দেখতে প্রায় জিরার মতো। নাম ক্যারাওয়ে সিড। ভারত, মিসর, ভিয়েতনামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উৎপাদন হয় মসলাজাতীয় পণ্যটি। তবে দেশের বাজারে এটি এখন জিরার সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি হচ্ছে দেদারসে। বৈধ পথে মসলা আমদানির ঘোষণা দিয়ে ক্যারাওয়ে সিড আনার কারণে জিরার বাজার দীর্ঘদিন ধরে অস্থিতিশীল। ভারত, আফগানিস্তান থেকে আমদানি হওয়া প্রকৃত জিরার মূল্যের চেয়েও বাজারে কম দামে বিক্রি হচ্ছে ক্যারাওয়ে মিশ্রিত জিরা।
দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, একশ্রেণীর আমদানিকারকদের সঙ্গে যোগসাজশে ব্যবসায়ীরা ক্যারাওয়ে জিরার সঙ্গে সিড মিশিয়ে বিক্রি করছে। দেখতে হুবহু একই রকমের হওয়ায় সাধারণ চোখে এটির পার্থক্য ধরতে পারেন না খুচরা ব্যবসায়ীরা। ফলে সাধারণ ভোক্তারা জিরা মনে করে তুলনামূলক কম দামে ক্যারাওয়ে সিড কিনছেন। ক্যারাওয়ে সিডের নিজস্ব কোনো ঘ্রাণ না থাকলেও প্রকৃত জিরার সঙ্গে মেশানোর ফলে আলাদা করা কষ্টসাধ্য। যার কারণে প্রতি এক বস্তা জিরার সঙ্গে এক বস্তা ক্যারাওয়ে সিড মিশিয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে ক্লোন জিরা। সাধারণ জিরার তুলনায় দাম কম হওয়ায় কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী নতুন এ জিরা কিনে খুচরা ও পাইকারি বাজারে বিক্রি করছেন। এতে করে দেশে জিরা আমদানি করে গত দুই বছর ধরে বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়েছেন এ খাতের প্রকৃত আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা।
কাস্টমসের তথ্যে জানা গেছে, ক্যারাওয়ে সিডের এইচএস কোড ০৯০৯৬১৯০। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে চট্টগ্রাম কাস্টমস দিয়ে ক্যারাওয়ে সিড আমদানি হয়েছে ২ হাজার ৫২১ দশমিক ২৬ টন। এ সময়ে আমদানি হওয়া ক্যারাওয়ে সিডের কেজিপ্রতি আমদানি মূল্য ৭১ টাকা। ১৫ শতাংশ শুল্কসহ সর্বমোট আমদানি মূল্য দাঁড়ায় ৮২ টাকা। আবার ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি হওয়া ৩ হাজার ৫৩৩ দশমিক ৭৪ টন ক্যারাওয়ে সিডের আমদানি মূল্য হিসেবে কেজিপ্রতি মূল্য দাঁড়ায় ৬৬ টাকা। শুল্ক হিসাব করলে কেজিপ্রতি মূল্য দাঁড়ায় ৭৬ টাকা। অথচ একই সময়ে দেশে আমদানি হওয়া জিরার শুল্কসহ আমদানি মূল্য প্রায় ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা। ফলে জিরার সঙ্গে মিশ্রণ করে পাইকারি বাজারে ক্যারাওয়ে সিড বিক্রি ও জিরার সঙ্গে মিশ্রিত করে বড় ধরনের মুনাফা করছেন একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী।
কাস্টমসের মাসভিত্তিক নিত্যপণ্য আমদানি চিত্রে দেখা গেছে, প্রতি মাসে গড়ে দেশে জিরা আমদানি হয় ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টন। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে আমদানি হওয়া ১ হাজার ৩৩৫ টন জিরার টনপ্রতি গড় মূল্য ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৮৮ দশমিক ১৭ টাকা। অর্থাৎ প্রতিকেজি জিরা আমদানি হয়েছে ১৫৭ টাকায়। এর মধ্যে ছয় ধরনের শুল্ক পরিশোধ করতে হয় প্রায় ৪৬ শতাংশ। এ হিসেবে প্রতিকেজি জিরার আমদানি মূল্য দাঁড়ায় ২৩০ টাকা। এর সঙ্গে অন্যান্য খরচ যুক্ত করলে প্রতিকেজি জিরার প্রকৃত আমদানি মূল্য হয় প্রায় ২৫০ টাকা। কিন্তু বর্তমান বাজারে প্রতিকেজি জিরা বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৪৫ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ জিরা আমদানিতে কেজিপ্রতি ১০-১৫ টাকা হারে লোকসান দিচ্ছেন আমদানিকারকরা। মূলত ক্যারাওয়ে সিড মেশানোর কারণে নকল ক্লোন জিরার দাম কম থাকায় প্রকৃত জিরা ব্যবসায়ীরা লোকসানের মধ্যে পড়েছেন বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাতুনগঞ্জের এক আমদানিকারক বলেন, ক্যারাওয়ে সিড জিরার বিকল্প হিসেবে ব্যবসায়ীদের কাছে চাহিদা বাড়ছে। এ কারণে অনৈতিক হলেও ক্রেতাদের চাহিদার চাপে ক্যারাওয়ে আমদানি করতে হচ্ছে। জিরার সঙ্গে মিশ্রিত করে বিক্রি করা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় জিরা হিসেবে বিক্রি করে অতি মুনাফায় ঝুঁকেছে খাতুনগঞ্জ, মৌলভীবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা। আমদানিকারকদের কাছ থেকে স্বাভাবিক দামে ক্রয় করলেও মিশ্রণ কিংবা জিরার বিকল্প হিসেবে বিক্রি করলে প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি মুনাফা হওয়ায় অধিকাংশ ব্যবসায়ী ক্যারাওয়ে সিড মিশ্রণে ঝুঁকছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
