সপ্তাহ পেরোনোর আগেই শেষ হয়ে যাচ্ছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার মজুদ। অন্যদিকে ভারতও অক্টোবরের আগে পর্যাপ্ত মাত্রায় টিকা রফতানি করতে পারবে না বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। এ অবস্থায় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে চীন ও রাশিয়া থেকে টিকা ক্রয়ের। এ ক্রয় কার্যক্রমের আর্থিক বিষয় নিয়ে অর্থ বিভাগের মতামত চেয়েছিল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এতে সায় দিয়ে অর্থ বিভাগ বলছে, চীন ও রাশিয়ার টিকা আপাতত প্রতিটি এক কোটি করে মোট দুই কোটি ডোজ কেনা যেতে পারে। তবে পুরো দাম আগেই পরিশোধ করা যাবে না। সম্প্রতি চীনের সিনোফার্ম টিকা ক্রয়ের চুক্তির বিষয়ে অর্থ বিভাগের মতামত চায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। এর পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ বিভাগ বলেছে, প্রস্তাবিত শিডিউল অনুযায়ী তিন কিস্তিতে আপাতত এক কোটি ডোজ টিকা কেনা যেতে পারে। তবে ভবিষ্যতে এর পরিমাণ আলোচনার মাধ্যমে বাড়ানো যেতে পারে।
আরেক চিঠিতে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ অর্থ বিভাগের কাছে রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি টিকা ক্রয় নিয়েও মতামত চেয়েছিল। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের বক্তব্য হলো প্রস্তাবিত চুক্তিটি সরকারের সঙ্গে সরকার (জিটুজি) নয়। এটি জিটুজি অথবা বিজনেস টু গভর্নমেন্ট (ব্যক্তি খাতের সঙ্গে সরকার) পদ্ধতিতে করাই সমীচীন হবে। এসব টিকার চালান ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সরবরাহ নেয়াটা সমীচীন হবে। এক্ষেত্রে টিকার মূল্য, পরিবহন ব্যয়, বীমা খরচ ও স্থানীয় শুল্ক-কর ইত্যাদি সরকার বহন করবে। স্পুটনিক-ভি টিকাটিও এক কোটি ডোজ কেনা যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতি মাসে ২০ লাখ ডোজ করে সরবরাহ নেয়া যেতে পারে। তবে এরপর প্রয়োজনে উভয় পক্ষের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে এ টিকা ক্রয়ের পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে। দুটি টিকার ক্ষেত্রেই অর্থ বিভাগের মতামত হলো ঋণপত্রের মাধ্যমে প্রত্যেক চালান জাহাজীকরণের আগে এর অর্ধেক মূল্য পরিশোধ করা যেতে পারে। বাকি অর্ধেক পরিশোধ করা হবে চালান ঢাকায় পৌঁছার পর। টিকা দুটির দাম এখনো নির্ধারণ হয়নি। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি দর-কষাকষির মাধ্যমে টিকার মূল্য নির্ধারণ করবে বলে জানা গিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, সিনোফার্মের টিকার প্রতি ডোজের দাম ১৯ থেকে ৩৮ ডলার পর্যন্ত এবং রাশিয়ার টিকার মূল্য প্রতি ডোজের দাম ১২ থেকে ২৪ ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
ক্রয় চুক্তিসংক্রান্ত বিষয়ে অর্থ বিভাগ বলেছে, এক্ষেত্রে চুক্তি বিজনেস টু বিজনেসের (ব্যক্তি খাতের সঙ্গে ব্যক্তি খাত) পরিবর্তে বিজনেস টু গভর্নমেন্ট (ব্যক্তি খাতের সঙ্গে সরকার) হতে হবে। ফলে খসড়া চুক্তি যথাযথভাবে সংশোধন করা প্রয়োজন। এসব টিকার খরচ, বীমা ও পরিবহন খরচ বহন করবে সরকার। এছাড়া বন্দর থেকে টিকা ছাড়ানো ও স্থানীয় শুল্ক বাবদ ব্যয় সরকার বহন করবে। টিকার মূল্য স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি চূড়ান্ত করবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মুহিবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, অর্থ বিভাগ থেকে মতামত এসেছে। টিকার দাম নির্ধারণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি রয়েছে। এ কমিটিই টিকার মূল্য নির্ধারণ করবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্চের পর এখন পর্যন্ত ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কোনো টিকা পাওয়া যায়নি। ফলে টিকার প্রথম ডোজ নেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সাড়ে ১৪ লাখ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার দ্বিতীয় ডোজ পাবেন না। এ অবস্থায় টিকা ক্রয়ের জন্য বিভিন্ন উেস যোগাযোগ করছে সরকার। এর মধ্যে মস্কোর গামালিয়া ইনস্টিটিউটের তৈরি স্পুটনিক-ভি ও বেইজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রডাক্ট উৎপাদিত সিনোফার্ম টিকার জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োগের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে পাঠানো সিনোফার্মের পাঁচ লাখ ডোজ টিকাও এরই মধ্যে দেশে এসে পৌঁছেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রাশিয়া ও চীনের টিকা উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। দেশ দুটির বিশেষজ্ঞরা দেশে টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা যাচাই-বাছাই শেষে চুক্তি করলে তবেই উৎপাদনে যাওয়া যাবে। সেক্ষেত্রে সময় লেগে যেতে পারে আরো ছয় মাসের মতো। বর্তমান পরিস্থিতিতে টিকার জন্য এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রাথমিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক টিকার ডোজ ক্রয়ের চুক্তি করছে সরকার। এক্ষেত্রে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে টিকা ক্রয়ের বিড়ম্বনার বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, করোনার টিকার জন্য বৈশ্বিক জোট কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি থেকে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের জন্য টিকা পাবে বাংলাদেশ। এতে ৬ কোটি ৮০ লাখ টিকা বিনা মূল্যে পাওয়া যাবে। এরপর জোটটি থেকে টিকা কিনতে চাইলে সেক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় ডোজ সরবরাহ করা হবে। তাতে আনুমানিক দাম পড়তে পারে ৭ ডলার করে। অন্যদিকে সেরামের প্রস্তুতকৃত টিকার প্রতি ডোজের জন্য ৫ ডলার করে (পরিবহন খরচসহ) পরিশোধ করতে হয়েছে বাংলাদেশকে।
করোনার টিকা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (মা-শিশু ও কৈশোর স্বাস্থ্য কর্মসূচি) ডা. মো. শামসুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, কোভ্যাক্স থেকে টিকা কিনলে অনুমিত দাম হতে পারে ৭ ডলার। তবে তা বেশি-কম হতে পারে। অন্য টিকার দামের বিষয়ে এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না।
এদিকে দেশে সিনোফার্ম ও স্পুটনিক-ভি টিকা উৎপাদন বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশীয় প্রতিষ্ঠানের টিকা উৎপাদন প্রস্তুতি অনেকটা এগিয়ে থাকলেও চীন-রাশিয়ার সঙ্গে শর্তের আলোচনা চলছে। শর্তের পাশাপাশি টিকার দাম নিয়েও আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। আলোচনায় সন্তোষজনক অবস্থার সৃষ্টি হলে চুক্তি চূড়ান্ত করা হবে। প্রসঙ্গত, গত ৮ জানুয়ারি ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার জরুরি প্রয়োগের অনুমোদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশে কভিড-১৯ প্রতিরোধী গণটিকা প্রয়োগ শুরু হয়। বর্তমানে চল্লিশোর্ধ্ব এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নাগরিকদের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ‘কোভিশিল্ড’ টিকা দেয়া হচ্ছে। এ টিকার জন্য স্থানীয় উৎপাদক ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে গত নভেম্বরে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করে সরকার। টিকার দাম আগাম পরিশোধ করা হলেও শর্ত অনুসারে টিকা পায়নি বাংলাদেশ।
এদিকে গত বুধবার পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, ৫৮ লাখ ১৯ হাজার ৯১২ জনকে প্রথম ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৩৮ লাখ ২১ হাজার ৪০০ জন। দ্বিতীয় ডোজের জন্য অপেক্ষায় আছেন ১৯ লাখ ৯৮ হাজার ৫১২ জন। সরকারের কাছে এ মুহূর্তে ৫ লাখ ৫৮ হাজার ৬৪৪ ডোজ টিকা মজুদ রয়েছে, যা এক সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।