রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫৭ পূর্বাহ্ন

আলুর কেজি ১৬০ টাকা হওয়ার নেপথ্যে

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২০

নিজের ও বর্গা মিলিয়ে মোট সাত একর জমিতে আলু চাষ করেছেন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের কৃষক তোফাজ্জল হোসেন। ফলন ভালো হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। মাঠ থেকে পরিপক্ক আলু তুলতে আরও কিছুটা সময় প্রয়োজন। কিন্তু সেই সময় দিতে রাজি নন মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিনই এসব ব্যবসায়ীরা এসে মাঠের আলু এখনই তুলে ফেলতে তাগাদা দেন তোফাজ্জল হোসেনকে। ভালো দাম দেওয়ারও টোপ দেন তারা। তাদের প্রলোভনে পড়ে অনেকটাই অপরিপক্ক আলু মাঠ থেকে তুলে ওইসব ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি করেছেন তোফাজ্জল। অবিশাস্য হলেও সত্যি, রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে সেই নতুন আলু ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ১৬০ টাকা কেজি দরে। এসব মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরাই আলুসহ বিভিন্ন প্রকার নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে অস্থির করছেন বাজার। মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় মধ্যস্বত্তভোগীদের প্রলোভনে পড়ে কৃষকরা বিক্রি করছেন অপরিপক্ক আলু। আর এই মধ্যস্বত্তভোগীরাই সেই আলু রাজধানীতে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে। যা খুচরা ব্যবসায়ীরা ১৩০ টাকা কেজি দরে কিনে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে।
এ বছর ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট বাণিজ্যের সর্বশেষ সংযোজন পণ্য হচ্ছে আলু। এ বছর আলুর দাম বৃদ্ধির কোনও কারণ খুঁজে পায়নি কেউই। তার পরও দেশের মানুষ অসহায় এই সিন্ডিকেটের কাছে।
কারা এই মধ্যস্বত্তভোগী? রাজধানীর কাওরানবাজারের আব্দুল লতিফ। প্রায় সারাদিনই কিচেন মার্কেট এলাকায় ঘোরাঘুরি করেন তিনি। রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত আব্দুল লতিফ ‘নেতা লতিফ’ নামেই পরিচিত। বিভিন্ন দোকানে-আড়তে গল্পগুজব করেই অলস সময় পার করেন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনিও একজন মধ্যস্বত্তভোগী। এই মৌসুমে আলু কেনার জন্য মুন্সীগঞ্জে ও বগুড়ায় তার লোকজন রয়েছে। পেঁয়াজের সময় তার লোকজন চলে যায় ফরিদপুর ও পাবনায়। তারাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পণ্য সম্পর্কে খোজখবর দেন। তারাই ওইসব পণ্য মাঠ থেকে কিনে রাজধানীতে পাঠান। বিনিময়ে কিছু কমিশন দেন তাদের। যা তিনি এখানে বসেই পাইকারদের কাছে নিজের মতো নির্ধারিত দামে বিক্রি করেন। এ বছর আলু ও পেঁয়াজের ব্যবসা করে ভালো মুনাফা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি নিজেই। শুধু আব্দুল লতিফই নন, কাওরানবাজারে এমন ছয় থেকে সাত জন মধ্যস্বত্তভোগী রয়েছেন যারা নির্ধারণ করে দেন, তাদের আনা পণ্য আলু বা পেঁয়াজ কতো দরে বিক্রি হবে। তারা যে দামে পণ্য আড়তে দেন, সে হারেই বাড়তে বাড়তে অত্যাচারের পর্যায়ে চলে যায় দাম। এভাবেই কৃষকের কাছ থেকে ৬০ টাকার নতুন আলু ১৬০ টাকায় কিনছেন ভোক্তারা।
জানতে চাইলে আব্দুল লতিফ বলেন, ‘অনেক টাকা খাটাই। লোকজন কাজ করে। কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের লাগানো ফসল আগেভাগে তোলার জন্য পিড়াপিড়ি করি। কৃষকদেরও ভালো দাম দেই। এখন পুরান আলুর কেজি ৫০ টাকা। সেই হিসেবে নতুন আলু ১৬০ টাকা হলে মন্দ কিস্তে কৃষকও লাভবান হলো, তাদের কল্যাণে আমরাও কিছুটা মুনাফা পেলাম। আর ক্রেতারা স্বাদ নিলো নতুন আলুর।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাঠেঘাটে যাওয়া লাগে না। খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য এই যন্ত্রটাই (হাতে থাকা মোবাইল ফোন দেখিয়ে) যথেষ্ট। আমার লোকজন পণ্যের ছবি তুলে পাঠায়। দেখে পছন্দ হলে সরাসরি কৃষকের সঙ্গে কথা বলে দাম ঠিক করি। তার পরে ট্রাকে মালামাল চলে আসে কাওরানবাজারে। সময় মতো নির্ধারিত আড়তে ট্রাক থেকে মাল খালাস হয়। টাকা পেয়ে যাই বাংকের মাধ্যমে। সমস্যা কী?’ রাজধানীর কোনাপাড়া বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী কাওছার মিয়া বলেন, ‘শীত পড়তে শুরু করেছে মাত্র। নতুর আলুর সিজন শুরু হয়নি। তবে এ বছর সিজনের আগেই বাজারে নতুন আলু আসতে শুরু করেছে। সামর্থবান ক্রেতাদেরও আগ্রহ রয়েছে নতুন আলুর প্রতি। তাই বিক্রির জন্য আনি। বিক্রিও হয়ে যায়। পুরান আলুর কেজি ৫০ টাকা। সেখানে নতুন আলু বিক্রি করি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা দরে। গতবছরও নতুন আলু ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। সে সময়ে পুরান আলুর কেজি ছিল ৩০ টাকা। এ বছর ৫০ টাকা। পুরান আলুর দাম এবছর বেশি বলেই নতুন আলুর দামও স্বাভাবিক নিয়মে বেড়েছে। এছাড়া অন্যান্য বছর ডিসেম্বরের শেষ দিকে নতুন আলু বাজারে এলেও এ বছর নভেম্বরেই চলে এসেছে। ফলে দাম কিছুটা বেশি।‘ কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সব খরচ মিলিয়ে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ১৮ টাকা ৯৯ পয়সা। বছরে দেশে আলুর চাহিদা কমবেশি ৭৫ লাখ থেকে ৮০ লাখ মেট্রিক টন। গত বছর দেশে প্রায় এক কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মাঠে আলু চাষ করেন প্রায় সাড়ে সাত লাখ চাষি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আলুর উৎপাদন হয় এক কোটি আট লাখ টনেরও বেশি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, ‘কোনও সংকট নাই দেশের আলুর বাজারে। সরবরাহেও কোনও জটিলতা তৈরি হয়নি। তারপরেও এই কৃষিপণ্যটির দাম অস্বাভাবি হারে বেড়েছে। এক কেজি আলুতে ২০ টাকা থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত মুনাফা করেছে এই সব অসৎ ব্যবসায়ীরা। বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি এবং নানা কারসাজির কারণে দাম নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন একটা কাজ। এ বছর আলুর বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিয়েছে ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকরা। এখনও প্রান্তিক কৃষকের হাতে আলু এসে পৌছায়নি। আলুর দামের কারণে বাজারে অন্য সবজির দামও চড়া। এ কারণে নিম্নআয়ের মানুষদের কিছুটা কষ্ট হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন জানিয়েছেন, ‘নতুন আলু উঠতে শুরু করেছে। কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন পুরান সব ধরনের আলুর দামই কমে আসবে। এর সঙ্গে অন্যান্য সবজির দামও কমতে শুরু করবে। বাজারে আলুর অসম দামের বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন। এজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে।’




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com