খাতুনগঞ্জের মসলা পণ্যের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স অসীম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী অসীম কুমার দাশ বলেন, ক্যারাওয়ে সিড বাংলাদেশে ব্যবহারযোগ্য মসলা পণ্য নয়। তবে অনেক ব্যবসায়ী জিরার সঙ্গে মিশিয়ে ক্যারাওয়ে বিক্রি করে। সবাই আমদানি না করলেও অতি মুনাফার লোভে কিছু ব্যবসায়ী ক্যারাওয়ে আমদানির সঙ্গে যুক্ত। গরম মসলার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় জিরার আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা ক্যারাওয়ের কারণে দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে পড়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো থেকে প্রশাসনিক ব্যবসা নেয়া ছাড়া এ ধরনের ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৯ মে চট্টগ্রামের চাক্তাই এলাকার মেসার্স মোল্লা অ্যান্ড কোম্পানিতে অভিযান চালিয়ে নকল জিরা হিসেবে পরিচিত ক্যারাওয়ে সিড উদ্ধার করেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আলী হাসানের নেতৃত্বাধীন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ প্রতিষ্ঠান থেকে ৩০ টন ক্যারাওয়ে সিড উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯-এর ৪১ ধারায় প্রতিষ্ঠানটিকে ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
গত কয়েক দিনে খাতুনগঞ্জের চাক্তাই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি পাইকারি মসলার দোকানেই ক্যারাওয়ে সিড মেশানো জিরা পাওয়া যাচ্ছে প্রতিকেজি ২০০ থেকে ২২০ টাকা দরে। চাক্তাইয়ের একটি মসলা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ক্যারাওয়ে সিডের একটি বস্তা পাওয়া যায়। ওই বস্তায় ক্যারাওয়ে সিড উৎপাদক দেশ লেখা রয়েছে মিসর। ২৫ কেজির প্রতিটি বস্তার উৎপাদন সাল লেখা রয়েছে ২০২০ ও মেয়াদোত্তীর্ণের সাল দেয়া রয়েছে ২০২২। আছদগঞ্জ এলাকার জাফর মার্কেটের মেসার্স রিফাত এন্টারপ্রাইজ এ ক্যারাওয়ে সিড আমদানি করেছে। যার টিন নাম্বার হচ্ছে৬৯২৫২৭৮০২০৫০ এবং বিন নাম্বার হচ্ছে ০০০৫২৪৫৪৩-০৫০৩। তবে জাফর মার্কেটের রিফাত এন্টারপ্রাইজে খোঁজ নেয়া হলে সেখানকার ম্যানেজার মো. দেলোয়ার হোসেন ক্যারাওয়ে সিড আমদানির বিষয়টি অস্বীকার করেন।
মসলা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দেশের গরম মসলার বাজারে প্রধান পণ্য জিরা। মূলত জিরা ও দারচিনি সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে থাকায় এ দুটি পণ্যই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। এছাড়াও এলাচ, লবঙ্গ, গোলমরিচ গরম মসলা হিসেবে বাংলাদেশে সর্বাধিক জনপ্রিয়। সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে থাকা জিরার চাহিদা বেশি থাকায় ভেজাল মিশিয়ে বিক্রি করে অস্বাভাবিক মুনাফা করছেন একশ্রেণীর ব্যবসায়ী। অপরদিকে দীর্ঘদিন মসলা আমদানির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা ক্যারাওয়ে সিডের কারণে জিরার ব্যবসায়ী গত কয়েক বছর ধরে বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়েছে। খাতুনগঞ্জের মেসার্স দরবার ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী নাজিম উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, একশ্রেণীর ব্যবসায়ীরা গ্রামাঞ্চলের ব্যবসায়ীদের কাছে কম দামের জিরা হিসেবে ক্যারাওয়ে সিড মেশানো জিরা বিক্রি করছে। এ কারণে অনেক ব্যবসায়ী জিরা কিনেও লোকসানের কারণে বিক্রি করতে পারছে না। রোজাকে সামনে রেখে বাজারে মজুদ বাড়ালেও দাম কমে যাওয়ায় লোকসান দেয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রশাসনের উচিত কাস্টমসের মাধ্যমে ক্যারাওয়ে সিড আমদানি বন্ধ করা। না হলে নকল জিরার কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ছাড়াও জিরা আমদানি কমে দেশের মসলা বাজারের ভারসাম্য নষ্ট হবে।-বণিকবার্তা