বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব) শওকত আলী আর নেই। তিনি সোমবার সকাল অনুমান সাড়ে ৯টায় সমি¥লিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচএ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারাগেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি ছেলে ১ কন্যান সন্তান ও স্ত্রী সহ বহু গুনগ্রাহী রেখে গেছেন। গত ১৫ অক্টোবর থেকে ডায়াবেটিকস, উচ্চরক্তচাপ, কিডনি, কার্ডিয়াক জটিলতা, নিউমোনিয়া রোগে ভুগছেন কর্নেল (অব) শওকত আলী। গত ১ সপ্তাহ যাবত তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে লাইফ সার্পেটে রাখা হয়েছিল। তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে (নড়িয়া-সখিপুর) আসনের এমপি, পানি সম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামূল হক শামীম হাসপাতালে ছুটে যান এবং শোক জানায়, শরীয়তপুর-আসনের এমপি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কার্যকরী সদস্য ইকবাল হোসেন অপু, নাহিম রাজ্জাক এমপি মানবতা বিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত এর্টনী জেনারেল এড. সুলতান মাহমুদ সীমন, জেলা সভাপতি খোকা সিকদার ও অংগ সংগঠন সহ বিভিন্ন মহলের পক্ষথেকে শোক জানিয়ে শোক সন্তোপ্ত পরিবারকে সমবেদনা জানায়। শরীয়তপুর জেলা আইনজীবি সমিতির সকল সদস্য কোর্টের কার্যক্রম স্থগিত করে কালোব্যাচ ধারন করে জেলা আইনজীবির পক্ষথেকে শোক জানিয়েছে ।কর্নেল শওকত আলী শরীয়তপুর-২ নড়িয়া আসন থেকে ৬বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। যুবলীগের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য ডা. খালিদ শওকত আলী তার দ্বিতীয় পূত্র।
তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্ণেল (অব:) শওকত আলী অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর জন্ম ১৯৩৭সালের ২৭ জানুয়ারি শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার লোনসিং বাহের দিঘীরপাড় গ্রামে। তিনি ১৯৫৩ সালে পটুয়াখালী থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ঐ বছরই ঢাকায় এসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে আই এস সিতে ভর্তি হন। এরপর তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকার হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দ্দী কলেজ থেকে বি.কম পাস করেছেন।শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৫৮ সালে শওকত আলী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমিশন পদে যোগদান করেন। সশস্ত্র বাহিনীতে যোগদান সত্ত্বে ও পাকিস্তানী স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক বৈষম্য তাঁর বিবেককে নাড়া দেয়। পাকিস্তানের করাচীতে চাকুরীতে থাকাকালীন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লে: কমান্ডারমোয়াজ্জেম সহ সশস্ত্র বাহিনীর কিছু বাঙালীর সাথে তাঁর গোপন যোগাযোগ হয়। যাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত বাঙালী দেশ-প্রেমিক অফিসার ও সৈনিকদের সুসংগঠিত করে আকষ্মিক হামলার মাধ্যমে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে আত্মসর্ম্পনে বাধ্য করে বাংলাদেশের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা আদায় করা। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এ ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তৎকালীন ক্যাপ্টেন শওকত আলী ১৯৬৯ এর ১০ই জানুয়ারি করাচীর বালির ক্যান্টনমেন্ট থেকে গ্রেফতার হন এবং তাকে নজরবন্দী করে রাওয়ালপিন্ডী সামরিক বন্দীশালায় আটক রাখার পর ১ মাস পর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অন্যান্য বন্দীদের সাথে আটক রাখা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১নং আসামী করে শওকত আলীসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয়।যে মামলার প্রকৃত নাম ছিল “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য”। পাকিস্তানের লৌহমানব হিসেবে খ্যাত তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের শাসনামলে এমন দুঃসাহসিক ও দেশাত্ববোধক তৎপরতা প্রকৃত দেশ প্রেমিকদের পক্ষেই সম্ভব ছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তৎকালীন যুবনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এ দুঃসাহসী পরিকল্পনা আমাদেরকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ উদ্দীপনা জুগিয়েছিল। আইয়ুব বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারে ১৯৬৯ সালে বাঙ্গালী ঐক্যবদ্ধ হয়, রাজপথ স্লোগানে প্রকম্পিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ রাজবন্দীদের মুক্তির দাবীতে জনগণ রাজপথে স্লোগান দেয়- “জেলের তালা ভাংগবো, শেখ মুজিবকে আনব”। ১৯৬৯ এর ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে অন্যান্যের মধ্যে মুক্তি লাভ করেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন শাওকত আলীসহ তথাকথিত আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলার সকল আসামী। কর্ণেল অব: শওকত আলী তার লেখা “সত্য মামলা আগারতলা” পুস্তকে কতিপয় দেশপ্রেমিক কর্তৃক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার মহৎ উদ্যোগের কথা প্রকাশ করেছেন।