দেশের সাত জেলায় বাড়তে শুরু করেছে। এই সাতটি জেলাই সীমান্তবর্তী। বাংলাদেশে সীমান্তবর্তী জেলা আছে ৩২টি। এর মধ্যে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত আছে ৩০ জেলার। এই ৩০ জেলার মধ্যে স¤প্রতি নতুন করে সংক্রমণ বেড়েছে ৭ জেলায়। জেলাগুলো হচ্ছে যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিলেট। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের তালিকায় আছে চাপাইনবাগঞ্জ এবং রাজশাহী। তবে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট কিনা তা এখনও বলা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জনরা। তবে তারা সংক্রমণ বাড়ার পেছনে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ঈদ যাত্রাকেই দায়ী করছেন।
দেশের সাত জেলায় ঈদের পর সংক্রমণের হার কম থাকলেও চার-পাঁচদিন আগে থেকে তা বাড়তে শুরু করেছে। রাজশাহী বিভাগের চাপাইনবাবগঞ্জে ২২ শতাংশ থেকে ছয়দিনের ব্যবধানে ৫০ শতাংশের বেশি দাঁড়িয়েছে সংক্রমণের হার। গত ১৮ মে থেকে এই সংক্রমণের হার বেড়েছে বলে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। পার্শ্ববর্তী জেলা রাজশাহীতে দাঁড়িয়েছে ৩৩ শতাংশের কাছাকছি। উচ্চ সংক্রমণ দেখা দেওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে সাতদিন লকডাউন ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। গত সোমবার দিবাগত রাত ১২ টা ১ মিনিট থেকে এই লকডাউন কার্যকর হবে। এই সাতদিন জেলা থেকে কেউ বের হতে পারবেনা বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ। বর্তমানে সারাদেশে একটি জেলাই আছে বিশেষ এই লকডাউনের আওতায়। জেলা পুলিশ সুপার এএইচএম আবদুর রকিব জানান,স্বাস্থ্য বিভাগ ও জেলা প্রশাসনকে সহায়তায় মাঠে থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ সুপার বলেন, জেলায় প্রবেশের সকল পথ সিলগালা করা হয়েছে যাতে কেউ জেলায় প্রবেশ করতে এবং জেলা থেকে বাইরে যেতে না পারে। পাশাপাশি সর্বাত্মক কঠোর লকডাউন মেনে চলতে বাধ্য করা হবে জনগণকে। জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী মনে করছেন এই সংক্রমণের হার বেড়েছে সাস্থ্যবিধি না মানার কারণে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এক কোথায় বলতে গেলে চাপাইনবাবগঞ্জের করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বেশ কিছু লোক জেলার বাইরে ধান কাটতে যায়। তারাও ফিরে এসেছে। আবার অনেকে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন, এরাও ফিরে চলে এসেছে। শিবগঞ্জ আর চাপাইনবাবগঞ্জ সদরের মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনও বালাই নেই। জেল জরিমানা সবই করা হয়েছে কিন্তু মাস্ক পড়তে চায় না।
তবে ভারতের সঙ্গে সীমান্তজনিত এলাকা হওয়ার কারণে সংক্রমণ বাড়ার কারণ খুব কম বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরও জানান, সীমান্ত এলাকায় চোরাচালানি বেশি হয় আর ক্রস বর্ডার বাণিজ্য মাত্রাতিরিক্ত বলে মনে হচ্ছে না। স্থানীয়ভাবেই এই সংক্রমণ বেড়েছে বলে আমার ধারণা। আমরা বিজিবির সঙ্গে কথা বলেছি সীমান্ত দিয়ে মানুষ যাতে কম পারাপার হয় সেই বিষয়ে আমরা তাদের জানিয়েছি।
তবে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে এখনই সীমান্তজনিত যাতায়াতের কারণে বেড়েছে কিনা বলা যাবে না। চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে ৪২ জনের নমুনা ঢাকায় জিনোম সিকোয়েন্স করার জন্য পাঠানো হয়েছে। ঈদের ছুটির কারণে ১২ দিনে ঢাকা থেকে প্রায় ১ কোটি মোবাইল গ্রাহক গেছে অন্যত্র। মোবাইল অপারেটর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই সংখ্যা জানা যায়। তার মধ্যে প্রায় ৭৯ লাখ ফেরত এসেছে ২৩ মে পর্যন্ত। ঈদের সময় সরকাররের কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ থাকায় দুরপাল্লার