১৯৭১-র যুদ্ধে চরম লজ্জাজনক পরাজয়ের কারণ খুঁজতে পাকিস্তান গঠন করেছিল জাস্টিস হামুদুর রেহমান কমিশন। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি হামুদুর রেহমানের নেতৃত্বে আরও দুজন শীর্ষ বিচারপতি, আনোয়ারুল হক ও তুফায়লায়লি আবদুর রেহমান খতিয়ে দেখেছিলেন কোন ঘটনাপ্রবাহের পরিণতিতে পাকিস্তানের শোচনীয় পরিণতি হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার সেই কমিশনের রিপোর্ট ‘ডিক্লাসিফাই’ করে মাত্র বছর কুড়ি আগে । তারপরও রিপোর্টের প্রামাণ্য প্রতিলিপি আজও দুষ্প্রাপ্য দলিল হিসেবেই রয়ে গেছে। ে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিকাল। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লে. জেনারেল আমীর আব্দুল্লা খান নিয়াজি যে পরিস্থিতিতে আর যেভাবে ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধি লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক অধ্যায়।
এই আত্মসমর্পণের আদৌ প্রয়োজন ছিল কি না, জেনারল নিয়াজিকে আদৌ সেরকম নির্দেশ পাঠানো হয়েছিল কি না, তা নিয়ে পরে পাকিস্তানে বিস্তর লেখালেখি ও আলোচনা হয়েছে। জাস্টিস হামুদুর রেহমান কমিশনের রিপোর্টেও পুরো একটি অধ্যায় আছে, ‘জেনারেল নিয়াজির কি আদৌ আত্মসমর্পণ করার দরকার ছিল?’ এই শিরোনামে। সেখানে আলোচিত পয়েন্টগুলো এরকম: ক) কমিশনের সামনে জেনারেল নিয়াজি দাবি করেছিলেন, সারেন্ডার করা ছাড়া তার কাছে রাস্তা ছিল না। সেনা সদর দফতর (জিএইচকিউ) থেকে, প্রেসিডেন্ট বা গভর্নরের দফতর থেকে তাকে সেই মর্মে কোনও নির্দেশ পাঠানো হয়েছিল কি না, কমিশন তা খুঁটিয়ে দেখেছে। তারপর আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, নির্দেশগুলো ছিল অস্পষ্ট। সোজা কথায় নিজেদের দায়িত্ব এড়ানোর উদ্দেশ্য সেখানে ছিল পরিষ্কার। খ) ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে জিএইচকিউ থেকে তাকে (নিয়াজিকে) যে বার্তা পাঠানো হয়েছিল (জি-০০১৩) সেটাও ছিল স্পষ্টতই ‘সারেন্ডার করার অনুমতি’, কোনও নির্দেশ নয়। এমন কী ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ’র সঙ্গে জেনারেল নিয়াজির যোগাযোগ হওয়ার পরও তাকে যে বার্তা পাঠানো হয়, সেটাতেও বলা ছিল ‘অ্যাক্ট অ্যাকরডিংলি’, অর্থাৎ পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নাও।
গ) আত্মসমর্পণের আগে ঢাকায় উপস্থিত অন্য ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে জেনারেল নিয়াজি কতটা এবং কী আলোচনা করেছিলেন সেটা পরিষ্কার নয়। তবে একটা বিষয় মোটামুটি স্পষ্ট, অন্য সব জেনারেলরাই তাকে বলেছিলেন সারেন্ডার করবেন কি না সেই সিদ্ধান্ত একান্তভাবেই তার। তবে তারা কেউই তাকে সারেন্ডার না-করার জন্য সক্রিয়ভাবে জোর করেনি, এটাও ঠিক।
ঘ) জেনারেল ফারমান আলি নিয়াজিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, আপনি বরং ঢালাওভাবে আত্মসমর্পণ না-করে সারেন্ডারের সিদ্ধান্ত আলাদা আলাদা বিভাগের ডিভিশনাল কমান্ডারদের হাতে ছেড়ে দিন। তাদের নিজ নিজ এলাকার পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে দিন।
রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ আবার কমিশনে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন- ‘আমি জেনারেল নিয়াজিকে বলেছিলাম সারেন্ডার করার কোনও দরকার নেই। কারণ বার্তায় সেরকম কিছু বলা হয়নি। বরং যা করার জাতিসংঘই করুক। আপনি লড়াই চালিয়ে যান। নইলে পরে আপনার ঘাড়েই দোষ এসে পড়বে। কিন্তু এই পরামর্শে উনি কোনও প্রতিক্রিয়াই দেখাননি। চুপ করে স্থানুর মতো বসেছিলেন’।
