রোজার উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যায় না। মহান আল্লাহ রোজাকে মুমিনের জন্য একটি প্রশিক্ষণ এবং দেহ ও মনের গঠনের মাস হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। মানুষের পাঁচটি ইন্দ্রিয় আছে। এর মাধ্যমে মানুষ দুনিয়ার রূপ, রস, গন্ধ অনুভব করে। আর এসব ইন্দ্রিয়ের তাড়নায় মানুষ যতসব গুনাহের কাজে লিপ্ত হয়। রোজা ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণের জন্য মানুষকে শিক্ষা দেয়। রিপুর তাড়না থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে যারা এক মাস রোজা রাখার সৌভাগ্য লাভ করে তারাই হয় সফলকাম।
একজন যদি চোখ, কান, জিহ্বা, অন্তর এবং পেটের কাজগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারে এবং এগুলো দ্বারা খারাপ থেকে বেঁচে থাকতে পারে, তা হলেই সে রোজা যথাযথভাবে পালন করবে। রোজা আমাদের দেহ, মন এবং রূহকে সুস্থ, সবল এবং বিকশিত করে। চোখের রোজা বলতে আমরা চোখকে পাপ কাজ দেখা বিরত রেখে এর যথাযথ হিফাজত করাকে বুঝি। চোখের দৃষ্টি প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ সূরা আন-নূরের ৩০ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘হে নবী! মুমিনদের বলুন, তারা যেন চোখকে অবনত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে।’ দৃষ্টি সম্পর্কে মহানবী সা: আলী রা:-এর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘তোমার চোখ অবনত রাখো’ (সহিহ মুসলিম ও তিরমিজি)।
রোজাদার অশ্লীল, অশালীন এবং নিষিদ্ধ জিনিস থেকে চোখকে ফিরিয়ে রাখবে। ভালো কাজ এবং আমলের দিকে সে দৃষ্টিপাত করবে। কেননা, নিষিদ্ধ এবং হারাম কাজের ফলে তার আমল নষ্ট হয়ে যায়, অন্তর অশান্ত হয়ে পড়ে, আল্লাহর আনুগত্যের পথ থেকে সে ছিটকে পড়ে, ওই ব্যক্তি গোনাহের কাজে জড়িয়ে পড়ে। তাই রোজার দিনে মহান আল্লাহর নেয়ামত চোখকে সংযত রেখে আমরা আমলের নিরাপত্তা বিধানে সচেষ্ট থাকব এবং তাকওয়ার গুণ নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করব।
কান আল্লাহর দেয়া আরেকটি বড় নিয়ামত। এই অঙ্গটি না থাকলে আমরা কোনো কিছুই শুনতে পারতাম না। আর কিছু শুনতে না পারলে আল্লাহর আদেশ মানার ক্ষেত্রেও আমরা সক্ষম হতাম না। কান প্রসঙ্গে সূরা বনি ইসরাইলের ৩৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই কান, চক্ষু এবং অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।’ তাই কান দিয়ে ভালো এবং উপকারী বিষয় শুনতে হবে। আর মন্দ এবং খারাপ কথা, কারো দোষত্রুটি এবং গিবতের কথা শোনা থেকে বিরত থাকতে হবে। দুনিয়ার অশ্লীল গান-বাজনাসহ যত মন্দ সূর এবং কথা আছে তা থেকে কানকে মুক্ত রাখতে হবে। তা হলেই রোজার উদ্দেশ্য পূরণ হবে। তাই আল্লাহ সূরা কাসাসের ৫৫ নম্বর আয়াতে নেককার বান্দা বা মুমিনের একটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন, ‘তারা যখন অবাঞ্ছিত বাজে কথাবার্তা শ্রবণ করে, তখন তারা তা এড়িয়ে যায়।’ তাই রোজাদার কুরআনের বাণী, হেদায়াত এবং কল্যাণের কথা শুনবে এবং সব রকম মন্দ কথা শোনা থেকে নিজেকে বিরত রাখবে।
জিহ্বা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি কথার বাহন। জিহ্বা দিয়ে অনেক গুনাহর আমল সম্পাদিত হয়। এই অঙ্গটিকে মানুষ জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ব্যবহার করে। তাই জিহ্বাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জিহ্বা বা কথা সবসময় রেকর্ড করা হয়। সূরা কাফের ১৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই রেকর্ড করার জন্য তার কাছে সদা প্রস্তুত পর্যক্ষেক রয়েছে।’ তাই কথা বলার সময় ভালো কথা বলতে হবে। খারাপ বা অশ্লীল কথা বলা যাবে না। একজন মুুমিন কখনো বেহুদা কথা বলতে পারে না। এ সম্পর্কে সূরা মুমিনুনের ৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘মুমিনরা অপ্রয়োজনীয় অনর্থক বেহুদা কথাবার্তায় নির্লিপ্ত থাকে না।’ জিহ্বা সংযত রাখার বিষয়ে মহানবী সা: মুয়াজ রা:-এর কথা প্রসঙ্গে বলেন, ‘হে মুয়াজ! এটিকে সংযত রাখো। এ কথা বলে নবীজী নিজ জিহ্বার দিকে ইঙ্গিত করেন। তখন মুয়াজ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:, আমরা যেসব কথা বলি, সেগুলোর ব্যাপারেও কি আল্লাহ পাকড়াও করবেন? মহানবী সা: বললেন, সর্বনাশ। হে মুয়াজ! জিহ্বার খারাপ ফলাফল হিসাব করেই মানুষকে তার নিজ চেহারার ওপর উপুড় করে দোজখে নিক্ষেপ করা হবে’ (তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)। অন্য একটি হাদিসে নবীজী বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন কথা বললে ভালো কথা বলে কিংবা চুপ থাকে’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)।
রোজাদারের জন্য পেটের চাহিদার প্রতি খেয়াল রাখাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পেটের রোজার ওপর দেহের রোজার সঠিকতা নির্ভর করে। পেটের জন্য মানুষ খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় গ্রহণ করে। পেটের রোজা মানে পেটকে হারাম খাদ্য এবং পানীয় থেকে বাঁচানো। তাই সাহরি ও ইফতারের আহার ও পানীয় পবিত্র এবং হালাল হতে হবে। সূরা মুমিনুনের ৫১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘হে রাসূলগণ! পবিত্র বস্তু থেকে খাবার গ্রহণ করুন এবং নেক কাজ করুন।’ সূরা বাকারার ১৭২ নম্বর আয়াতেও আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু সামগ্রী থেকে আহার করো।’
সবশেষে অন্তরের রোজা হলো মানবদেহের রোজার প্রধান ভিত্তি। কেননা, অন্তরের সঠিকতা বা হেদায়াতই ইবাদতের মূল বিষয়। আমাদের যে নফ্স আছে তার তাড়না থেকে আমাদের অন্তর তা পরিপালন করে। তাই অন্তরকে শিরক বিদয়াত থেকে মুক্ত রাখা, বাতিল আকিদা বিশ^াস থেকে দূরে রাখা, অহঙ্কার, হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত রাখা রোজা সঠিক হওয়ার অন্যতম শর্ত। এসব খারাপ বিষয় অন্তরে লালন করে রোজার কোনো সার্থকতা নেই। তাই আমরা আমাদের প্রতিটি ইন্দ্রিয়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাব এবং এগুলোকে খারাপ বা মন্দ কাজ ও ক্রিয়া থেকে মুক্ত রাখব। রোজাদারের রোজা পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে রিপুর তাড়না এবং এর মন্দ ব্যবহার থেকে মুক্ত থাকার তৌফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক। বর্তমানে, কো-অর্ডিনেটর, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড