শাল্লায় গৃহহীনদের বিক্ষোভ
আমি গরিব মানুষ, শেখ হাসিনা আমারে ঘর দিছে, এখন হুনি আমার ঘর কাইট্রা নিতাছে। ঘরও পাইছি, মালামালও আইছে, অকন ঘর নিলে আমি বাউ বাচ্চা নিয়া কই যাইমু। এর চাইতে আমার মরণ ভালা। আমার আগের ভাঙ্গা ঘরই ভালা আছিল, সরকারি ঘর পাইয়া আমার নিজের ছোট ঘরটা ভাঙ্গইয়া চাপটা বাইন্দা কষ্ট কইরা থাকতাছি। উক্ত কথাগুলো বলেন সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের চাকুয়া গ্রামের সুশীল দাস। তিনি আরো বলেন, আমরা মরলেই কিতা থালেই কিতা, অকন ভাবছি জীবন দিব ঘর নিতে দিমু না। একথা বলে তিনি কেঁদে ফেলেন। বুধবার বেলা ১০টা সরজমিনে গিয়ে এই দৃশ্য চোখে পারে। সারা দেশের ন্যায় প্রধানমন্ত্রীর উপহার আশ্রয়হীণদের জন্য দেয়া হাওরের তলানি এ উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে মোট ১৫৮১টি ঘর বরাদ্দ হয়েছে। কাজও শুরু হয়েছে, অনেক মালামাল ও পৌঁছে গেছে।
এসব ঘর নির্মাণে কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধির নামে দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগও উঠে। তারেই প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম সরজমিন তদন্ত করে ২৫৬টি ঘর বাতিলের সিদ্ধান্ত দেন। এই সংবাদ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে মঙ্গলবার কয়েক’শ গৃহহীন উপজেলা সদরে বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভকারীরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে ঘর না কাটার দাবি জানিয়ে বলেছে, যারা অনিয়ম করেছে, তাদের বিচার হতে পারে, গৃহহীনদের ঘর কেটে নেওয়া কোনভাবেই মানবো না আমরা। শাল্লার ৪ ইউনিয়নের জন্য ১৫৮১ ঘর বরাদ্দ হয়। এসব ঘরের মধ্যে শাল্লা ইউনিয়নের শেষ প্রান্তে ১০০ আশ্রয়হীণের জন্য নতুন গ্রাম ‘মুজিবনগর’ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। দরিদ্র উপজেলা হিসেবে কেউ যাতে আশ্রয়হীণ না থাকে সেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন জেলা প্রশাসন। কিন্তু ঘর তৈরি’র দায়িত্ব পালনকারীদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় ওই উপজেলা থেকে কিছু ঘর কেটে জেলার অন্য উপজেলায় সরিয়ে নেবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সোমবার শাল্লার গৃহহীনদের কাছে এই সংবাদ পৌঁছালে মঙ্গলবার দুপুরে কয়েক’শ গৃহহীন উপজেলা সদরে এসে উপজেলা পরিষদের সামনে বিক্ষোভ করেছে।
বিক্ষোভকারী উপজেলার চাকুয়া গ্রামের সুশীল দাস বললেন, সরকারি খাস জমিতে ভাঙাচোরা ঘরে থাকতাম। প্রধানমন্ত্রীর উপহার পেয়ে সেটি ভেঙে ফেলেছি। এখন এই ঘর কেটে নিলে খোলা আকাশের নিচেই থাকতে হবে। কর্মকর্তাদের অপরাধের জন্য আমরার ঘর কাটা হবে কেন।
এই গ্রামের হেলন রানী দাস বললেন, পুরাতন একছালার ঘর ভেঙে শেখ হাসিনার দেওয়া ঘর বানানোর কাজ শুরু করেছি। এখন ঘর কেটে নিলে আকাশ মাথায় লেগে যাবে। যারা দুর্নীতি করেছে তাদের শাস্তি হোক। আমাদের ঘর যেন বাতিল না হয়। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আল আমিন চৌধুরী বললেন, দুদিন ধরে বিভিন্ন গ্রুপে গ্রুপে মানুষ এসে প্রতিবাদ জানাচ্ছে, বিক্ষোভ করছে। বলতে গেলে ঘেরাও করে রেখেছে। এখন আমাদের মার খাওয়ার অবস্থা। নতুন মাটিতে যারা ঘর করতে চাইছে যেমন কান্দিগাঁও, শাল্লা কলেজের পাশে এসব কিছু ঘর (৫০-৬০ টির মতো হবে) কেটে নিলে আমাদেরও আপত্তি থাকবে না, কিন্তু ২৩০ টির মতো ঘর মালামাল পৌঁছেনি বলে কেটে নেবার সিদ্ধান্তে আমরা বিপদে পড়েছি।
