নির্মাণসামগ্রীর উচ্চমূল্য, মূল্যস্ফীতিসহ নানান কারণে সংকটে দেশের আবাসন শিল্প। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) নিয়ে আগে থেকেই নাখোশ ছিলেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। নতুন ড্যাপে (২০২২) যোগ হয়েছে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার)। জমি অনুযায়ী ভবনের উচ্চতা-আকারে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এতে আগ্রহ হারাচ্ছেন ব্যবসায়ী-জমির মালিক উভয়েই। আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ফার অনুযায়ীই নতুন ভবনের নকশা অনুমোদন দিচ্ছে রাজউক। এতে নতুন প্রকল্প কমে যাওয়ায় মুখ থুবড়ে পড়ছে আবাসন খাত। তবে রাজউক বলছে, সবার জন্য জনকল্যাণমূলক বাসযোগ্য শহর করতে চায়। এটা গুরুত্ব দিয়েই খসড়া ইমারত নির্মাণ নীতিমালা করা হয়েছে। ফার কম-বেশির কারণে ব্যবসায়ী বা ভূমির মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। এখানে বাড়তি খরচ বা লোকসানের কিছু নেই। মেট্রো এলাকায় যেখানে ফার বেশি সেখানে অন্য সুবিধাও বেশি, বড় বিল্ডিং তৈরির সুযোগ আছে।-ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম
পশ্চিম ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা আহসান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঝামেলা এড়াতে কোনো ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে ভবন তৈরি করতে চান অনেকে। যেখানে সমানভাবে মালিকানা পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না ‘ফার’ (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) ইস্যুতে। আমাদের এখানে এরিয়া ফারের কারণে সাততলা করার অনুমোদন পাবো। যেখানে সাড়ে তিনতলা আমার ভাগে পড়বে। তাহলে কেন আমি প্ল্যান পাস করাবো বা ডেভেলপার কোম্পানিকে দেবো। এখনই আমার চারতলা বাড়ি আছে।’
কমেছে প্ল্যান পাস: আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন (রিহ্যাব) সূত্র বলছে, প্রতি বছর সাধারণত ১৮ থেকে ২০ হাজার প্ল্যান পাস হয়। রাজউকের ৮ জোনের প্রতিটিতে গড়ে দুই থেকে আড়াই হাজার প্ল্যান পাস করা হতো। ফার ও ড্যাপ ইস্যুতে এখন সেখানে এক হাজার থেকে ১২শ প্ল্যান পাস হচ্ছে।
ফার’র মারপ্যাঁচে নতুন ভবন নির্মাণে অনীহা: ইমারত নির্মাণ বিধিমালার খসড়া অনুযায়ী, কোনো এলাকায় ২০ ফুট রাস্তার ‘ফার’ ২ হলে করা যাবে চারতলা বাড়ি। ২০ ফুটের নিচে হলে ‘ফার’ আরও কমে দেড় বা পৌনে দুই হবে, যেখানে তিন থেকে সাড়ে তিনতলা বাড়ি করা যাবে। এতে জমি দিতে আগ্রহী হচ্ছেন না মালিকরা। কারণ ডেভেলপার কোম্পানি যেসব জমি নেয় সেখানে দুই থেকে তিনতলা বিল্ডিং ভেঙে ডেভেলপ করে। এতে জমি ডেভেলপ হলেও বাড়ি তিনতলাই থাকছে।
বাড়তি করের চাপে আবাসন খাত: এ কারণে ফার ইস্যুতে বৈষম্যের কথা বলছেন অনেক ভূমি মালিক। একই অভিযোগ রয়েছে ব্যবসায়ীদেরও। কাঁঠালবাগান এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার জমির দুই পাশে সুউচ্চ বিল্ডিং রয়েছে। একটা নতুন বিল্ডিং হচ্ছে সেটাও ১০ তলা। এখন আমি নতুন নিয়মের কারণে ছয়তলা ভবন করতে পারবো। অথচ আমার বাড়ির দুপাশেই বড় বড় বিল্ডিং।’
তবে এ বিষয়ে একটি জোনের পরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা রাজউকের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আবাসন ব্যবসায়ীদের দাবির কারণে আগের অনুমোদন হওয়া প্ল্যানের আলোকে বাড়ি তৈরি হবে। কিন্তু এখন নতুন করে যারা প্ল্যান নেবেন তাদের ফার অনুযায়ীই বিল্ডিংয়ের উচ্চতা, ফ্ল্যাটের সংখ্যা আসবে। আগের অনুমোদন হলে তা আগের মতোই হবে।’
