মানুষ ভাবে, তার তো জীবনের বহু সময় এখনো বাকি আছে। সুতরাং দুনিয়ার শোভা সৌন্দর্য একটু ভোগ করে নিই, তারপর যখন বার্ধক্য আসবে হজ করে পাক্কা মুসল্লি সেজে যাবো। শেষ ভালো হলেই তো হলো। এরা আল্লাহর বন্দেগি ও আখিরাতের উপকরণগুলোকে রিটায়ার্ড লাইফের সময় কাটানোর বিষয়বস্তু মনে করে। আরেকটি পারসেপশন হতে পারে- দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে গেলে এত ধার্মিকতা দেখিয়ে পারা যাবে না অথবা ধার্মিক হয়ে গেলে তো সবই গেল,পার্টি, মউজ-মাস্তি, ফ্রি স্টাইল লাইফ, মদ-বার ইত্যাদি ইত্যাদি।
আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিকর্তা, আমাদের মাইন্ডসেট সম্পর্কে তাঁর চেয়ে ভালো আর কে জানে? আখিরাতের বিষয়ে মানুষের উদাসীনতা এবং তৃতীয় শ্রেণীর মানসিকতা প্রসঙ্গে তিনি কুরআনে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। প্রথম শ্রেণীর মানুষ তার ওপর যে সার্বক্ষণিক গোলামির দায়িত্ব রয়েছে এবং যে কাজগুলো অবশ্য পালনীয় সেগুলোকে সে বর্জন করে। যখন তাদের কারো কাছে মৃত্যু আসে, তখন সে বলে : হে আমার পালনকর্তা! আমাকে পুনরায় (দুনিয়াতে ) প্রেরণ করুন। যাতে আমি সৎকর্ম করতে পারি, যা আমি করিনি। কখনোই নয়, এ তো তার একটি কথার কথা মাত্র। তাদের সামনে পর্দা আছে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত (সূরা মুমিনুন : ৯৯-১০০)।
এরা সামনে ভালো কাজের সুযোগ ও সব ধরনের সামর্থ্য এবং সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা এড়িয়ে যায়। অখ- অবসর, তার পরও বলে সময়ের অভাবে কুরআন পড়তে পারলাম না, নামাজ আদায় করতে পারলাম না। সময়ের কাজ সময়ে না করে ‘করব, করছি’ মনোভাব তাকে অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত পৌঁছায়। এটাই সত্য যে, তখন তার সদিচ্ছা ও মিনতি কোনো কাজে আসে না। দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ অর্থের কাঙাল ও কৃপণ, দান সদকার ব্যাপারে একেবারে বদ্ধমুষ্টি। এরা মনে করে, মেধা,পরিশ্রম আর বুদ্ধি দিয়ে আমি কামাই রোজগার করেছি ফকির মিসকিন খাওয়ানোর জন্য! পাড়ায় একটা মাহফিল হবে। বলে, আরে ভাই! আমি খুব ব্যস্ত, পরে আসেন। একজন গরিব আত্মীয় সাহায্য চাইলে রাজ্যের কথা শোনান, তবু কানাকড়িও সাহায্য করেন না।
এমন লোকদের বিষয়ে আল্লাহ বলেন, আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি, তা থেকে মৃত্যু আসার আগেই ব্যয় করো। অন্যথায় সে বলবে : হে আমার পালনকর্তা, আমাকে আরো কিছুকাল অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম (সূরা মুনাফেকুন : ৯)।
মানুষের অর্থবিত্তের মালিক হওয়া আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ, এতে মানুষের অহংবোধের কিছু নেই। আমার এই সক্ষমতার জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করাই হলো অসহায় বান্দার সাহায্য করা। তিনি ধন সম্পদ দিয়ে আমাদের পরীক্ষা করেন। হতে পারে এমন একটা মুসিবত এসে হাজির হলো তাতে জীবনের সব কামাই চলে গেল। তাই, সময় ও সুযোগ এলেই তার সদ্ব্যবহার করা উচিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরকম গরিব লোক খুঁজে খুঁজে তাদের হক পৌঁছে দেয়া উচিত। তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ তওবা করতে কালক্ষেপণ করে। কেউ কেউ অবলীলায় প্রকাশ্যে গুনাহের কাজ করে যায়। তারা গুনাহে লজ্জা পায় না, অনুশোচনাও করে না। মুমিন তো সেই যে কখনো অনিচ্ছায় ছোটখাটো গুনাহ হয়ে গেলে সাথে সাথে লজ্জিত হয়, অনুতাপ-অনুশোচনায় ভোগে এবং আল্লাহর কাছে তওবা করে সংশোধন হয়ে যায়।
আর এমন লোকদের জন্য কোনো ক্ষমা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমনকি যখন তাদের কারো মাথার ওপর মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকে : আমি এখন তওবা করছি। আর তওবা নেই তাদের জন্য, যারা কুফরি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। আমি তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি (সূরা নিসা : ১৮)।
প্রসঙ্গত, তিনটি আয়াতেই মৃত্যুর পূর্বক্ষণে মরণোন্মুখ ব্যক্তির আবেদন স্পষ্ট করা হয়েছে এবং তিনটি বিশেষ আকাক্সক্ষাÑ নেক কাজ করার আকাক্সক্ষা, সদকা করার সদিচ্ছা এবং সর্বশেষ তওবা করার সঙ্কল্পের কথা বলা হয়েছে। মানুষ কখন মৃত্যুর দূত তার দুয়ারে হানা দেবে জানে না। পীর বুজুর্গগণও জানেন না।
সুতরাং চিরসত্য মৃত্যুর মুখামুখি হওয়ার আগেই যেন আমরা সব ভালো কাজ করার ও খারাপ কাজ বর্জন করতে পারি। আমাদের যে রুজি তিনি দিয়েছেন তা যতটাই পরিমাণে হোক, কোনো প্রার্থী যেন আমার কাছ থেকে নিষ্ফল না যায়। মৃত্যুর ফেরেশতা আসার অপেক্ষা না করে প্রতিদিন অন্তত নিদ্রায় যাওয়ার আগেই খালেস অন্তরে তওবা করি, কে জানে সেটিই আমার শেষ নিদ্রা কি না। লেখক : সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