রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫৯ অপরাহ্ন

হকের পথে বাধা এলে মুমিনের করণীয়

মাওলানা মাহাথির মোবারক
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

হাদিস শরিফে রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘দুনিয়াটা মুমিনের জন্য জেলখানা আর কাফেরদের জন্য জান্নাতস্বরূপ। মুমিনের দুনিয়াবি জীবন সুখের নয়। বরং তা অতি কষ্টের। তার সামনে থাকে শত বাধার দুর্ভেদ্য প্রাচীর। তা জয় করে তাকে জান্নাতের পথে এগিয়ে যেতে হয়, বাঁচার চেষ্টা করতে হয় জাহান্নাম থেকে। তাই দুনিয়াবি জীবনের শত বাধাবিঘ্নকে সে পেরিয়ে যায় হাসিমুখে। বরণ করে নেয় হাজারো নির্যাতন-নিপীড়ন। কারণ, বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে তাকে লক্ষ্যপানে পৌঁছতেই হবে। এটাই তার সতত সাধনা ও একান্ত কামনা। ফলে দুনিয়াবি কোনো বাঁধাকে সে ভয় পায় না। দুনিয়াতে মুমিন যেসব বাধার সম্মুখীন হয় এবং সে অবস্থায় তার করণীয় কী? সে বিষয়ে নিচে আলোচনা করা হলো-
মুনাফিকদের অত্যাচার : সর্বপ্রথম মুমিনের সৎকাজে বাধা দেবে মুনাফিকরা। যেমনটি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা:-এর ক্ষেত্রেও ঘটেছে। বিশ্বমানবতার দূত রাহমাতুল্লিল আলামিন বিশ্বনবী সা: যখন দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। মানুষদেরকে সৎ কাজের আদেশ দিয়েছেন এবং নিজে সৎ পথে চলেছেন ঠিক তখনই মুনাফিকদের পক্ষ থেকে হাজারো বাধা এসেছে। মুনাফিক হলো ইসলামের গোপন শত্রু। তাদের দ্বারা ইসলামের যতটুকু ক্ষতি হয়েছে অন্যান্য কাফের-মুশরিকদের থেকেও এতটুকু ক্ষতির আশা করা যায়নি। রাসূলের জামানা থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত এমন কিছু মুনাফিক মুসলমান থাকবে যারা নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবি করবে ঠিকই কিন্তু গোপনে গোপনে মুমিনদের বিপক্ষে এবং বেইমানদের পক্ষে তারা লড়াই করে ইসলামকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতে চাইবে।
কাফেরদের অত্যাচার : কুরআনে কারিমে স্পষ্ট ভাষায় আল্লাহ তায়ালা বলে দিয়েছেন, ‘ইহুদি-খ্রিষ্টানরা তোমাদের বন্ধু নয় বরং তারা তোমাদের চরম শত্রু।’ অর্থাৎ তোমাদের প্রতিটি ভালো কাজে তারা বাধা দেয়ার চেষ্টা করবে এবং তোমাদের অকল্যাণ কামনা করবে। সুতরাং কখনো তাদেরকে বন্ধু মনে করে তাদের সাথে একত্র হওয়া যাবে না। বরং তাদেরকে শত্রু জেনে তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। কারণ, তারা কখনো চাইবে না যে মোহাম্মদের দিন পৃথিবীতে বিজয়ী হোক, বরং তারা চাইবে দিন ইসলাম যেন পৃথিবী থেকে মুছে যাক এবং তোমাদেরকে সারাজীবন কষ্ট দেয়ার চেষ্টা করবে।
শয়তানের অত্যাচার : আজাজিল অর্থাৎ অভিশপ্ত শয়তান। সে আল্লাহ তায়ালার কাছে ওয়াদাবদ্ধ হয়ে এসেছে- মানুষের রগে রগে ঘোরাফেরা করবে এবং প্রত্যেকটি মানুষকে সে জাহান্নামের দরজায় পৌঁছে দেবে। আল্লাহ তায়ালার কাছে ওয়াদা করেছে, কোনো মানুষকে সে জান্নাতে যেতে দেবে না বরং প্রতিটি মানুষকেই জাহান্নামের দিকে ঠেলে দেবে। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই সে শুধু মুমিনের অকল্যাণ কামনা করবে। যেকোনো সৎ কাজের ভেতর সে বাধা দেবে। পরস্পরের মাঝে ঝগড়া ফ্যাসাদ সৃষ্টি করবে। মানুষকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দুনিয়ামুখী করে দেবে। কুরআনের এক জায়গায় বর্ণনা হয়েছে- ‘শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু’। শয়তানের কাছ থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
অহঙ্কার : অহঙ্কারের কারণে মানুষ হক গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। কল্যাণ লাভ থেকে সে বঞ্চিত হয়। আর অহঙ্কার হলে সত্যকে অবজ্ঞা করা এবং মানুষকে তুচ্ছ মনে করা। মানব চরিত্রের দুষ্টক্ষত এই অহঙ্কারের কারণে মানুষ হেদায়াতের আলো থেকে দূরে থাকে। হক পথ থেকে বিচ্যুত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘এ পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে অহঙ্কার করে আমি তাদেরকে আমার আয়াতসমূহ থেকে ফিরিয়ে রাখব। তারা আমার সব আয়াত (নিদর্শন) দেখলেও তারা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করবে না। তারা হেদায়াতের পথ দেখলেও তারা সে পথে যাবে না। কিন্তু যদি ভ্রষ্টতার পথ দেখে তাহলে তারা সেটাই গ্রহণ করবে। এটা এ কারণে যে, তারা আমার আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে এবং তারা এ থেকে উদাসীন’ (সূরা আরাফ ৭/১৪৫)। অহঙ্কার যে মানুষকে হক গ্রহণে বাধা দেয়, তার প্রথম উদাহরণ হলো ইবলিশ। তাকে যখন বলা হলো আদমকে সিজদা করো, তখন সে অহঙ্কার করল। আল্লাহ বলেন, ‘তখন ফেরেশতারা সবাই একযোগে সিজদা করল। ইবলিশ ব্যতীত। সে অহঙ্কার করল এবং কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।
