কখনো আকাশপথে, কখনো দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বিপৎসংকুল যাত্রা। আবার কখনো নৌকায় চড়ে উত্তাল সাগর পাড়ি দেয়ার প্রয়াস। এডগার রাইস বারোসের ফিকশনের নায়ক টারজানের রোমাঞ্চকর জঙ্গুলে জীবনের চেয়েও অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও রোমহর্ষক এ যাত্রা। তার পরও বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ-আমেরিকার এ বিপৎসংকুল পথের যাত্রীদের অভিহিত করা হয় ‘টারজান ভিসার যাত্রী’ হিসেবে। দালালের প্ররোচনা-প্রতারণার ফাঁদে পা বাড়িয়ে আজো উন্নততর জীবনের আশায় ইউরোপ-আমেরিকায় ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসনের পথে পা বাড়াচ্ছেন হাজার হাজার বাংলাদেশী।
ডাইভারসিটি ভিসার (ডিভি) আওতায় ১৯৯০ সালের দিকে বাংলাদেশ থেকে আধাপ্রশিক্ষিত লোক নেয়া শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। পরবর্তী সময়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীর চাপ বাড়ায় ২০১৩ সালে ওই প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। এর পরও থেমে থাকেনি অসংখ্য তরুণের ‘আমেরিকান ড্রিম’ পূরণের প্রাণান্তকর প্রয়াস। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, উন্নত ও তুলনামূলক উদার সমাজের কারণে তরুণদের এখন ইউরোপের দেশগুলোর প্রতিও মোহ কম নয়। এ মোহকে কাজে লাগিয়ে তাদের অবৈধভাবে অভিবাসনের পথে টেনে নিচ্ছে মানব পাচারকারী ও দালালরা। ‘বৈধ চেষ্টায় লাভ নেই’Íদালালদের এমন প্ররোচনায় ধোঁকা খেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বিপৎসংকুল পথে পা বাড়ায় বাংলাদেশের অভিবাসনপ্রত্যাশী টারজানরা। আমেরিকা বা ইউরোপ মহাদেশের কোনো উন্নত দেশে চাকরি দেয়ার নাম করে অভিবাসনপ্রত্যাশী তরুণদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে মানব পাচারকারীরা। এজন্য শুরুতে আকাশপথে ভিসা পাওয়া সহজ এমন কোনো দেশে বৈধভাবে আকাশপথে নিয়ে যাওয়া হয় তরুণদের। মানব পাচারের ট্রানজিট এসব দেশ থেকে শুরু হয় ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা। যে যাত্রায় ডিঙ্গোতে হয় দুর্গম পাহাড় বা কয়েকশ মাইল জঙ্গল। ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সাগর পাড়ি দিতে হয় অনিরাপদ নৌযানে করে। কিন্তু অনেকের ভাগ্যেই গন্তব্যে পৌঁছা আর হয়ে ওঠে না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইউরোপের পথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ডুবে মারা যাওয়ার খবর আন্তর্জাতিক অভিবাসন-সংশ্লিষ্টদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। তবে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসনের পথটি আরো ঝুঁকিপূর্ণ। এ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে এখন পর্যন্ত কতজনের মৃত্যু হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তার পরও যারা যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত পৌঁছতে পারে, শেষ রক্ষা হয় না তাদেরও। ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আটক করে মার্কিন ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। বেশ কিছুদিন যন্ত্রণাদায়ক জেলজীবন পার করার পর তাদের ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশে।
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ থেকে অবৈধপথে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া কয়েকজন তরুণকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায় মার্কিন কর্তৃপক্ষ। ওই তরুণরা সেখানকার কারাগারে আটক থাকা অবস্থায় তাদের নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে এলএ টাইমস। প্রতিবেদনে বাংলাদেশী টারজান ভিসার যাত্রীদের অবর্ণনীয় যন্ত্রণাদায়ক যাত্রার বিশদ বিবরণ দেয়া হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধপথে যাওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ঢাকা থেকে প্রথমে উড়োজাহাজে