টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন
চীন অর্থনৈতিক ও সামরিক দিকে শক্তিশালী এবং সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্র। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগরের সন্নিহিত অঞ্চল এবং যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে থাকা ভারতের সম্পর্কের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন। তাই ভারত যদি চীনের এই সাম্রাজ্যবাদকে মোকাবেলা করতে চায়, তাহলে দেশটিকে আগে এই নিরাপত্তা হুমকিগুলোর মুখোমুখি হতে হবে।
গত বছরের জুন মাসে গালওয়ান ভ্যালির সংঘর্ষ প্রমাণ করে চীন ক্রমশ তাদের সীমান্তে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। যদিও কোনো রাষ্ট্রই যুদ্ধ চায় না। কিন্তু কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, চীন গালওয়ানের ওপর নিজের স্বার্বভৌমত্ব দাবি করে বসে আছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর চীনের সঙ্গে ১৮ বার আলোচনায় বসেছেন। নভেম্বরের ব্রিকস সম্মেলনে একবার চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকও করেন তিনি।
তবে এতোসব আলোচনা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কোনো অর্জন নিয়ে আসেনি। কিংবা এরমধ্য দিয়ে ভারত চীনকে মোকাবেলায় কোনো কৌশল নিয়েও হাজির হতে পারেনি।
যেসব প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক রয়েছে, চীন সেসব দেশেও তার প্রভাব বিস্তার করেছে। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের মতো রাষ্ট্রের প্রধান বিনিয়োগকারী হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে বেইজিং। শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে চীন। এই দেশগুলো চীনের ওপর নির্ভর করার ঝুঁকি সম্পর্কে জানে। তবে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ভারতের পক্ষে নিজেকে একটি অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিটি রাষ্ট্রই সবার আগে নিজের স্বার্থের কথা ভাবে। তাই ভারতের উচিত, প্রতিবেশি দেশগুলোতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা এবং ভারতীয় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের রেকর্ড ভাল করা।
চীন ভারত মহাসাগরে শক্তি বৃদ্ধি করছে আর এদিকে ভারত আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো থেকে নিজেকে বিরত রাখছে। এর ফলে এশিয়ায় ভারতের প্রভাব কমছে। ভারত এখন তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে শুধু স্থলবাহিনীর পেছনে। কিন্তু ভারত মহাসাগরে চীনের চ্যালেঞ্জ কি ভারতীয় নৌবাহিনী মোকাবেলা করতে পারবে?
বিশ্বের অনেকগুলো গণতান্ত্রিক শক্তিই চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে সমর্থন করে। জার্মানি, ফ্রান্স, বৃটেন ও অস্ট্রেলিয়া ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে চাইছে। তবে এই রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে চীনকে অর্থনৈতিক কিংবা সামরিকভাবে মোকাবেলা করার ক্ষমতা নেই। শুধুমাত্র সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রই এটি করতে পারে। তাই ভারতকে অবশ্যই রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েই নিজের রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে। রাশিয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৭০ শতাংশ অস্ত্র সরবরাহ করে। ওয়াশিংটন সবসময়ই বিষয়টি মাথায় রেখেছে। রাশিয়ার অস্ত্র কেনার কারণে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হুমকিও রয়েছে ভারতের ওপরে।
কিন্তু এদিকে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক একটি দোধারী তলোয়ারের মতো কাজ করে। চীন-ভারত দ্বন্দ্বে রাশিয়া ভারতের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রকে বৈশ্বিক পরিসরে মোকাবেলা করতে দেশটির চীনকে দরকার। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ধারণাকে সমর্থন করে ভারত, তবে রাশিয়া এর ঘোর বিরোধী। আবার রাশিয়া যদি চীনের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনা নিয়ে চুপও থাকে তাহলেও তা ভারতের স্বার্থের বিপরীতে কাজ করে। রাশিয়া নিজেও তার মিত্র চীনের মতো সম্প্রসারণবাদী। কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ায় জাতীয়তাবাদের উত্থান হয়েছে। ২০০৮ সালে জর্জিয়া ও ২০১৪ সালে ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। তাদের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নিয়েছে। এসব ঘটনায় ভারত চুপ করে ছিল।
রাশিয়া ও চীন যৌথভাবে অস্ত্র উৎপাদন করে। ইতিহাসের যে কোনো সময়ের থেকে দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্ক এখন সবথেকে ভাল অবস্থানে রয়েছে। বাণিজ্যেও একই অবস্থা দেখা যায়। রাশিয়ার রপ্তানির ১৪ শতাংশই যায় চীনে। অপরদিকে ভারতে যায় মাত্র ১.৭ শতাংশ। আবার চীনের রপ্তানির ২২ শতাংশ যায় রাশিয়ায়, যেখানে ভারতে মাত্র ১.৬ শতাংশ। তাই রাশিয়ার অস্ত্র কেনার কারণে দেশটির প্রতিরক্ষা শিল্প লাভবান হয় বটে তবে বৈশ্বিক পরিসরে তাদের ভারত নির্ভরতা নেই।
২০১৬ সালে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে হওয়া সমঝোতা চুক্তি এরইমধ্যে কাজ করতে শুরু করেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের এন্টি-সাবমেরিন পেট্রোল বিমান পি-৮ পোসেইডনকে আন্দামান-নিকোবরে রিফুয়েলিং করতে দেয় ভারত। একইসঙ্গে দুই দেশ বেশ কিছু প্রতিরক্ষা চুক্তির বিষয়েও একমত হয়েছে। এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে মিত্রতা স্থাপন না করেও যুক্তরাষ্ট্র চাইলে ভারতের গোয়েন্দা বিভাগকে শক্তিশালী করতে কাজ করতে পারে। একইসঙ্গে ভারতের সঙ্গে আরো বেশি বেশি সামরিক মহড়া করে দেশটির নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে। সবার শেষে বলতে হয়, চীনকে মোকাবেলায় ভারতকে অবশ্যই অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে হবে। আর জন্য প্রয়োজন সুশাসন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। ( লেখক: অনিতা ইন্দর সিং,অনিতা ইন্দর সিং নয়া দিল্লির সেন্টার ফর পিস এন্ড কনফ্লিক্ট রেজোলিউশনের প্রফেসর)