সাহাবি শব্দের অর্থ হলো সঙ্গী বা সাথী। আর ইসলামী পরিভাষায় সাহাবি বলা হয় যারা ঈমানের হালতে জীবদ্দশায় স্বীয় চোখে রাসূল সা:কে দেখেছে এবং ঈমানের হালতেই মৃত্যুবরণ করেছে।
সাহাবিদের মার্যাদা অপরিসীম। আল কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- তারা আল্লাহ তায়ালার প্রতি রাজি খুশি আছেন এবং আল্লাহ তায়ালাও তাদের প্রতি রাজি খুশি। এখন প্রশ্ন হলো, কেন দুনিয়াতে থাকতেই তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা রাজি খুশি হয়ে গেলেন? তার উত্তর হলো- তারা পরিপূর্ণ মুমিন ছিলেন। আর তারা মুমিন হয়েছেন রাসূল সা:-এর হাতে বায়াত হয়ে ঈমান এনে রাসূল সা:কে অধিক ভালোবাসার কারণে। মুমিন হওয়ার জন্য অন্যতম একটি শর্ত হলো রাসূল সা:কে ভালোবাসতে হবে। সে ব্যাপারে হজরত আনাস ইবনে মালেক রা: বলেন, রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন- তোমাদের কেউ (পরিপূর্ণ) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তার কাছে তার বাবা-মা, সন্তান-সন্ততি ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় না হই।’ (বুখারি, হাদিস-১৫)
রাসূল সা:কে ভালোবাসা ও তাঁর আনুগত্য করা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন- ‘(হে নবী) বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমাকে অনুসরণ করো। আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-৩১)
এই আয়াতে রাসূল সা:কে ভালোবাসার সাথে সাথে আল্লাহর প্রতি বান্দার ভালোবাসার কথাও বলা হয়েছে। আর তা এভাবে যে রাসূল সা:কে ভালোবাসা ও তাঁর অনুসরণকে শর্ত করেছেন। সুতরাং রাসূল সা:কে ভালোবাসা ও তাঁর অনুসরণ ছাড়া আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব নয়।
আর মানুষের প্রতিও রয়েছে মানুষের ভালোবাসা। এটাই প্রকৃতির নিয়ম, মনুষ্যত্বের দাবি। কিন্তু প্রিয় নবী সা:-এর প্রতি তাঁর সাহাবিদের যে ভালোবাসা ছিল, সত্যিই তা পবিত্র ও অতুলনীয়। পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোনো নজির খোঁজে পাওয়া যায় না। অতুলনীয় সেই ভালোবাসার হৃদয়ছোঁয়া কয়েকটি দৃষ্টান্ত-
হজরত আবুবকর রা:-এর ভালোবাসা : ইসলামের সূচনালগ্নের কথা। তখন মাত্র ৩৯ জন লোক ইসলাম গ্রহণ করেছেন। প্রিয় নবী সা:-এর অনুমতিক্রমে হজরত আবুবকর রা: প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করলেন। প্রথম যে দিন বক্তৃতা করলেন সে দিনই মুশরিকদের গায়ে আগুন জ্বলে উঠল, হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা হজরত আবুবকর রা:-এর ওপর। ক্ষতবিক্ষত করে দিলো তার সারা শরীর। দীর্ঘ সময় বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইলেন তিনি। তারপর সম্বিত ফিরে পাওয়া মাত্রই প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, প্রিয় নবীজী সা: কেমন আছেন? তার মমতাময়ী মা ছেলেকে কিছু খাওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করলেন। কিন্তু হজরত আবুবকর রা: শপথ করে বললেন, নবীজীর সাক্ষাৎ লাভের আগে কোনো আহার গ্রহণ করবেন না। তখন মা ছেলেকে নিয়ে প্রিয় নবীজীর খেদমতে উপস্থিত।
এটাই হলো সত্যিকারের ভালোবাসা। যে ভালোবাসার কাছে পরম মমতাময়ী মায়ের স্নেহ-ভালোবাসাও হার মানে!