যানবাহন ছিল বন্ধ। গত ২ মে থেকে দেশের ফেরিঘাটগুলোতে দেখা যায় ঘরমুখো মানুষের চাপ। জনস্রোত ঠেকাতে ফেরি বন্ধ ঘোষণা করে শুধু মালবাহী পণ্য নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে তাতেও বাধে বিপত্তি। জনস্রোত ঠেকাতে বিজিবি মোতায়েন করা হলেও তাতে কোনও কাজ হয়নি। ফলে আবার ফেরি চালু করে দিতে অনেকটা বাধ্য হয়েছে প্রশাসন। সাধারণ মানুষ যে কোনও উপায়ে ঢাকা ছাড়ছেন। কেউ ট্রাকে, কেউ পিকআপে কিংবা অনেকে পায়ে হেঁটেই রওনা হচ্ছেন গন্তব্যের দিকে। মানুষের এমন নাড়ির টানে বাড়ি যাওয়ার প্রবনতায় ঈদের পর সংক্রমণ বাড়ার শংকা করেছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদরা।
তখন কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তৃতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা করা হচ্ছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় সংক্রমণ একটু বাড়বে। তৃতীয় ঢেউ হবে কি না সেটা এখন বলা যাবে না। এখন সাস্থ্যবিধি না মানার কারণে যে ক্ষতি তা হবে আমাদের। সেটা আমরা ১৫ দিন পর দেখতে পারবো। ১৫ দিন পর বাড়বে সংক্রমণ। তৃতীয় ঢেউ বলতে গেলে অনেক কিছু হিসেব নিকেশ করে বলতে হবে।’
এদিকে রাজশাহীর সংক্রমণের হার এক দিনের ব্যবধানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ শতাংশে। একদিন আগেও ছিল তা ২২ শতাংশ। চাপাইনবাবগঞ্জের মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অবাধ যাতায়াতের কারণে রাজশাহীর সংক্রমণের হার বেড়ে থাকতে পারে বলে মনে করছেন রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. মো. কাইয়ুম তালুকদার। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রাজশাহীর অবস্থা চাঁপাইনবাবগঞ্জের মতো খারাপ না, তবে খারাপের দিকে। আমরা সব জায়গায় প্রস্তুতি নিচ্ছি। অন্য জেলা থেকে যারা আসছে তাদের নিয়ন্ত্রণ , বিশেষ করে চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে এখানে যেন কেউ আসতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে। মানুষ যাতে স্বাস্থ্যবিধি পালন করে সেজন্য নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে।
বেড়ের যাওয়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা অপ্রত্যাশিত না, এমনটা হবে আমরা আগেই ধারণা করেছিলাম। সীমান্তবর্তী এলাকা আরও আছে সবখানে তো একই পরিস্থিতি না। মূল কথা হচ্ছে মানুষের অসচেতনতা। ঢাকা থেকে যখন এতগুলো মানুষ অন্য জেলায় গেল সেখানে অবশ্যই সংক্রমিত হওয়ার সুযোগ থাকে এবং ঈদের পর থেকে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত ৯ জনের শরীরে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে বলে নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তবে জিনোম সিকোয়েন্সিং শেষ হলে আরও রোগী পাওয়া যেতে পারে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অন্যদিকে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে সাতক্ষীরায় ফিরে আসা ৩৩৭ বাংলাদেশি নাগরিকের নমুনা পরীক্ষা শেষে ১৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তদের নমুনা আইইডিসিআর-এ পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে রিপোর্ট আসার পর জানা যাবে তাদের শরীরে ভারতীয় ভেরিয়েন্ট ভাইরাস আছে কিনা। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার তালিকায় আছে এই সীমান্তবর্তী জেলাও। সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. হুসাইন সাফায়াত জানান, ভারত থেকে আসা ৩৩৭ জন বাংলাদেশি নাগরিকের মধ্যে ১৭ জন করোনা রোগীকে রেখে বাকি ৩২০ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। করোনা আক্রান্তদের সাতক্ষীরার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আলাদা ইউনিটে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।