মিন ভু ও বিচ টি. ট্রান
এ বছরটা অসম্ভব ব্যস্ততায় কাটবে বলে ধরে নিয়েছিল ভিয়েতনাম। ২০২০ সালের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর প্রভাবশালী সংগঠন আসিয়ান-এর চেয়ারম্যান ভিয়েতনাম। এছাড়া ২০২০-২১ বর্ষের জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যও হয়েছে দেশটি। কিন্তু কভিড-১৯ মহামারির কারণে বহু সভা ও সম্মেলন স্থগিত বা বাতিল করতে হয়েছে দেশটিকে। বলা হচ্ছে, এই মহামারির কারণে ভিয়েতনামের কূটনৈতিক উচ্চাভিলাষ ভেস্তে গেছে। কিন্তু এও সত্য, হ্যানয় এখন এই মহামারী মোকাবেলায় নিজেদের সাফল্যকে কূটনৈতিক অর্জনে রুপান্তরিত করতে পারে।
মহামারীর ৪ মাস চলছে। সাড়ে ৯ কোটির দেশটিতে সেই হিসাবে সংক্রমণের হার অত্যন্ত নগন্য। ১৭ই এপ্রিল নাগাদ দেশটিতে নিশ্চিত রোগীর সংখ্যা ২৬৮ জন।
এদের মধ্যে ১৭১ জনই সেরে উঠেছেন। রোগী আছেন মাত্র ৯৭ জন। এখন পর্যন্ত একজনও মারা যায়নি। এই পরিসংখ্যান আরও গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের সঙ্গে ভিয়েতনামের দীর্ঘদিনের সীমান্ত রয়েছে। দেখা যাক, ভাইরাস মোকাবিলায় ভিয়েতনাম কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে।
দেশে প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার আগেই ভিয়েতনাম এই রোগের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ১৬ই জানুয়ারি সকল সরকারি সংস্থায় জরুরি বার্তা পাঠানো হয়। ২১শে জানুয়ারি দেশজুড়ে সকল হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এই রোগ কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়, সেই ব্যাপারে জরুরী নির্দেশিকা পাঠানো হয়।
২৩শে জানুয়ারি প্রথম রোগী শনাক্ত হয় ভিয়েতনামে। লুনার নববর্ষের ছুটি শুরু হওয়ার মাত্র দুই দিন আগে হো চি মিন শহরে ওই রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। ১৩ই জানুয়ারি উহান থেকে ২ চীনা নাগরিক ভিয়েতনামে গিয়েছিলেন। ২৩শে জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে তারা পুরো দেশে ঘুরেছেন।
এর ঠিক পরপরই ভিয়েতনাম সরকার তৎপরতা বৃদ্ধি করে। ৩০শে জানুয়ারি গঠিত হয় মহামারী প্রতিরোধে জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি। ঠিক ওই দিনই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কভিড-১৯ রোগকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জনস্বাস্থ্য জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে। ওই সময় ভিয়েতনামে রোগী শনাক্ত হয় ৬ জন। আর তখনই প্রধানমন্ত্রী গুয়েন জুয়ান ফুক একে জাতীয় মহামারি হিসেবে ঘোষণা দেন। ৯ই ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দেশজুড়ে সকল পর্যায়ের ৭০০ হাসপাতালের সঙ্গে টেলিকনফারেন্সের আয়োজন করে। এতে করে হাসপাতালগুলো সরাসরি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে তথ্য পাওয়ার সুযোগ পায়। সারাদেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের উপায় সম্বলিত তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। একই দিন জনসাধারণের জন্য এসব তথ্য সম্বলিত ওয়েবসাইট প্রকাশ করে সরকার। ততদিন পর্যন্ত একে নোভেল করোনাভাইরাস বলে ডাকা হতো। ১১ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে এই রোগের নাম কভিড-১৯ বলে আখ্যা দেয়।
আক্রমণাত্মক প্রতিরোধ কার্যক্রমের কারণে ভিয়েতনাম খুব দ্রুতই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। মাত্র ১৬ জন রোগী শনাক্ত হয়। ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ সকল রোগীই সুস্থ হয়ে ওঠে।
এরপর মোট ২২ দিন ভিয়েতনামে কোনো রোগী ধরা পড়েনি।
ভিয়েতনামের এমন সাফল্যের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) ভিয়েতনামে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকা হতে প্রত্যাহার করে।
কিন্তু ১৭ নম্বর রোগী ধরা পড়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ওই রোগী ১৫ই ফেব্রুয়ারি হ্যানয় থেকে ইংল্যান্ড, ইতালি ও ফ্রান্স ঘুরতে যান। এসে ২ মার্চ হ্যানয়ে ফিরে আসেন। তিনি কোয়ারেন্টিন প্রটোকলও অনুসরণ করেননি। এই ১৭ নম্বর রোগী ৬ই মার্চ হাসপাতালে ভর্তি হন। দুই দিন পর উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভু দুক দাম ঘোষণা করেন যে, কভিড-১৯ রোগের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় পর্যায়ের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে ভিয়েতনাম।