ড্যাপের কারণে মৌলিক চাহিদার অন্যতম আবাসনের স্বপ্ন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সবার জন্য মানসম্মত আবাসন আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। পরিকল্পিত নগরায়ণের অন্তরায় ‘ফার’ বা ‘ড্যাপ’ কোনোটাই যাতে না হয় এ নিয়ে আমরা কাজ করছি।- রিহ্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০০৮ সালের নির্মাণ বিধিমালাটা বিজ্ঞানসম্মত ছিল না। এখন নগরে সবুজ নেই, রাস্তা নেই, ভালো পরিবেশ কমে আসছে। নতুন যে বিধিমালা করা হয়েছে সেটা বাস্তবসম্মত ও বিজ্ঞানসম্মত। ফার কম-বেশির কারণে ব্যবসায়ী বা ভূমির মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। আর বিল্ডিং কম হলে তো খরচও কম হবে। এখানে বাড়তি খরচ বা লোকসানের কিছু নেই। মেট্রো এলাকায় যেখানে ফার বেশি সেখানে অন্য সুবিধাও বেশি, বড় বিল্ডিং তৈরির সুযোগ আছে।’
কমেছে ফ্ল্যাট বিক্রি: রিহ্যাব সূত্র বলছে, ২০১০-২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ১৫ হাজারের কাছাকাছি ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়েছে। ২০১৩-২০১৬ পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে বিক্রি হয় ১২ হাজারের বেশি ফ্ল্যাট। ২০১৭-২০২০ পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ১৪ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি হয়। ২০২০ সালের জুলাই-২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রতি বছর ১৫ হাজারের কাছাকাছি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। এরপর ড্যাপ বাস্তবায়ন আর নির্মাণ উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে বিক্রি কমে আসে ফ্ল্যাটের। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিক্রি হয় ১০ হাজারের কাছাকাছি। সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরও কমে সেটি ১০ হাজারের নিচে অবস্থান করছে।
বেড়েছে ফ্ল্যাটের দাম: বিক্রি কমলেও দাম কমেনি ফ্ল্যাটের। মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে দাম। তিন বছর আগে যেসব ফ্ল্যাট প্রতি স্কয়ার ফুট ছিল পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা, সেটা এখন চলে গেছে ৮-১০ হাজারে। সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টের।
রিহ্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং ব্রিক ওয়ার্কস লিমিটেডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘ড্যাপের কারণে মৌলিক চাহিদার অন্যতম আবাসনের স্বপ্ন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সবার জন্য মানসম্মত আবাসন আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। পরিকল্পিত নগরায়ণের অন্তরায় ‘ফার’ বা ‘ড্যাপ’ কোনোটাই যাতে না হয় এ নিয়ে আমরা কাজ করছি।’
‘নতুন বিধিমালা অনুযায়ী ভবনের উচ্চতা ও আয়তনের সঙ্গে ফ্ল্যাটের সংখ্যা কমবে। এতে প্ল্যান পাস হচ্ছে না। আগামীতে ব্যবসায়ীরা আবাসন খাতে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হবেন, জমির মালিকও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সরকার বড় ধরনের রাজস্ব হারাবে।’
ফ্ল্যাট বিক্রি কম হওয়ার পরও দাম বেশি নিয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো প্রকল্প শেষ হতে দু-তিন বছর সময় লেগে যায়। এখন বিক্রি হওয়া ফ্ল্যাটও ওই সময়ের। এ সময়ের মধ্যে নির্মাণ উপকরণের দাম আকাশচুম্বি হয়েছে। সমন্বয় করা হয়েছে দাম। নির্মাণের প্রধান উপকরণ রডের দাম লাখ টাকার কাছাকাছি, ইট-বালু-সিমেন্টের দামও চড়া। এখন চাইলেই আপনি লোকসানে ফ্ল্যাট দিতে পারবেন না। নির্মাণ উপকরণের দাম কমলে আবার মধ্যবিত্তের নাগালে চলে আসবে দাম।’-জাগোনিউজ২৪.কম