কারাগার থেকে মুক্তির পর ক্যাপ্টেন শওকত আলী ১৯৬৯ সনের জুন মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হতে চাকুরীচ্যুত হন। এরপর ১৯৬৯ সালের আগস্ট মাসে যশোরের নোয়াপাড়ার কার্পেটিং জুট মিলে ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন। সেখানে থাকাকালীন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে ২৭ মার্চ মাদারীপুর-নড়িয়া ও চাঁদপুর হয়ে এপ্রিলের মাঝামাঝি ভারতের ত্রিপুরায় ২নং সেক্টর প্রধান মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে যোগাযোগ করে সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব নিয়ে মে মাসের মাঝামাঝি মাদারীপুর এসে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অস্ত্র বিতরণ করে তাদেরকে সকল থানার দায়িত্ব প্রদান করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। স্বাধীনতা লাভের পর শওকত আলী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশের নবগঠিত সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি তাঁর যোগ্যতার বলে অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীর পরিচালকের দায়িত্ব লাভ করেন। ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের পর তিনি ভীষণ ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন। প্রতিরোধ গড়ে তুলে হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করার প্রতিজ্ঞা নেয়া সত্ত্বেও প্রতিকুল পরিবেশে তিনি বিরত থাকতে বাধ্য হন। যেহেতু তিনি জাতির জনকের মতাদার্শিক সৈনিক ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে তথাকথিত আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী ছিলেন, সেহেতু খুনী মোস্তাক নিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনী থেকে ৭৫-এর ২৩ অক্টোবর তিনি চাকুরীচ্যুত হন। ছাত্রজীবন থেকে শওকত আলী প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার ধারক ও বাহক ছিলেন।তিনি ছাত্রলীগের কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। স্বাভাবিক কারণে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন থেকে কর্ণেল অব: শওকত আলী বিচ্যুত হননি। জিয়ার সামরিক শাসনামলে পি.পি.আর-এর আওতায় ঘরোয়া রাজনীতি শুরু হলে তিনি ১৯৭৭-এ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগে যোগদান করেন। শওকত আলী ও তাঁর সহধর্মীনি মাজেদা শওকত আলী ৭৫উত্তর প্রতিকূল পরিবেশে দলীয় বহুকর্মী, সমর্থক ও এলাকার মানুষকে নিজেদের অভাব অনটন সত্ত্বে ও বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান যখন বক্তব্য দেন “জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক, শেখ মুজিব জাতীয় বেঈমান” তখন বক্তব্যের প্রতিবাদে ১৯৭৮ সনের ২৬ আগস্ট কর্ণেল (অব:) শওকত আলীর নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ (ঋৎববফড়স ঋরমযঃবৎং ংড়ষরফধৎরঃু পড়ঁহপরষ)। ১৯৭৮-এ টিএসসিতে জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরীর সভাপতিত্বে ভিয়েতনামের ছাত্র-যুব প্রতিনিধি দলের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি কর্ণেল (অব:) শওকত আলী ১৯৭৯ এর নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের আমলে চরম প্রতিকূলতার মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী এলাকা নড়িয়া (শরিয়তপুর) থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন (আওয়ামীলীগ থেকে মাত্র ৩৯জন)। এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখে বরাবর তিনি নিবেদিত ছিলেন। ফলে প্রতিটি নির্বাচনে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন (শুধু এরশাদের আমল ব্যতিত)। এরশাদের আমলে মিথ্যা হত্যা মামলায় তাকে ১৬ মাস কারাভোগ করতে হয়েছে। নবম জাতীয় সংসদে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর কর্ণেল (অব:) শওকত আলী ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হন। তখন বর্তমান রাষ্ট্রপতি এ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ স্পীকার পদে বহাল ছিলেন। এ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর এবং ভারপ্রাপ্ত স্পীকার শওকত আলী কর্তৃক তাঁর শপথ গ্রহণ হয়।দীর্ঘ প্রায় তিন বছর যাবত তিনি অসুস্থ্য জীবন যাপন করেন। তিনি স্মরণশক্তি অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন। কর্নেল অব শওকত আলী শরীয়তপুর-২ আসন থেকে ৬ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।