মহিলা সাহাবির ভালোবাসা : ওহুদ যুদ্ধে মুসলিমরা যখন বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তখন এক আনসারি মহিলা যুদ্ধে জড়িত লোকজনের কাছে ব্যাকুল হৃদয়ে জানতে চাইলেন, প্রিয় নবী সা: কেমন আছেন? এক ব্যক্তি বলল, তোমার বাবা শহীদ হয়ে গেছে। মহিলা শুধু ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়ে অসহ্য অস্থিরতায় আবারো জানতে চাইলেন, প্রিয় নবীজী কেমন আছেন? প্রিয় নবীর ভালোবাসার কাছে যেন আপন বাবার শাহাদাতের সংবাদও ম্লান হয়ে যাচ্ছে! এরপর একেক করে তার স্বামী, ভাই ও ছেলের শাহাদাতের সংবাদ জানানো হলো তাকে। কিন্তু তিনি ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ উচ্চারণ করে বারবার মানুষের কাছে শুধু প্রিয় নবীর কথাই জিজ্ঞেস করছিলেন। একসময় তিনি শুনতে পেলেন, প্রিয় নবী সা: ভালো আছেন। কিন্তু ব্যাকুল হৃদয় তাতেও শান্ত হলো না। এরপর নবীজীকে স্বচক্ষে দেখেই তবে শান্ত হলেন সেই আনসারি মহিলা। এটাই হলো প্রকৃত নবীপ্রেম। প্রিয় নবী সা:-এর প্রতি পবিত্র ভালোবাসা। যার উপমা মেলে না এ পৃথিবীতে।
জায়েদ বিন হারেসার ভালোবাসা : কিশোর সাহাবি হজরত জায়েদ বিন হারেসা রা: মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়ে আসার পর তার বাবা কেঁদে কেঁদে তাকে খুঁজে ফিরছিলেন। একসময় সন্ধান পেয়ে তার বাবা ও চাচা মদিনায় গিয়ে রাসূল সা:-এর দরবারে হাজির হলেন। তারা বিনীত সুরে আরজ করলেন, হে হাশেম বংশধর! আপনি বন্দী মুক্ত করেন, ক্ষুধার্তদের আহার দেন। মুক্তিপণ নিয়ে আমাদের ছেলেকে মুক্ত করে দিন।
রাসূল সা: জায়েদের বাবাকে বললেন, আপনি ওকে জিজ্ঞেস করুন, ও যদি যেতে চায় তাহলে আপনারা ওকে নিয়ে যান; মুক্তিপণের কোনো প্রয়োজন নেই। এরপর জায়েদ রা: উপস্থিত হলে রাসূল সা: আগন্তুক দু’জনের দিকে ইশারা করে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এদের চেনো? জায়েদ বললেন হ্যাঁ, ইনি আমার বাবা আর ইনি আমার চাচা। রাসূল সা: বললেন, যাও তোমার বাবার সাথে চলে যাও। বালক জায়েদ জবাব দিলেন, আমি আপনাকে রেখে কোথাও যাবো না।
হজরত জায়েদ ইবনে দাসানা রা:-এর ভালোবাসা : হজরত জায়েদ ইবনে দাসানা রা: কাফিরদের হাতে বন্দী হওয়ার পর পাপিষ্ঠরা তাকে শূলে চড়ানোর আয়োজন করে। তামাশা দেখার জন্য সমবেত হয় অনেক লোক। আবু সুফিয়ান তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি নরম সুরে জিজ্ঞেস করলেন, জায়েদ! সত্যি করে বলো তো; আল্লাহর শপথ দিয়ে তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি এটা পছন্দ করো যে, তোমার পরিবর্তে মুহাম্মদের গর্দান উড়িয়ে দেয়া হোক আর তোমাকে হাসিমুখে তোমার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হোক। হজরত জায়েদ রা: দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিলেন, আল্লাহর শপথ! নবীজীর যাত্রাপথে একটি কাঁটা লুকিয়ে রাখা হবে আর আমি ঘরে বসে আরাম করব, এতটুকুও আমার সহ্য হবে না।
হজরত জায়েদের জবাব শুনে সে দিন মক্কার কাফেররা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। আরব নেতা আবু সুফিয়ান মন্তব্য করেছিলেন, মুহাম্মদের প্রতি তার সাথীদের যে ভালোবাসা আমি দেখেছি, অন্য কারো প্রতি এমন ভালোবাসা আমি আর কখনো দেখিনি।
এই হলো সাহাবায়ে কেরামদের রাসূলপ্রেমের হৃদয়ছোঁয়া কয়েকটি দৃষ্টান্ত।
তাই প্রিয় নবীর উম্মত হিসেবে আমাদের মনেও তার প্রেম ভালোবাসা জাগাতে হবে। বাস্তবতার আলোকে ফুটিয়ে তুলতে হবে তার আদর্শ। তবেই আমরা শামিল হতে পারব তাদের মাঝে যারা রাসূল সা:কে বাস্তবেই ভালোবেসে আশেকে রাসূল হয়েছেন। লেখক : খতিব মসজিদে বায়তুন নূর, মাওনা, গাজীপুর।