রাজশাহীর হিমাগারগুলোতে আলু সংরক্ষণের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন কৃষকেরা। আজ রোববার বেলা ১১টার দিকে রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলা পরিষদ চত্বরে এই বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। এর আগে তাঁরা রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কে মোহনপুর উপজেলা সদর এলাকায় আলু ফেলে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। অনেকে শুয়ে পড়েন মহাসড়কে।
ক্ষুব্ধ কৃষকেরা জানান, প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণের জন্য আগে হিমাগারগুলোকে চার টাকা ভাড়া দিতে হতো। এবার তা বৃদ্ধি করে আট টাকা করা হয়েছে। ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই তাঁরা দ্রুত আগের ভাড়া নির্ধারণের দাবি জানান। তিন দিনের মধ্যে এই দাবি না মানা হলে কঠোর আন্দোলনের পাশাপাশি মহাসড়ক অবরোধের হুমকি দেন কৃষকেরা। তাঁদের এই কর্মসূচির সঙ্গে স্থানীয় জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির নেতাকর্মীরা একাত্মতা ঘোষণা করেন।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মোহনপুর উপজেলা জামায়াতের আমির জি এম আব্দুল আউয়াল, প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি শামিমুল ইসলাম এবং প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেন সাধারণ সম্পাদক মাহবুবার রশিদ, বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন তানোর পৌরসভার সাবেক মেয়র বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান।
শামিমুল ইসলাম বলেন, মাত্র কয়েক দিন আগে দেশ দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন হয়েছে, এরই মধ্যে কৃষকদের রাস্তায় নামতে হয়েছে, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। প্রশাসন মাত্র কয়েকজন কোল্ডস্টোরেজের মালিকের পক্ষে অবস্থান নিয়ে চুপ করে আছে। কয়েকটি কোল্ডস্টোরেজ আগে না সারা দেশের কৃষক আগে। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে; কিন্তু এখনো মনে হচ্ছে তাদের দোসররা প্রশাসনে রয়ে গেছে। তারাই কোল্ডস্টোরেজের মালিকের স্বার্থ সংরক্ষণ করছে। কৃষকদের দাবি খুব সামান্য দাবি। এটা তো সবার কথা, কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে।
শামিমুল বলেন, ‘আজকে আমরা এই সমাবেশ থেকে উপদেষ্টাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যে আমরা রাজশাহী থেকে এত পরিমাণ আলু দেব, আপনারা ভারতে রপ্তানি করুন। দাবি মানার জন্য আপনারা ৭২ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন। আমি বলব, এই সামান্য দাবি মানার জন্য ৭২ ঘণ্টার প্রয়োজন পড়ে না, শুধু আগের ভাড়া কার্যকর করলেই মিটে যায়। আমি আজকে প্রশাসনের মাধ্যমে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই দাবি মানার অনুরোধ জানাচ্ছি।’
সমাবেশে মোহনপুরসহ তানোর ও পবা উপজেলার সহস্রাধিক কৃষক অংশ নেন। মোহনপুরের আলুচাষি লুৎফর রহমান হিমাগারমালিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা কৃষক প্রয়োজনে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেব, তবু আপনাদের অন্যায় দাবি মেনে নেব না। কোনো বিশৃঙ্খলা হলে এর দায়দায়িত্ব আপনাদের বহন করতে হবে। আপনারা মনে করবেন না যে আপনারা টাকা দিয়ে একটি পক্ষকে কিনে নেবেন আর এর বলির শিকার হবে এ দেশের ৮০ ভাগ গরিব কৃষক। আপনাদের টাকা আপনাদের অ্যাকাউন্টে রাখুন। ওই টাকার দিকে আমাদের নজর নাই, কিন্তু আপনারা কেন কোটিপতি হয়ে এই গরিব চাষির কষ্টের টাকার দিকে ভিক্ষুকের মতো হাত বাড়াচ্ছেন, এর জবাব আপনাদের দিতে হবে ইনশা আল্লাহ।’
আলুচাষি ইমরান আলী বলেন, ‘আমরা এত দিন হিমাগারে ৯০ থেকে ৯৫ কেজি পর্যন্ত এক বস্তায় আলু রেখেছি। আমাদের কাছ থেকে যারা ৩৪০ টাকা করে নিয়েছে, তাদের নির্দেশক্রমেই আমরা আবার এক বস্তায় ৭০ কেজি আলু রাখি। আমরা ভাড়া দিই ৩৪০ টাকা বস্তা হিসেবে। সেখান থেকে আবার যে যে রকম আলু রাখি, সেই পরিমাণ হিসেবে আমাদের কমিশন আকারে কিছু টাকা ফেরত দেয়। এর আগে পেইড বুকিংয়ের সময় আমরা ১৭০ টাকা দিতাম। তাঁদের আইন অনুযায়ী কেউ ২১০, কেউ ২২০ টাকা দিয়েছি। তারা তো তখন বলে নাই যে এবার বস্তায় ৫০ কেজি বেশি আলু রাখা যাবে না আর আলুর কেজি পড়বে ৮ টাকা করে। হঠাৎ করে ওরা বলছে যে এক বস্তায় ৫০ কেজির বেশি আলু রাখা যাবে না। আর কেজিপ্রতি আলুর ভাড়া পড়বে ৮ টাকা। তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কোনো কথা বলেনি, আমাদের চাষিদের সঙ্গে কোনো কথা বলেনি, কৃষি মন্ত্রণালয়কে জানায়নি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানায়নি। নিজেরাই হঠাৎ করে লোহার মই চাপিয়ে দেওয়ার মতো আমাদের ওপর এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে।’ এর আগে গত ২৮ ডিসেম্বর তানোর উপজেলার কৃষকেরা একই দাবিতে এলাকায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। ভাড়া বৃদ্ধির ফলে তানোরের কয়েকটি হিমাগারের সামনেও বিক্ষোভ হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে রাজশাহী কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান সেদিন বলেন, ‘গত বছর বস্তা হিসেবে হিমাগারে আলু নেওয়া হয়েছে। ৫০ কেজির বস্তায় ৩৪০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এর ফলে কেজিপ্রতি সংরক্ষণে খরচ পড়ে প্রায় সাত টাকা। কিন্তু আলুর মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা বস্তায় ৭০ থেকে ৮০ কেজি পর্যন্ত আলু ঢুকিয়ে দেন। ফলে হিমাগারমালিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে এবার আলুর কেজি দরে ভাড়া নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
ফজলুর রহমান জানান, ব্যাংকের সুদহারসহ সব খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন চলতি মৌসুমে কেজিপ্রতি ভাড়া নির্ধারণ করেছে সর্বোচ্চ আট টাকা। এরপরও কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সিদ্ধান্ত রয়েছে, এ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা এর চেয়েও কম ভাড়ায় তাঁরা নিজস্ব সিদ্ধান্তে আলু সংরক্ষণ করতে পারবেন।