সম্ভব ছিল। কিন্তু ইসলাম ইবাদতকে রুহানী রোগসমূহের ওষুধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। যার ব্যবহার তখনই করা শোভনীয় যখন রুহানী রোগসমূহ আত্মপ্রকাশ করে অথবা এগুলো সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। যৌন ক্ষুধার আকর্ষণ এবং পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের মনোহারিত্ব এবং অনুভূতি লব্ধ বিষয়াবলীর আস্বাদও এগুলোর মাঝে আত্ম-নিবেদনের দ্বারা যে সকল রোগ-বালাই পয়দা হওয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল মক্কা মুয়াজ্জমাতে এ সকল উপায় উপাদানের সহজ লভ্যতা মোটেই ছিল না। তাছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাফেরদের জুলুম ও অত্যাচার এ সকল ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষাকে দূরীভূত করে দিয়েছিল। এ জন্য সেখানে এই রুহানী চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা বড় একটা প্রকট রূপ ধারণ করেনি।
রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনা মোনাওয়ারায় তশরীফ আনয়নের পর কাফেরদের এ সকল অন্যায় অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ মিলে এবং আনসারদের আত্মোৎসর্গকারী মনোবৃত্তি মুসলমানদের দরিদ্রতা ও দুঃখ-দুদর্শাকে সর্বাংশে লাঘব করে দিয়েছিল। একই সময়ে দেশ জয়ের সিলসিলাও শুরু হয়। এতে করে দিন দিন অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ পর্যায়ে এমন একটি সময় এসে গিয়েছিল অথবা অত্যন্ত নিকটবর্তী হয়ে পড়েছিল যে, দুনিয়া আপন আসল অকৃতিতে মুসলমানদের কাছে আবির্ভূত হয়ে তাদেরকে স্বীয় অপরিহার্য কর্তব্য পালনে অভ্যস্ত করে তুলেছিল। এ জন্য এই সময়টি ছিল অনুপ্রবেশের মৌসুম। যেখানে রোগ উৎপাদনকারী জীবাণুসমূহ থেকে বেঁচে থাকার আবশ্যকতা ছিল প্রবল। এই বেঁচে থাকার বা প্রতিরোধ করার ঢালই ছিল রোজা যা হিজরী দ্বিতীয় সালে ফরজ হয়। (তারিখে ইবনে জারীর তাবারী ঃ জুরকানী, ১ম খ-, ৪৭০ পৃষ্ঠা; জাদুল মা’আদ : ১ম খ-, ১৬০ পৃষ্ঠা)
এই সন্দেহ দূর হয়ে যায় যা কোন কোন মূর্খদের মাঝে দেখা দিয়েছিল যে, ইসলামের প্রারন্তে অভাব-অনটনের দরুন অধিকাংশ সময় মুসলমানদের উপোস করতে হয়েছিল এবং এভাবেই তাদেরকে রোজা রাখায় অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছিল। অথচ ইসলামী বিধান মোতাবেক অভুক্ত অবস্থায় রোজা পালনের যতটুকুন প্রয়োজনীয়তা ছিল পেট পুরে আহারকারীদের জন্য উপবাস পালন করে অধিক আবশ্যক ছিল। আল্লামা ইবনে কাইয়ুম জাদুল মা’আদ গ্রন্থে লিখেছেন, জৈবিক তাড়নার উপাদানসমূহ বর্জন করা খুবই কঠিন কাজ ছিল। এ জন্য রোজাকে নবুওতকালে ফরজ করা হয়েছিল। যখন মানুষ তাওহীদ, নামাজ এবং আহকামে কোরআনের অনুসারী হয়ে উঠেছিল। এ জন্য ইসলামী আহকামের মাঝে অন্তর্ভুক্তির জন্য হিজরী দ্বিতীয় সাল ছিল খুবই উপযোগী।