হিংসা-বিদ্বেষ : হিংসা-বিদ্বেষ মানুষকে দুনিয়াতে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করে, তেমনি তার আমল নষ্ট করে দিয়ে তাকে পরকালে জাহান্নামি করে। মানুষ সাধারণত ভালোর প্রতি হিংসা করে থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তবে কি তারা লোকদের (মুসলমানদের) প্রতি এ জন্য হিংসা করে যে, আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহ থেকে তাদের কিছু দান করেছেন। আর আমরা তো ইবরাহিমের বংশধরদের কিতাব ও হিকমত দান করেছিলাম এবং তাদেরকে দান করেছিলাম বিশাল সাম্রাজ্য’ (সূরা নিসা : ৪/৫৪)।
কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ : প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষকে হক গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখে। এমনকি প্রবৃত্তির অনুসরণের ফলে অনেকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। আল্লাহ বলেন, ‘এ বিষয়ে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তাহলে তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে।
নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। এ কারণে যে, তারা বিচার দিবসকে ভুলে গেছে’ (সূরা ছোয়াদ : ৩৮/২৬)।
আল্লাহ ব্যতীত সৃষ্টিকে আঁকড়ে ধরা : আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে বাদ দিয়ে কোনো মানুষকে কিংবা পূর্বপুরুষকে আঁকড়ে ধরা বা তাদের আচার-আচরণের অনুসারী হলে হক পথ থেকে বিচ্যুত হতে হয়। কারণ মানুষের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা হিসেবে তাদেরকে আল্লাহ কল্যাণের পথ প্রদর্শন করেন তাঁর নবী-রাসূলের মাধ্যমে। সুতরাং কেউ আল্লাহকে বাদ দিয়ে কোনো সৃষ্টিকে আঁকড়ে ধরলে পথভ্রষ্ট হবে।
আত্মসম্মান ও আত্মগর্ব : আত্মসম্মান ও আত্মঅহঙ্কার হক গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তাকে বলা হয়, আল্লাহকে ভয় করো, তখন তার মর্যাদার অহঙ্কার তাকে পাপে স্ফীত করে তোলে। অতএব তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট। আর নিশ্চিতভাবেই সেটি নিকৃষ্টতম ঠিকানা’ (সূরা বাকারা : ২/২০৬)।
নিফাক বা কপটতা : নিফাক বা কপটতা এমন এক দোষ, যার কারণে মানুষের ভেতর ও বাইরে থাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাহ্যিক চাল-চলন তার সুন্দর হলেও অভ্যন্তরীণ কর্মকা- থাকে কলুষিত। এই মানসিকতা তাকে হক থেকে দূরে রাখে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদেরকে বলা হয়, এসো আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে, তখন তুমি কপট বিশ্বাসীদের দেখবে যে, তারা তোমার থেকে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নেবে’ (সূরা নিসা : ৪/৬১)।
ক্রোধ-রাগ : মানুষের ভেতরের ক্রোধ অনেক সময় তাকে হক থেকে দূরে রাখে। অন্তরের এ ব্যাধির কারণে সে হক থেকে বঞ্চিত হয়। যেমন হাদিসে এসেছে, সুলায়মান ইবনে ছুরাদ রা: থেকে বর্ণিত- একবার নবী করিম সা:-এর সম্মুখেই দুই ব্যক্তি গালাগালি করছিল। আমরাও তাঁর কাছেই উপবিষ্ট ছিলাম, তাদের একজন অপরজনকে এত রেগে গিয়ে গালি দিচ্ছিল যে, তার চেহারা রক্তিম হয়ে গিয়েছিল। তখন নবী করিম সা: বললেন, ‘আমি একটি কালিমা জানি, যদি এ লোকটি তা পড়ত, তবে তার রাগ দূর হয়ে যেত। অর্থাৎ যদি লোকটি ‘আউজুবিল্লা-হি মিনাশশাইতোয়ানির রাজিম’ পড়ত। তখন লোকেরা সে ব্যক্তিকে বলল, নবী করিম সা: কী বলেছেন, তা কি তুমি শুনছ না? সে বলল, আমি নিশ্চয়ই পাগল নই’। অর্থাৎ তার রাগ তাকে রাসূলের নির্দেশ পালন থেকে বিরত রাখল। এভাবে মানব মনের সীমাহীন ক্রোধ তাকে অন্ধ করে দেয়। ফলে তা তাকে হক থেকে বিরত রাখে।
ভীরুতা-কাপুরুষতা : আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর রিসালাত প্রচার করত ও তাঁকে ভয় করত। আল্লাহ ব্যতীত তারা অন্য কাউকে ভয় করত না। আর হিসাব গ্রহণের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট’ (আহজাব ৩৩/৩৯)। শক্তিশালী মুমিনের প্রশংসা করে রাসূল সা: বলেন, ‘শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চেয়ে উত্তম এবং আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়’। রাসূল সা: ভীরুতা-কাপুরুষতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তিনি এভাবে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে, ঋণের বোঝা ও লোকজনের প্রাধান্য থেকে আপনার কাছে পানাহ চাচ্ছি’। যারা আল্লাহকে ভয় করে তারা যেকোনো মূল্যে হক গ্রহণে তৎপর হয়। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহকে ভয় করে না, তারা হক গ্রহণ করতে পারে না।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com