ঙ) কমিশন অবশ্য মনে করে, আত্মসমর্পণের অনেক আগেই পাকিস্তানি সেনাদের লড়াইয়ের ইচ্ছা হারিয়ে গিয়েছিল। ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে যশোরের পতনের পরই কমান্ডে বা আরও নিচুতলায় কোনও সত্যিকারের প্রতিরোধ অবশিষ্ট ছিল না। জেনারেল নিয়াজি নিজেও পরে স্বীকার করেছেন, ওই পর্যায় থেকে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি প্রভাবিত করার ক্ষমতা তার হাতের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। চ) ৭ ডিসেম্বরের পর থেকে নিয়াজি কার্যত ‘মেন্টাল প্যারালাইসিস’ বা মানসিক স্থবিরতার দশায় চলে গিয়েছিলেন। ঢাকার প্রতিরক্ষার পরিকল্পনা পর্যন্ত ঠিকমতো করা হয়নি। অনেক জায়গায় ১৬ তারিখের আগেই সেনারা নিজে থেকে আত্মসমর্পণ করে বসেছিলেন।
ছ) জেনারেল নিয়াজি তখন সদর দফতরে একের পর এক ‘সিগনাল’ পাঠাচ্ছেন-ভারতীয় সেনারা ঢাকার দোরগোড়ায় চলে এসেছে। কিন্তু তাদের তখনও ঢাকা দখল করার অনেক বাকি। হেলিকপ্টারে করে নরসিংদীতে ভারতীয় সেনারা পৌঁছে গেছে বলেও তিনি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের ঢাকায় পৌঁছতে ও ঢাকা কবজা করতে আরও অন্তত সাতদিন লাগতই। ফলে নিয়াজির হাতে ১৫ ডিসেম্বরের পরও কম করে দুসপ্তাহ সময় কিন্তু ছিল।
জ) কমিশনের বিশ্বাস, ঢাকার ওপর ভারতীয় বাহিনীর বোমাবর্ষণের সম্ভাবনাকেও জেনারেল নিয়াজি ‘ওভারএস্টিমেট’ করেছিলেন। মনে রাখতে হবে, ভারত নিজেদেরকে বাঙালিদের ‘রক্ষাকর্তা’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছিল এবং স্বভাবতই তারা ঢাকার ওপর নির্বিচারে বোমা ফেলার ঝুঁকি কিছুতেই নিত না। এমন কী, ভারী আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েও হয়তো তারা গোলাবর্ষণ করত না – কারণ তাতে প্রচুর বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হতো। কিন্তু নিয়াজি হিসাবটা কষেননি।
ঝ) কমিশনের মতে, জেনারেল নিয়াজি যে আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তার প্রধান কারণ ছিল, তিনি এমন এক ধারণার বশবর্তী ছিলেন যে সর্বাত্মক যুদ্ধ হয়তো কখনওই হবে না। পূর্ব পাকিস্তানে তার ডিউটি বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে (মুক্তিবাহিনী) প্রতিহত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে তার বিশ্বাস ছিল। তার সেই অর্থে যুদ্ধ করার কোনও অভিপ্রায়ই ছিল না, এবং যুদ্ধের জন্য তিনি কোনও পরিকল্পনাও তৈরি করেননি। ফলে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি লড়াই করার ইচ্ছা হারিয়ে বসেন এবং যে কোনও সময় হাল ছেড়ে দিতে মানসিকভাবে তৈরি হতে থাকেন।
ঞ) জেনারেল নিয়াজি আমাদের জানিয়েছেন যে, আত্মসমর্পণের আগের দিনও তার অধীনে ঢাকায় ২৬ হাজার সেনা ছিল। সংখ্যাটা যদি তিনি ঠিক বলে থাকেন, তাহলে তো আরও বেশি করে তার নিজের জায়গায় অটল থাকার দরকার ছিল। এই সব কারণেই আত্মসমর্পণ করা ছাড়া জেনারেল নিয়াজির কোনও উপায় ছিল না– কমিশন কিন্তু এই উপসংহার টানতে পারছে না।
অন্যভাবে বললে, হামুদুর রেহমান কমিশন প্রকারান্তরে পাকিস্তানের জন্য চরম লজ্জাজনক এক সারেন্ডারের দায় চাপিয়েছে একজন ব্যক্তির ওপরেই– তিনি লে. জেনারেল আমির আব্দুল্লা খান নিয়াজি।- বাংলা ট্রিবিউন