প্রসঙ্গত, শাল্লায় প্রধানমন্ত্রীর উপহার প্রদান নিয়ে কিছু এলাকায় আর্থিক লেনদেন হয়েছে, এমন তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু গোয়েন্দা সংস্থাও এমন তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। এনিয়ে বিভিন্ন প্রত্রিকায় দুর্নীতি বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ‘ঘর পেতে শাল্লায় টাকা দিতে হচ্ছে’ এমন সংবাদ ও ছাপা হয়েছে। একারণে ক্ষুব্ধ হয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি ওখানে একাধিক কর্মকর্তাকে পাঠিয়ে তদন্ত করিয়ে ওই উপজেলার যেসব ঘর এখনো নির্মিত হয়নি সেগুলো কেটে অন্য উপজেলায় স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছেন। জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন এ প্রতিবেদককে জানান, প্রধানমন্ত্রীর উপহার আশ্রয়হীনের ঘর নিয়ে কোন অনিয়ম সহ্য করা হবে না। অনিয়মের প্রেক্ষিতে ওখানে একাধিক কর্মকর্তাকে দিয়ে তদন্ত করানো হয়েছে। আপনারাও রিপোর্ট করেছেন, আমি নিজে ওখানে যেয়ে তদন্ত করেছি, আমার মনে হয়েছে ওখানকার অনেক ঘরই বর্ষার আগে নির্মাণ করা সম্ভব নয়। এজন্য যেখানে একেবারেই মালামাল পৌঁছেনি বা সামান্য পরিমানে মালামাল পৌঁছেছে, সেগুলো কেটে অন্য উপজেলায় নিয়ে দ্রুত গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, শাল্লার আশ্রয়হীনদের মধ্যে যাদের যাতায়াত খরচের বা অন্যান্য খরচের টাকা না দিয়ে দরিদ্র মানুষদের চাপ দিয়ে খরচ করানো হচ্ছিল তাদের কাউকে কাউকে ইউপি সদস্যদের মাধ্যমে টাকা ফেরৎ দেওয়া হয়েছে। শাল্লার নারকিলা গ্রামের ৯ আশ্রয়হীন পরিবারকে ৬ হাজার টাকা করে ফেরত দিয়েছেন ইউপি সদস্য এলাছ মিয়া।
ইউপি সদস্য এলাছ মিয়া বললেন, এই টাকা উপজেলা নির্বাহী অফিসার দিয়েছেন ফেরত দেবার জন্য। ৬ হাজার টাকার মধ্যে মালামাল পরিবহনের ৪ হাজার টাকা, রডের ১ হাজার এবং নাট-বল্টুর জন্য ১ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। যারা ঘর বানিয়ে ফেলছে, বিভিন্ন স্থানে অভিযোগ করেছিল তাদেরই এই টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে।
আগে কেন এই টাকা দেওয়া হলো না, এই প্রশ্নের উত্তরে ইউপি সদস্য বললেন, আগে দিলে তো নানা সমস্যা সৃষ্টি হতো না, কেন দেওয়া হলো না আমি জবাব দিতে পারবো না। আমাকে তিনি যেভাবে আদেশ দিয়েছেন, সেভাবে আমি টাকা তুলে দিয়েছি ৯ পরিবারের কাছে। তবে উপজেলার প্রত্যেকটি উপকারভোগীর অভিযোগ তারা ঘরের মালামাল পরিবহন করতে গিয়ে নিজের ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। এবিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল মুক্তাদীর হোসেনের সঙ্গে কথা তিনি ঘরগুলো যাতে ফেরত দিতে না হয় সে লক্ষে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান। যারা ঘর পেয়েছেন তরা তো নিজের ঘর ভেঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর তৈরি করছেন। তবে ঘর ফেরতের সংবাদে তারা মঙ্গলবার সদরে বিক্ষোভ করছেন। তিনি আরো জানান, ১৫৮১টি ঘরে মালামাল ও পৌঁছে গেছে এখন কি করে ঘর তৈরি বন্ধ করা হবে সেটি কোনভাবেই সম্ভব নয়। তবে গরিব অসহায় পরিবারে মালামাল পরিবহনের টাকা ফেরত দেয়া হবে বলে তিনি জানান।