রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৪২ অপরাহ্ন

স্কুল-কলেজের ছুটি বাড়ল ৩০ জুন পর্যন্ত 

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শনিবার, ১২ জুন, ২০২১

করোনাকালে হতাশায় ১৫১ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা!

দেশের সব স্কুল-কলেজের ছুটি আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গতকাল শনিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা এম এ খায়ের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। দেশে করোনা পরিস্থিতি আরো অবনতি হওয়ায় এবং দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে আংশিকভাবে কঠোর লকডাউন কার্যকর থাকায়, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারী ও অভিভাবকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সার্বিক নিরাপত্তার বিবেচনায় চলমান ছুটি আগামী ৩০ জুন ২০২১ তারিখ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি শেষ হচ্ছে আজ। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি বাড়বে কিনা ওই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিল শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আরো বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কথা জানাল মন্ত্রণালয়।
উল্ল্যেখ্য, গত ১৭ মার্চ থেকে করোনার কারণে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর পাঁচ দফায় বাড়ানো হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি।
করোনাকালে ১৫ মাসে ১৫১ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা!: একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন সূত্রে প্রকাশ, করোনাকালে ১৫ মাসে ১৫১ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা!: করেছে। প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো:১৬ বছর বয়সী মুরছালিন। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় সে আসক্ত হয়ে পড়েছিল মোবাইল ফোনে গেম খেলায়। গত ১ জুন মা তাকে গেম খেলতে নিষেধ করেন এবং এক পর্যায়ে মোবাইল ফোনটি কেড়ে নেন। তিন দিন পর ৪ জুন ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার সরকারি সোহাগপুর এসকে পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের চলতি বছরের এসএসসির এই পরীক্ষার্থী। এর পাঁচ দিন আগে একই ধরনের ঘটনায় অভিমান করে অতিরিক্ত গ্যাসের ট্যাবলেট খেয়ে মারা যায় উল্লাপাড়া উপজেলার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মো. রাফি।
গত ২৯ মে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে পড়াশোনা না করায় ফাতেমা আক্তারকে (১৭) বকাঝকা করেন মা-বাবা। অভিমান করে ওই দিনই ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে এসএসসির এই পরীক্ষার্থী। এদিকে প্রেমঘটিত কারণে পরিবারের সঙ্গে মনোমালিন্য হলে গত ২ জানুয়ারি আত্মহত্যা করেন ফাবিহা সুহা নামে ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। গত ৩১ মে স্মার্টফোন নিয়ে মা-বোনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে হতাশায় ভুগে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের শিক্ষার্থী ফারহানুজ্জামান রাকিন। গত ৭ জুন রাজধানীর কামরাঙ্গীর চরে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠায় পুষ্প আক্তার মনিকে (১৫) বকাঝকা করেন মা। অভিমানে ওই দিনই আত্মহত্যা করে দশম শ্রেণির এই ছাত্রী।
শুধু মুরছালিন, রাফি, ফাতেমা, ফাবিহা, রাকিন ও মনিই নয়, দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ১৫ মাসে অন্তত ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে ৭৩ জন স্কুল শিক্ষার্থী, ৪২ জন বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী, ২৭ জন কলেজ শিক্ষার্থী ও ২৯ জন মাদরাসার শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের বেশির ভাগের বয়স ১২ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। গত বছরের ১৮ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর থেকে গত ৪ জুন পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসংক্রান্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ফলে আগামী দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলেও আর ফেরা হবে না তাদের।
মনোচিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন, করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর মানসিক চাপ বাড়ছে। পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, পরিবারের শাসন, কোনো কিছু বায়না ধরে না পাওয়া, প্রেমঘটিত টানাপড়েন, আর্থিক সংকট, বিষণœতা ও একাকিত্বসহ ছোট ছোট সমস্যায়ও অনেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে তারা তুচ্ছ ঘটনায়ও আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাবোধ করছে না। এ জন্য পরিবারের দায়িত্বশীল ভূমিকা, সচেতনতা ও সহনশীলতা বাড়াতে হবে। বিষণœতাগ্রস্ত ব্যক্তিকে একা না রাখা, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটানো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলরসহ মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং কোনো একটি অভাব পূরণ না হওয়া মানে জীবন শেষ নয়, এই উপলব্ধিসহ অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে পারলে আত্মহত্যাপ্রবণতা রোধ করা সম্ভব।
জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আত্মহত্যা করার ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে। ব্যক্তিবিশেষে ক্ষেত্রগুলো ভিন্ন হয়ে থাকে। নিজের স্বার্থে আঘাত লাগা, চাহিদার সঙ্গে প্রাপ্তির ব্যবধান, অসহায়ত্ব, কর্মহীনতা, নৈতিক মূল্যবোধ একেবারে ফুরিয়ে যাওয়া, অর্থসংকট ও চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে না নিতে পারাসহ বেশ কয়েকটি কারণে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। বিশেষ করে করোনার ঘরবন্দি সময়ে মানসিক অস্থিরতা এর জন্য অন্যতম দায়ী।
তিনি বলেন, করোনার সময়ে যেভাবে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে গেছে তা সত্যিই শঙ্কিত করে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। পরিবারে জ্যেষ্ঠদের খেয়াল রাখতে হবে, তাঁদের ছেলে-মেয়ে কী করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে। না হলে যে কেউ ভুল পথে পা বাড়াতে পারে। কারণ আত্মহত্যা করার পেছনে পরিবার, সমাজ ও দেশেরও দায় রয়েছে। মানুষ কেন আত্মহত্যা করে, তা নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা হওয়া দরকার। তরুণদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত দেশে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেছেন। সংগঠনটির দাবি করোনাকালে আত্মহত্যার প্রবণতা প্রায় ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। মোট আত্মহত্যার মধ্যে ৫৭ শতাংশ নারী এবং ৪৩ শতাংশ পুরুষ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার ছেলে স্কুল পড়ে। দীর্ঘদিন ঘরবন্দি। এখন শাসন করতেও ভয় হয়। পত্রপত্রিকায় দেখি ছোট ছোট কারণেই অভিমান করে ছাত্র-ছাত্রীরা আত্মহত্যা করছে। তাই তাদের ভালো-মন্দের বিষয়ে পরিবারসহ বড়দের সবাইকে সচেতন হতে হবে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী নির্দেশনা কেন্দ্রের উপদেষ্টা অধ্যাপক সিরাজ উদ-দৌল্লা বলেন, ‘করোনাকালে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছে। কেউ হতাশ হলে এবং কোনো কিছু সহ্য করার ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে ছোট ছোট কারণে অনেক সময় নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারে না। তখন নিজেকে মূল্যহীন, অসহায় ও একা মনে করে। তখনই আত্মহত্যার মতো ভুল পথে পা বাড়ায় অনেকে।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল ওয়াহাব বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীরা ঘরে বন্দি, খেলাধুলা ও বন্ধু-বান্ধবের সান্নিধ্য তারা পাচ্ছে না। কারণ বন্ধু-বান্ধবের কাছে যা বলা যায়, তা তো আর মা-বাবার সঙ্গে বলা যায় না। সরকার অটো পাস দিচ্ছে, এ রকম করুণা তো অনেক শিক্ষার্থীর কাম্য নয়। করোনাকালে অনেক অভিভাবকের চাকরি চলে গেছে, আর্থিক সংকট তৈরি হয়েছে, তৈরি হয়েছে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। এর সঙ্গে চারপাশ থেকে আত্মীয়-স্বজনসহ অন্যদের প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সংবাদ শুনছে; এসব কিছু মিলিয়ে অনেকের মধ্যে হতাশা ও বিষণœতা বেড়েছে। এসব কারণে কেউ কেউ আত্মহনন করছে।’
এ থেকে উত্তরণের বিষয়ে আব্দুল ওয়াহাব বলেন, ‘যদি কোনো অভিভাবক দেখেন তাঁদের সন্তানের আচরণ হঠাৎ অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে, তাহলে তাদের মনোবিজ্ঞানী বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে নিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া এ সময়ে অভিভাবকদের অন্যতম দায়িত্ব স্কুল-কলেজপড়ুয়া সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীরাও যদি মনে করেন তাঁরা নানা কারণে উদ্বিগ্ন ও বিষণœতার মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন, তাহলে নিজ দায়িত্বে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে কাউন্সেলিং নিলে আত্মত্যার পরিমাণ অনেকাংশে কমে আসবে।’




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com