করে নিয়ে যাওয়া দুবাই, দোহা অথবা আফ্রিকার কোনো দেশে। সেখান থেকে সরাসরি ব্রাজিল। যন্ত্রণাদায়ক যাত্রার শুরু হয় সেখান থেকেই। কিছু দূর সড়কপথে গিয়ে গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পাড়ি দিতে হয় একের পর এক দেশের সীমান্ত। পথে বিপদ বলতে শুধু জঙ্গলের বৈরী আবহাওয়া বা বুনো জন্তু-জানোয়ার নয়, এড়াতে হয় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সীমান্তরক্ষী, মাদক পাচারকারী বা অপহরণকারী গোষ্ঠীর সদস্যদের চোখও। জঙ্গল ও পাহাড়-পর্বতের মধ্য দিয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পাড়ি দিতে হয় ব্রাজিল, বলিভিয়া, পেরু, একুয়েডর, কলম্বিয়া, পানামা, কোস্টারিকা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস ও গুয়াতেমালার সীমান্ত। সবশেষে মেক্সিকো পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে। অর্ধাহার-অনাহার বা মানব পাচারকারীদের নির্যাতনে এ দীর্ঘ যাত্রাপথে অনেকের মৃত্যুও হয়। যারা বেঁচে থাকে তাদের অভিজ্ঞতাও মৃত্যুর চেয়ে কম ভীতিকর নয়।
এত কিছুর পরও স্বপ্নভঙ্গ ঘটে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে এসে। মার্কিন সীমান্তরক্ষী ও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের নজর এড়িয়ে এ সীমান্ত পার হওয়া প্রায় অসম্ভব। যদি কেউ কোনোভাবে পার হতে সক্ষম হয়, কিছুদিনের মধ্যেই ধরা পড়তে হয় তাকে। এরপর কপালে জোটে কষ্টকর কারাভোগ ও সবশেষে শূন্য হাতে দেশে প্রত্যাবর্তন, যার জন্য কাউকে কাউকে হয়তো ভিটেমাটিও বিক্রি করতে হয়েছে।
অনেকটা একই ঘটনা ঘটে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ক্ষেত্রেও। দালাল ও মানব পাচারকারীদের প্রলোভনে এখন প্রচুর বাংলাদেশী ভূমধ্যসাগরের বিপৎসংকুল পথ পাড়ি দিচ্ছেন। ইউরোপযাত্রায় এ পথই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে, এ পথ ধরে ইতালির পথে যাত্রা করা প্রতি ৫০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীর মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় উপকূলরক্ষীদের হাতে আটকও হচ্ছে অনেক। এর পরও থেমে নেই অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ঢল।
টারজান ভিসায় ইউরোপ প্রবেশের জন্য ফ্রি ভিসা নিয়ে দুবাই বা দোহায় ট্রানজিট দিয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের শুরুতেই নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়ায়। কেউ কেউ কাতার হয়ে দালালের মাধ্যমে তুরস্কে যায়। সম্প্রতি কোনো কোনো চক্র বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া পৌঁছতে ভিন্ন রুট ব্যবহার করছে বলে জানা গিয়েছে। সেক্ষেত্রে মানব পাচারকারীরা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কলকাতা, মুম্বাই, দুবাই, মিসর, বেনগাজি হয়ে ত্রিপোলিতে নিয়ে যায় বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে উঠে এসেছে। আবার সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় দক্ষিণ সুদানের মরুভূমি পাড়ি দিয়েও লিবিয়ায় নিয়ে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। সেখান থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ঝুঁকিপূর্ণ নৌকায় গাদাগাদি করে নিয়ে যাওয়া হয় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের পথে। যদিও অনেকেরই জন্য ইউরোপ শেষ পর্যন্ত অধরাই থেকে যায়।
এ অভিবাসন পদ্ধতিটিকে বডি কন্ট্রাক্ট পদ্ধতি হিসেবেও অভিহিত করে মানব পাচারকারীরা। এক্ষেত্রে পাচারকারীরা অভিবাসনপ্রত্যাশীকে বোঝায়, ইউরোপ যেতে আগ্রহী বাংলাদেশীদের শুধু দেহটি থাকলেই যথেষ্ট। প্রয়োজনীয় নথি থেকে শুরু করে বাকি সব ব্যবস্থা করে দেবে দালাল চক্র। আর এর সবই হবে টারজান ভিসায়।
জানা গিয়েছে, ঢাকা থেকে লিবিয়া হয়ে ইউরোপ যেতে স্বেচ্ছায় মানব পাচারের শিকার একেক বাংলাদেশীকে হাতবদল হতে হয় কমপক্ষে পাঁচবার। এ পথগুলো দিয়ে শুধু লিবিয়া পৌঁছতেই জনপ্রতি খরচ হয় ৫-৯ লাখ টাকা করে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সব স্থানে অর্থ পরিশোধ করা না হলে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মুক্তিপণ ও অপহরণের মতো ঘটনাও ঘটে। আবার কখনো কখনো মানব পাচারকারী চক্রের হাতে নির্দয়-নিষ্ঠুর পরিণতি বরণ করে নিতে হয় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের। এখন পর্যন্ত অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হলেও মানব পাচারকারী চক্রগুলো ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, মূল চক্রগুলো লিবিয়া, দুবাই বা তুরস্কে বসে মানব পাচার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কারণে তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ২০ লাখেরও বেশি মানুষ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছে। তাদের মধ্যে বাংলাদেশী রয়েছেন ১৯ হাজারেরও বেশি। যেসব দেশের নাগরিকদের মধ্যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে অনুপ্রবেশের প্রবণতা দেখা যায়, সেসব দেশের তালিকায় শীর্ষ দশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ, অবৈধ ও বিপৎসংকুল এ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে এখন পর্যন্ত অনেক বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের ৯ মে তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকাডুবিতে মৃত্যু হয় ৩৭ বাংলাদেশীর। ইউরোপে অভিবাসনের আশায় অবৈধপথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছিলেন তারা। আর্থিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনের লোভ দেখিয়ে তাদের সবাইকেই বিপৎসংকুল এ পথে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মানব পাচারকারীরা। এজন্য ঋণ ও ভিটেমাটি বিক্রি করে পাওয়া টাকা মানব পাচারকারী ও দালালদের হাতে তুলে দিতে হয়েছে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের।
বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত নানা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সমুদ্রপথে ইতালি হয়ে ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বেশির ভাগই বাংলাদেশ ও নাইজেরিয়ার নাগরিক। অবৈধ মানব পাচার ঠেকাতে বর্তমানে পথটি বন্ধ করে দিয়েছে ইইউ। ফলে এ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে এখন অনেকে আটকও হচ্ছে। ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্যমতে, সাগরপথে ইউরোপে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাতে গিয়ে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) আটক হয়েছেন ৬৩৯ বাংলাদেশী।
এ বিষয়ে ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, যারা এভাবে ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা যাওয়ার চেষ্টা করে, বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতারিত হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে ফিরে আসা সেসব মানুষের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, এর জন্য মধ্যস্বত্বভোগী দালালরাই দায়ী। কারণ অবৈধপথে বিদেশে যাওয়ার ঝুঁকিগুলো তারা গোপন রাখে। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের শুধু সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নই দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে গিয়ে তারা দেখে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি বলেন, আমাদের দেশের অভিবাসন প্রক্রিয়া পুরোটাই দালালনির্ভর। বিদেশে যাওয়া কর্মীদের বেশির ভাগই রিক্রুটিং এজেন্সির নাম-পরিচয় সম্পর্কে অবগত থাকেন না। ফলে সহজেই প্রতারিত হন। সরকারকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, অভিবাসন প্রক্রিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগী রাখা হবে কিনা। যদি রাখা হয়, তবে অবশ্যই তাদের নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। -বণিকবার্তা