আজ ১ জানুয়ারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের খ্যাতিমান অধ্যাপক ও বিশিষ্ট শিল্পকলা-ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ সিরাজুল ইসলামের জন্মদিন। খ্যাতিমান এই ব্যক্তিত্ব ১৯২৮ সালের পহেলা জানুয়ারি, পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার কালিয়াচক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ইদ্রিস আলী ছিলেন মালদহ জেলা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। ওই স্কুল থেকেই তিনি ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন এবং পরবর্তীতে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে আইএ এবং ১৯৪৬ সালে বিএ ডিগ্রি লাভ করে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। সেখানে অধ্যাপক সরস্বীকুমার সরস্বতী, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও এবিএম হবিবুল্লাহর মতো পণ্ডিতদের তত্ত্বাবধানে অধ্যয়ন করে ১৯৪৮ সালের এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এ কৃতিত্বের জন্য তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক প্রাইজম্যান সম্মাননা ও স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। ১৯৬১ সালে তিনি তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্দোলজি বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগেই শুরু হয় তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবন। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ওই বিভাগে লেকচারার হিসেবে কর্মরত ছিলেন খ্যাতিমান অধ্যাপক ড. মুহম্মদ সিরাজুল ইসলাম । পরবর্তীতে কলকাতারই বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে অল্প কিছুকাল অধ্যাপনা শেষে ১৯৫১ সালে তিনি লেকচারার হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। অধ্যাপক হবিবুল্লাহর নেতৃত্বে এই বিভাগের অগ্রযাত্রা তখন কেবল শুরু হচ্ছে। ১৯৮৮ সালে অধ্যাপক হিসেবে আনুষ্ঠানিক অবসর গ্রহণের আগে পর্যন্ত এই অগ্রযাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এই বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। তবে তাঁর কর্মক্ষেত্র শুধু এই বিভাগেই সীমিত ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও তিনি অধ্যাপনা করেছেন জার্মানির ইউনিভার্সিটি অফ বন এবং হার্ভার্ড-এর বিশ্ববিখ্যাত এমআইটিতে। ১৯৮০ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ বন-এ ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আর ১৯৮১ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত এমআইটিতে অধ্যাপনা করেন আগা খান ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে। এ সময় তিনি অধ্যাপনার পাশাপাশি নিবিড় গবেষণা করেছেন ভারতবর্ষের ইসলামি স্থাপত্য বিষয়ে।
লেখক ও সম্পাদক হিসেবে তিনি অনেকগুলো গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে পাকিস্তান এন্ড ইটস কালচার (১৯৬৬), মসজিদ-ই জামি, খায়েরপুর (১৯৭৬), কনটেমপোরারি আর্ট সিরিজ ১৯৭৬-৭৭ এবং আর্ট অফ বাংলাদেশ সিরিজের জয়নুল আবেদীন (১৯৭৭)। এছাড়াও তিনি জার্নাল অফ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং ইতিহাস পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশ-বিদেশের অসংখ্য সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে অংশ নিয়ে গবেষণামূলক নিবন্ধ উপস্থাপন করেছেন তিনি। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি জার্নালে তাঁর প্রায় অর্ধশত নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপনা ও গবেষণার পাশাপাশি তিনি সমান সফল ছিলেন প্রশাসক হিসেবেও। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ সিরাজুল ইসলাম, ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য এবং এরপর ১৯৮৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সামলেছেন বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব। তাঁর নেতৃত্বেই গড়ে তোলা হয়েছে কুষ্টিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ক্যাম্পাসটি। এছাড়াও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ সরকারের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্ল্যানিং অ্যাডভাইজর এবং নয়াদিল্লীর বাংলাদেশ দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলর হিসেবে। সংগঠক হিসেবে বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের জন্মলগ্ন থেকেই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন তিনি, এই প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ প্রাক্তন ছাত্র সমিতিরও যাত্রা শুরু হয়েছিল এই মহান শিক্ষকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। আজ ১ জানুয়ারি, খ্যাতিমান অধ্যাপক ড. মুহম্মদ সিরাজুল ইসলামের জন্মদিনে রইল আমাদের পরম শ্রদ্ধা।