বগুড়ার গাবতলীতে শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলা। ৪০০ বছর থেকে চলে আসছে এই মেলা। স্থানীয়ভাবে এই মেলাকে অনেক নামেই ডাকা হয়। ‘জামাই মেলা,’ ‘বৌ মেলা,’ ‘পোড়াদহ মেলা,’ ‘মাছের মেলা’ ও বলেন কেউ কেউ। তবে ‘পোড়াদহ মেলা’ নামেই সবার কাছে পরিচিত।
এই মেলার সময় মেয়ে আর জামাইকে দাওয়াত করে আনা হয়। তারপর মেলা থেকে বড় বড় মাছ কিনে, সেই মাছ জামাইকে খাওয়ানো হয়। এটা এখানকার দীর্ঘদিনের প্রচলিত নিয়ম। দুই দিনের মেলার দ্বিতীয় দিনে হয় বৌ মেলা। এদিন মেলায় বিভিন্ন জিনিস কেনাকাটা করেন এলাকার বৌ আর ঝিরা।
প্রতি বছর মাঘ মাসের শেষে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই মেলা। প্রথমদিকে এই মেলা স্থানীয়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন বগুড়াসহ সারা দেশের মানুষের মধ্যে এর আবহ ছড়িয়ে পড়েছে। এ মেলার ঠিকানা হচ্ছে, পোড়াদহ বটতলা, গোলাবাড়ী, মহিষাবান, গাবতলি, বগুড়া। মেলায় আসা মাছ ক্রেতা লিটন বলেন, এটা একটা ঐতিহ্যবাহী মেলা। এখানে বড় বড় মাছ পাওয়া যায়। সেই মাছ কিনতে গাড়ি নিয়ে এসেছি সিরাজগঞ্জ থেকে। মাছ কিনে আজই আবার ফিরে যাব।
মেলার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে বড় বড় মাছ। বড় কারের বাঘার মাছ দেখতে কিনতেই মানুষের আগ্রহ বেশি। তেমনি আগ্রহী একজন তারেকুল ইসলাম। তিনি এসেছেন ঢাকার মিরপুর থেকে। পছন্দ মতো ২০ কেজির একটা বাঘার মাছ কিনেছেন ২০ হাজার টাকা দিয়ে। এবারের মেলায় সবচেয়ে বড় বাঘাইর মাছটির ওজন প্রায় ৮০ কেজি। এর মালিক মমিনুল দাম হাঁকছেন ১ লাখ টাকা। দাম উঠেছে ৭০ হাজার টাকা। আশা করছেন ৮০ হাজার টাকা বেচতে পারবেন। ইতিমধ্যে মমিনুল প্রায় ৫০ কেজি ওজনের একটি বাঘাইর মাছ বিক্রি করেছেন ৪৫ হাজার টাকায়।
মেলায় আসা আরেক মাছ বিক্রেতা গিয়াস উদ্দিন বলেন, তিনি ইতিমধ্যে প্রায় তিনশ কেজির মতো মাছ বিক্রি করেছেন। তিনি বলেন, ভালোই দাম পেয়েছি। এবার দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন মেলায় এসেছেন। তারাই বড় বড় মাছ কিনেছেন।
মেলা উপলক্ষে মেয়ে এবং জামাইকে দাওয়াত করে এনেছেন, আরানীপাড়া, মহিষাবান, গোলাবাড়ি হাট প্রভৃতি গ্রামের প্রায় সব বাসিন্দারা। মেলা থেকে, যার যার সামর্থ মতো মাছ কিনে জামাই আর মেয়ে নিয়ে খাওয়া এলাকার দীর্ঘদিনের রেওয়াজ বলে জানালেন ৭০ বছরের বৃদ্ধ তমিজ মাওলানা।
এলাকার মানুষজন ছাড়াও বড় বড় মাছ কিনতে দূর দূরান্ত থেকে অনেকেই এসেছেন এবারের মেলায়। ক্রেতাদের কথা চিন্তা করে মেলায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ছোট বড় নানা আকারের মাছ আমদানি করা হয়েছে। মাছের দাম আকার ভেদে আড় কেজি ১০০০ থেকে ১৩০০, রুই ৪৫০ থেকে ৭০০, বোয়াল ৯০০ থকে ১২০০, কাতল ৪০০ থেকে ৫০০, ব্রিগেড ৪০০ থেকে ৬৫০ আর বাঘাইর ১০০০ থেকে ১৩০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
মেলা ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন প্রজাতির বৃহদাকৃতির মাছ উঠেছে এবারের মেলায়। নদীর বড় বড় বাঘাইর, আড়, বোয়াল, কাতলা, পাঙ্গাস, সামুদ্রিক টুনাসহ নানা প্রজাতির মাছ। এছাড়াও বাঁশ, বেত ও কাঠের তৈরি সংসারের প্রয়োজনীয় উপকরণ, বিনোদনের জন্য সার্কাস, নাগরদোলা, পালাগান ইত্যাদিও রয়েছে মেলাজুড়ে। মেলার এক পাশ জুড়ে রয়েছে বাহারি সন্দেশ, মিষ্টি আর দধির সমারোহ। এসব মিষ্টির বিক্রি হচ্ছে, সাদা কালো রসগোল্লা কেজি ১৪০, পটল ২০০, মাছ ৩০০ করে বলে জানালেন ভাই ভাই মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক আব্দুল লতিফ।
তিনি বলেন, পটল আকৃতির এক একটি মিষ্টির ওজন ১ থেকে দেড় কেজি। মাছ মিষ্টি এক একটির ওজন ১ থেকে ৫ কেজি। ঐতিহ্যবাহী এই পোড়াদহ মেলা কেবল একটি মেলা নয়। অর্থনৈতিকভাবেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতি বছর এ মেলায় কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়ে আসছে। এবারের মেলাও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এবারের মেলা লক্ষ মানুষের মিলনমেলায় রূপ নিয়েছে। এর আগে এই মেলায় এতো মানুষ কখনো আসেনি বলে জানালেন, কাৎলাহার বিলের পাশের গিরিরডাঙা গ্রামের অধিবাসী সানোয়ার মিয়া। মেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে গাবতলী মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আনোয়ার হোসেন জানান, মেলায় পোশাকধারী পুলিশ ডিউটি করছেন ৫০ জন এবং সিভিলে আছেন আরও ২৫ জন পুলিশ সদস্য। মেলায় অন্য বছরের তুলনায় এবার জনসমাগম অনেক বেশি হলেও কোনো সমস্যা নেই বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য, আজ বৃহস্পতিবার মেলায় (বউ মেলা) কেবল নারীদের প্রবেশাধিকার থাকবে। পুরুষরা কাল মেলায় প্রবেশ করতে পারবে না বলেও জানান পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন।