আজ স্বাধীনতার সূর্যোদয়ে চির ভাস্বর মাস মার্চের ২৪ তারিখ। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় এ দিন ঘরে ঘরে প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তোলার দৃপ্ত শপথ নিয়ে এগিয়ে চলছে বাংলার সাহসী সন্তানেরা। স্বাধীনতাকামী মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। আগের দিনের সকল দৈনিকে জাতীয় পতাকার ছবি প্রকাশিত হয়। এদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী রংপুর, সৈয়দপুর, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদী জনতার ওপর গুলী চালিয়েছে। জেলা প্রশাসকের নির্দেশ উপেক্ষা করে সেনাবাহিনী রংপুরে সান্ধ্য আইন জারি করেছে। এতে দেশব্যাপী প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও ব্যারিকেড সৃষ্টি হয়েছে। কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ঢাকায় বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। দুপুরে সর্বস্তরের মানুষের এক মিছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাস ভবনে গিয়ে শেষ হয়। সেখনে সমবেত জনতার উদ্দেশে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন দাবি বানচালের জন্য কোনো শক্তি প্রয়োগ সহ্য করা হবে না। এদিন শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যকার বৈঠক হয়নি। বৈঠক হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিষদের মধ্যে। বৈঠকের পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ অপেক্ষমান সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ আলোচনা আর দীর্ঘায়িত করতে প্রস্তুত নয়। দুর্ভাগ্যজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমাধানে শেখ মুজিব প্রেসিডেন্টের কাছে যে মূলনীতি উত্থাপন করেছেন, প্রেসিডেন্ট নীতিগতভাবে তা স্বীকার করে নিয়েছেন। এ স্বীকৃত মূলনীতি কার্যকর না করলে দেশ এক গুরুতর পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে। প্রেসিডেন্ট হাউজে এ আলোচনা প্রায় দু’ঘণ্টা চলে। রাতে শেখ মুজিবের বাসভবনে আবারো সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তাজউদ্দীন আহমদ। এ সময় তিনি বলেন, বল এখন প্রেসিডেন্টের কোর্টে। প্রেসিডেন্টকে এখন তার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় আগত সংখ্যালঘু পার্লামেন্টারি দলসমূহের নেতৃবৃন্দ এদিন করাচীর উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। বর্তমান রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনার জন্য তারা ঢাকা এসেছিলেন। ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিমলীগের সভাপতি মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ দওলতানা সাংবাদিকদের বলেন, তিনি অত্যন্ত সন্তষ্টচিত্তে প্রত্যাবর্তন করছেন না। এছাড়া পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিসি) ১৪ জন নেতার মধ্যে এদিন সাতজন পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। দলীয় প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে তারা ঢকা এসেছিলেন। এদিন ঢাকা টেলিভিশনের সকল কর্মচারী প্রতীক ধর্মঘট পালন করে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে এমভি সোয়াত জাহান হতে সামরিক বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র খালাস করার সময় বাধাদানকারী উত্তেজিত জনতার ওপর সৈন্যরা গুলী চালায়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে শহরে তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। হাজার হাজার বিদ্রোহী জনতা বন্দর ঘিরে রাখে। সৈন্যরা যাতে শহরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য ক্যান্টনমেন্টের সাথে সংযোগ রক্ষাকারী সকল সড়ক বিনষ্ট করে দিয়েছে। এছাড়া পীচ ভর্তি ড্রাম, গাছের গুড়ি, ইট, পাথর দিয়ে বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়েছে। এদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে জুলফিকার আলী ভুট্টোর চতুর্থ দফা বৈঠক হয়। এ বৈঠক প্রায় ২৫ মিনিট চলে। বৈঠক শেষে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ফিরে ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন, তিনি একনিষ্ঠভাবে বাংলাদেশের জনসাধারণের সেবা করেছেন এবং বাংলার জনগণ শোষিত হচ্ছে বলে তিনি অনেক আগে থেকেই সোচ্চার। সৈন্যবাহী একটি বিদেশী বিমান এদিন পূর্ব বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে কোনো একটি গোপন স্থানে অবতরণ করবে বলে জানা যায়। সেনাবাহিনীর গুলীবর্ষণ, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার অশুভ তৎপরতায় পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমশ বিস্ফোরোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এদিনে রাত ৮টার দিকে ভুট্টোর প্রধান সহচর গোলাম মোস্তফা খাঁ শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেন। খাঁ মুজিবের কাছে ভুট্টোর সর্বশেষ প্রস্তাব নিয়ে আসেন এবং তার চূড়ান্ত জবাব চান। অর্থাৎ শেখ মুজিব ভুট্টোর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে পিপিপির সাথে কোয়ালিশন করে সরকার গঠনে রাজি আছেন কিনা তা জানতে আসেন।