প্রথম পর্যায়ের মতো এবারও ভিয়েতনাম সরকার জনস্বাস্থ্যমূলক পদক্ষেপ জোরদার করে। ১০ই মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মানুষের স্বাস্থ্য অবস্থা নিরূপণ ও রোগী কার কার সংস্পর্শে এসেছেন তা বের করার জন্য বিশেষ মোবাইল অ্যাপ প্রকাশ করে। পরেরদিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে। এরপরই তৎপর হয়ে ওঠে বাকি বিশ্ব। অথচ, ভিয়েতনাম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষণার জন্য বসে থাকেনি। আগে থেকেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ তারা করে রাখে।
প্রথম পর্যায়ে ভাইরাসের উৎসস্থল চীনের ওপর নজর ছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে ভাইরাস উপদ্রুত অনেক দেশকে আমলে নেওয়া হয়। তৃতীয় পর্যায়ে যেতে সময় লাগে আরু কম। হ্যানয়ের বাখ মাই হাসপাতাল ও হো চি মিন শহরের বুদ্ধ বারে দুটি ক্লাস্টার শনাক্ত হয়। এরপর ২২ শে মার্চ বিদেশীদের প্রবেশ স্থগিত করে ভিয়েতনাম সরকার। ফেরত আসা নাগরিকদের স্বাস্থ্য শনাক্তকরণ ও ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা হয়। ২৩শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী তৃতীয় পর্যায় ঘোষণা করেন। এই পর্যায়ে কমিউনিটি সংক্রমণের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। ভিয়েতনামের অন্যতম প্রধান হাসপাতাল বাখ মাই হাসপাতাল হয়ে ওঠে করোনার অন্যতম হটবেড। সেখান থেকে ২৮শে মার্চ ১০ জন রোগী শনাক্ত হন। এরপর প্রধানমন্ত্রী জাতীয় মহামারী ঘোষণা করে, স্টিয়ারিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশজুড়ে সাময়িক লকডাউন ঘোষণা করেন। এই নির্দেশনার আওতায় জনসমাগম বাতিল করা হয়। সীমান্ত বন্ধ করা হয়। কোয়ারেন্টিন নীতিমালা বাস্তবায়ন করা হয়।
প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় ভিয়েতনামের এই সাফল্যকে স্বল্প-খরুচে মডেল হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়ার গণহারে পরীক্ষা চালানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল। কিন্তু ভিয়েতনামের ওরকম সম্পদ বা ব্যবস্থা নেই। তাই সক্রিয় কিন্তু বাছাই প্রতিরোধের দিকে নজর দেয় ভিয়েতনাম।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রাম লকডাউন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। নিখুঁতভাবে লকডাউন প্রয়োগ করতে পারায় বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়। এখন পর্যন্ত মাত্র ৫ বার বড় আকারে লকডাউন আরোপ করতে হয়েছে। কঠোরভাবে চেকপয়েন্ট নজরদারি, স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা স্থাপনায় পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করায় কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। এছাড়া লুনার নববর্ষ শুরু হওয়ায় সৌভাগ্যবশত স্কুল এমনিতেই বন্ধ ছিল। এরপরও স্কুলের ছুটির সময় আরও বৃদ্ধি করা হয়।
আক্রমণাত্মক পদক্ষেপের পাশাপাশি জাতীয়তাবাদও ভিয়েতনামের সাফল্যে ভূমিকা রেখেছে। সরকার এই ভাইরাসকে অভিন্ন বিদেশী শত্রু হিসেবে আখ্যা দেয়। এটি প্রতিরোধে জাতীয় ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। দেশটির ইতিহাস যেহেতু বিদেশী আগ্রাসনের ইতিহাস, তাই এই বয়ান খুব কাজে দেয়।
এছাড়া সরকার এই মহামারীর সময় স্বচ্ছতার সঙ্গে তথ্য প্রদান করে। ফলে সরকারের কার্যকর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। অনলাইনে ভুল তথ্যের প্রচার বন্ধে শুরুতেই অ্যাপ ও ওয়েবসাইট প্রকাশ করা হয়। গুজব বা মিথ্যা তথ্য যারা ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত মিডিয়ায় ফলাও করে ভাইরাস আক্রান্ত দেশগুলোর সংবাদ প্রকাশ করা হয়। ফলে মানুষের সচেতনতাও বৃদ্ধি পায়।
স্বচ্ছ ও সক্রিয় থাকায় সরকার মানুষের আস্থা অর্জন করে। এক গবেষণা জরিপে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ ভিয়েতনামিজ মনে করেন সরকার সঠিক মাত্রার পদক্ষেপ নিয়েছে। সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়েও এই হার বেশি। ভিয়েতনামের এই উদাহরণ স্বল্প সামর্থ্যের দেশগুলোর জন্য অনুকরণীয়।
(মিন ভু যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়ান স্টাডিজ প্রোগ্রামের শিক্ষার্থী। বিচ টি. ট্র্যান বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ের্প বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক। তাদের এই নিবন্ধ দ্য ডিপ্লোম্যাট সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত।)–এইচআর/ খবরপত্র